ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

মাহমুদুল হাসান

গল্প ॥ স্মৃতি

প্রকাশিত: ০৪:০০, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

গল্প ॥ স্মৃতি

‘মামা, তোমার সবচেয়ে দামী জিনিস কোনটা?’ প্রশ্নটা করে একটু ঘাড় বাঁকিয়ে চোখগুলো ছোট ছোট করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল দীপ্র। ওর বয়স পাঁচ। সম্পর্কে আমার ভাগ্নে। সারাদিন ছোটাছুটি আর দাপাদাপির চেয়েও ওর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর শক্তির পরিচয় পাওয়া যায় এসব বিচিত্র গভীর ও গম্ভীর প্রশ্নের নমুনায়। অন্য কোন শিশু হলে যতটা সহজে উত্তর দিতে পারতাম, দীপ্রর বেলায় ব্যাপারটা অত সহজ হবে না। যদি খেলনা কিংবা বস্তুগত কোন জিনিসের নাম বলি, তবে ও সেটাকে এমনভাবে ব্যবচ্ছেদ করতে শুরু করবে যে আমি মানতে বাধ্য হব এটা মোটেও কোন দামী জিনিস নয় বরং এর চেয়েও হাজারো দামী জিনিস আছে আমার জীবনে। দীপ্রকে আমরা আমাদের পরিবারের ভবিষ্যত সক্রেটিস হিসেবে মেনে নিয়েছি বহুদিন আগেই। সুতরাং, আমি ভাবতে বসলাম আমার জীবনে সবচেয়ে দামী জিনিস কি? হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের ইতিহাসের যে গল্প আমরা জেনে এসেছি, তাতে একটা বিষয় পরিষ্কার যে বস্তুগত কোন বিষয় মানুষের জীবনে দামী কিছু হয়ে উঠতে পারে না। সংঘবদ্ধ হয়ে ওঠার সময় থেকে শুরু করে শত শত সভ্যতার সৃষ্টি এবং ধ্বংসের গল্প ইতিহাসের বইয়ের স্বাস্থ্য হৃষ্টপুষ্ট করে। আমরা দেখি বিভিন্ন সময়ে মানুষের মনোযোগের প্রাধান্য পায় যা কিছু তার প্রায় সবই বস্তুকেন্দ্র্রিক। আমরা দেখি কি করে মানুষ কিছু ঠুনকো জিনিসকে দামী ভাবে আর তার জন্য সারাজীবনের মহা মূল্যবান সময় অপচয় করে। সবচেয়ে দামী বলে কিছু কি আছে? দামীর চেয়েও দামী অনেক কিছু বেরিয়ে যায়। এর সুপারলেটিভ কখনও হয় না। এত সব ভাবতে ভাবতে হঠাত চুলে টান পড়তে সম্বিৎ ফিরে পেলাম। দীপ্রর চোখমুখ কুচকে আছে। আমি বললাম, ‘বাপজান, আমাকে একটু সময় দাও। এত কঠিন প্রশ্ন, আমায় একটু ভেবে উত্তর দিতে হবে।’ ফোকলা দাঁত নিয়ে ফসকে যাওয়া উচ্চারণে দীপ্র যা বলল তাঁর অর্থ করলে দাঁড়ায়, আমার হাতে সময় আছে দশ মিনিট। আমি আবার ভাবতে বসলাম। ভাবতে ভাবতে মুভির ফ্ল্যাশব্যাকের মতো আমার চোখের সামনে আসতে থাকল সেই ছোটবেলা থেকে ছোট বড় হাজারো জিনিস। হাজারো বিষয়। হাজারো মানুষ। সাঁই সাঁই করে একটা একটা বস্তু, জায়গা, মানুষের মুখ চলে যেতে থাকল চোখের সামনে দিয়ে। ভাল লাগছিল খুব। এই সুযোগে কত পুরনো, বাতিল, আপাত ঠুনকো জিনিস যা আমার জীবনে কত বড় দাগ রেখে গেছে তা দেখছিলাম। কত মানুষ, তাদের কত কার্যকলাপ, কত ঘটনা মনে আসছিল। কখনও চোখ ভিজে যাচ্ছিল, কখনও বোকার মতো হেসে ফেলছিলাম। হাসি-কান্নার মাঝে মাঝে কিছু বিষয় আমাকে থমকে দিচ্ছিল। আবার চলছিল মুভি ফ্ল্যাশব্যাক। হারানো সুর, গান, কথা আপ্লুত করছিল। কারও কারও কণ্ঠ ঝড় তুলছিল। কারও কারও হাসির আওয়াজ খুব মনে পড়ে যাচ্ছিল। হঠাত হঠাত গন্ধ পাচ্ছিলাম। না, শুধু লম্বা চুলের গন্ধ নয়, সব রকম গন্ধ। পাট পচা প্রাচীন গন্ধ, খড়ের স্তূপে আগুনের ধোয়া ধোয়া শীতের গন্ধ, গোবর আর গরুর শরীরের গোয়াল গন্ধ, মাড় দেয়া মা’র শাড়ির তীব্র রোদে শুকানোর পর ভাঁজ করা মায়ার গন্ধ, ছোট ভাইটার গায়ের আদর আদর গন্ধ, