ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

রেজা সেলিম

ইন্টারনেট ব্যবস্থাপনা

প্রকাশিত: ০৪:০৭, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

ইন্টারনেট ব্যবস্থাপনা

সম্প্রতি পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হচ্ছে, দেশে আবার ব্যান্ডউইডথ বিক্রির চেষ্টা-তদ্বির শুরু হয়েছে। বিদেশে রফতানি করে দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা এনে উন্নয়নমূলক কাজে ব্যবহার হলে আমরা একে স্বাগত জানাই। কিন্তু সরকারের এই উদ্যোগ দেখে আমরা কিছুটা বিচলিত। কারণ, ইন্টারনেট সেবা আমরা কিনে এনেছি বিদেশ থেকে টাকা ধার করে দেশের উন্নয়নের জন্যে। এখন নিজেরা ব্যবহার করতে পারছি না- এই অজুহাত দেখিয়ে ‘ফেলে রাখা’ ইন্টারনেট বিদেশে রফতানি করে দেয়া কতটা যুক্তিযুক্ত এ নিয়ে আমাদের চিন্তা করা দরকার। যারা আমাদের ইন্টারনেট সেবা সুবিধা নিয়ন্ত্রণ করেন তারাই ‘ফেলে রাখা’ বা ‘উদ্বৃত্ত’ শব্দ দুটি এ ক্ষেত্রে ব্যবহার করছেন। এরকম তুচ্ছ- তাচ্ছিল্য করে যারা কথা বলেন তাদের সম্পর্কে আমাদের ধারণা, তারা খুব নেতিবাচক টাইপের মানুষ, ইন্টারনেট সেবা দিয়ে এই দেশের কি কি ভাল কাজ সম্ভব তা বোঝার পর্যাপ্ত জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা তাদের নেই। যারা বলছেন আমাদের ইন্টারনেট ‘উদ্বৃত্ত’ হয়ে পড়েছে আর ‘দ্রুতই বিদেশে রফতানি করে দেয়া ভালো’, তারা সরকারকে ভুল বুঝিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে দিতে চাইছেন, যাতে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ রূপকল্প বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়। আমরা এই দুই শ্রেণীর মানুষের প্রতি আমাদের বিরক্তি প্রকাশ করছি। বাংলাদেশে ইন্টারনেট মোটেই উদ্বৃত্ত নেই। আমাদের যা চাহিদা তার সামান্য অংশ মাত্র আমাদের কাছে পৌঁছাতে পেরেছে। ইন্টারনেটের বিতরণ ব্যবস্থা যাদের হাতে তারাই আমাদের বাড়ি, শিক্ষাকেন্দ্র আর কর্মস্থলে সেই সেবা পৌঁছাতে টালবাহানা করছেন, সময়ক্ষেপণ করে প্রমাণ করতে চাইছেন দেশে কোন চাহিদা নেই, বিদেশে বিক্রি করে দেয়া ভাল! কেমন করে তারা এই কাজটা সুনিপুণভাবে ও সংগঠিত উপায়ে করছেন তার সামান্য কিছু উদাহরণ দিয়ে আমরা দেখাবার চেষ্টা করব আমাদের ইন্টারনেট চাহিদা কেমন আর এর সঙ্গে বিতরণ ব্যবস্থার অসঙ্গতির কারণে কীভাবে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নে। ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকল্পে কোন কৌশলগত বাস্তবায়ন নির্দেশনা না থাকায় সরকারী বিতরণ সংস্থা বিটিসিএল নিজেদের পুরনো হাস্যকর আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ইন্টারনেট সেবা সংযোগ দেয়া অব্যাহত রাখে। ব্রডব্যান্ডের (উচ্চগতির সংযোগ) ক্ষেত্রে প্রথমে আপনাকে একটা দরখাস্ত করতে হবে, সেই অনুযায়ী যাচাই-বাছাই করে ‘ডিমান্ড নোট’ দেবে। সেই কাগজ নিয়ে নির্ধারিত ব্যাংকে টাকা জমা দিলে বিটিসিএল সংযোগ দেবে। কিন্তু এর মধ্যে চলে যাবে অন্তত দুই মাস! তাও ঠিক আছে, কিন্তু সংযোগ পেতে হলে আপনার কর্মস্থল পর্যন্ত নিজ খরচে তার টেনে নিতে হবে বিটিসিএল একচেঞ্জ থেকে, তা যত কিলোমিটার দূরত্বই হোক! সঙ্গে আপনাকে কিনে দিতে হবে সংযোগের জন্যে প্রয়োজনীয় দুই পাশের আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি। সঙ্গে চলতে থাকবে তদ্বির! শেষে ঢাকা মগবাজার একচেঞ্জ থেকে আইপি নিতে বলবে। আবার দরখাস্ত, আবার ডিমান্ড নোট। আইপি পেলেন তো সংযোগ নেই, সংযোগ আছে তো আইপি ঠিক নেই; এরকম করে করে ন্যূনতম ছয় মাস আপনি ১ এমবি (বা বেশি) সংযোগ পেলেও পেতে পারেন। সহজে প্রাপ্য এমন একটি স্বল্পগতির (শেয়ারড) সেবা দিতে বিটিসিএল চালু করেছে এডিএসএল পদ্ধতি। আপনার বাড়িতে যদি বিটিসিএল ফোন থাকে তাহলে কোন তার না টেনেই একটি মডেম কিনে আপনি এই সংযোগ পেতে পারেন। কিন্তু এই সেবা দেয় একটি বেসরকারী কোম্পানি। সেখানেও ওই আবেদন, সঙ্গে নানা কাগজপত্র। লাইন চালু হলে মডেম কিনে নেবেন, বিল আসবে টেলিফোন বিলের সঙ্গে। সেবা পেতে মোট লাগবে ৭ থেকে ১৫ দিন (তা-ও নির্ভর করে আপনার ফোন লাইন ঠিক আছে কিনা, তার ওপর)। এই উভয় ক্ষেত্রে বিটিসিএল যে পরিমাণ সময়ক্ষেপণ ও গ্রাহকের কর্ম উদ্যোগ স্পৃহা নষ্ট করে তার উৎপাদন মূল্য কত? যে টাকা খরচ করার তা কি কথা ছিল? সরকার কর্জ করে যে টাকা দিয়ে সাবমেরিন সংযোগ সেবা এনেছে তার অনেক অংশ শোধ করেছে এই দেশের জনগণ। কিন্তু সেবা প্রাপ্তির অঙ্গীকার কোথায়? এখানে দুটি উদাহরণ দেয়া হলেও বিটিসিএলের সব ইন্টারনেট সেবার ক্ষেত্রে একই পরিস্থিতি। যঃঃঢ়://িি.িনঃপষ.হবঃ.নফ এই সাইটে গেলে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কিছু নমুনা দৃশ্যমান হবে। প্রশ্ন হলো, সেবা দানের জটিলতা নিরসন না করে, পদ্ধতিগত ত্রুটি অপসারণের উদ্যোগ না নিয়ে, দেশের বেশিরভাগ মানুষকে ইন্টারনেট প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করে আপনি এই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না যে আপনার কাছে পর্যাপ্ত ইন্টারনেট ‘উদ্বৃত্ত’ আছে যা রফতানিযোগ্য। আমাদের দেশে যে যে ক্ষেত্রে ইন্টারনেট সেবা আমাদের জীবনের চাকা ঘুরিয়ে দিতে পারে, তার কোন নির্দেশনা ‘ডিজিটাল বাংলাদেশের’ রূপকল্পে আমরা পাইনি। বিশেষ করে সেবা খাতে (স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ অন্যান্য পরিষেবা) উচ্চগতির ইন্টারনেট বিস্তৃত হওয়া প্রয়োজন ছিল, সুযোগও ছিল। দেখা গেছে বেশিরভাগই ইউনিয়ন তথ্য কেন্দ্রের নামে ইন্টারনেট সেবার কথা প্রচার করা হয়েছে যা কোনক্রমেই বেশিরভাগ মানুষের চাহিদা পূরণ করেনি। এসবের মাত্র কয়েকটি বিটিসিএলের সাময়িক সংযোগ পেয়েছে (ঝঞগ-১ গটঢ) যা ঘোষিত ৫০০০ ইউনিয়ন তথ্য কেন্দ্রের বা তদুর্ধ সংখ্যার তুলনায় খুবই সীমিত। বেশিরভাগ ইউনিয়ন তথ্য কেন্দ্র ব্যবহার করে মোবাইল ফোনের মডেম যা ব্যয়সাশ্রয়ী নয় ও খুবই স্বল্পগতির। শিক্ষাকেন্দ্রে মাল্টিমিডিয়া শ্রেণী ব্যবস্থাপনায় ইন্টারনেট অপরিহার্য অনুষঙ্গ। দেখা গেল, যে কটি পাইলট প্রকল্প হয়েছে সেখানে বিকল্প হিসেবে অফ লাইন শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে চিন্তা হচ্ছে। অথচ, সারা দেশের স্কুলও যদি টেলিফোনের সেবায় নিয়ে আসা যেত তাহলে এডিএসএল সংযোগ সেগুলোতে দেয়া যেত। তা না করে চিন্তা করা হলো কি করে মোবাইলের মডেম দিয়ে সেখানে ইন্টারনেট দেয়া যায়, যা তেমন কোন কাজে আসে না! বিটিসিএলের তথ্য অনুযায়ী তাদের ‘ইন্টারনেট ইনফর্মেশন নেটওয়ার্ক এক্সপানশন’ প্রকল্পের মাধ্যমে সারাদেশে ৪৬ জেলায় ৫৬ উপজেলায় ইন্টারনেট ও ব্রডব্যান্ড সেবা বিস্তৃত করা হয়েছে। তাহলে ব্রডব্যান্ড সেবা বা উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবা থেকে বেশিরভাগ অঞ্চল বঞ্চিত কেন? উপজেলা স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রগুলোয় দেখা গেল সরকার মোবাইল ফোন দিয়েছে যাকে ‘টেলিমেডিসিন’ সেবা বলে প্রচার করা হলো। অথচ অতি নিকটে থাকা সত্ত্বেও আমরা একচেঞ্জ থেকে এই কেন্দ্রগুলোয় ফোন সুবিধা নিয়ে ইন্টারনেট সেবাসহ জররী স্বাস্থ্য সেবা, রোগের তথ্য-উপাত্ত ভিত্তি তৈরি করে জাতীয় স্বাস্থ্য ডাটাবেজ/নেটওয়ার্ক করে নিতে পারতাম। ইন্টারনেটভিত্তিক রিমোট স্বাস্থ্য সেবার ব্যবস্থা করে খুব সহজে বড় ডাক্তারদের পরামর্শ গ্রাম পর্যায়ে বিস্তৃত করে নিতে পারতাম। স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মসূচী অতি স্বল্পমূল্যে গ্রামে গ্রামে সম্প্রসারণ করে নিতে পারতাম। বিটিসিএল বলছে সারা দেশে ইতোমধ্যে প্রায় ৫০০০ কিলোমিটারের মতো অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবল বিস্তৃত হয়েছে, আইপিভিত্তিক সেবা দেয়ার জন্যে ৪২ জেলার দেড় শতাধিক নোডে মোট ৪৬০০০ ক্ষমতাসম্পন্ন এডিএসএল এক্সেস নেটওয়ার্ক তৈরি করা হয়েছে। তাহলে সেবা সম্প্রসারণের ফল গ্রাহক পাচ্ছে না কেন? ২০১২ সালের জুন পর্যন্ত তথ্য অনুযায়ী সারা দেশে বিটিসিএলের ৭৪৭টি এক্সচেঞ্জের (৬৪ জেলার) প্রত্যেকটিতে অপটিক্যাল ফাইবার সংযুক্ত আছে। সারা দেশে টেলিফোনের সংযোগ ক্ষমতা ১৪ লাখের মতো হলেও তার ৬৫% ব্যবহৃত হচ্ছে। এই ৬৫ ভাগের অর্ধেকও যদি এডিএসএল সংযোগ পেতে পারে তাতেও ৪ থেকে ৫ লাখ সংযোগের চাহিদা রয়েছে। আমরা জানি না দেশব্যাপী ইন্টারনেট সেবার চাহিদা নিরূপণে কোন উদ্যোগ কখনও নেয়া হয়েছে কি-না। তাই সরকার বাহাদুরের কাছে আকুল আবেদন, আমাদের দেশের জন্যে ইন্টারনেট বিস্তৃতির যে অবকাঠামো ইতোমধ্যেই তৈরি হয়ে আছে তার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করে দেশব্যাপী এই সেবা সম্প্রসারণকরণ। ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক উভয় পর্যায়ে স্বল্পমূল্যে এই সেবার পরিধি বাড়ানো দরকার। দুনিয়া এখন তারবিহীন জগতে প্রবেশ করেছে (এমনকি মোবাইল ফোনের ইন্টারনেট সেবায়ও এখন ৪জি পেরিয়ে এলটিই সম্প্রসারণের কাজ চলছে)। বিটিসিএলের যে প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতা তার সক্ষম ব্যবহার জরুরী। দেশের সর্বত্র যখন ইন্টারনেট সেবা বিকশিত হবে তার সঙ্গে বিকশিত হবে তরুণ সমাজের উদ্ভাবন যা আমরা শহরে বসে ভাবতে পারি না বা ভাবতে চাই না। আমাদের সারা দেশে যেহেতু অবকাঠামো তৈরি করাই আছে সে ক্ষেত্রে দরকার একটি বাস্তবসম্মত গ্রামমুখী ইন্টারনেট বিতরণ নীতি। এই মুহূর্তে নতুন বিনিয়োগ না বাড়িয়েও আমাদের নিজেদের কাছে গচ্ছিত রাখা ইন্টারনেট আমরা নিজেদের জন্যে ব্যবহার করে একুশ শতকের নতুন বিশ্বভুবনে ঠাঁই করে নিতে পারি। লেখক : পরিচালক, আমাদের গ্রাম উন্নয়নের জন্যে তথ্যপ্রযুক্তি প্রকল্প
×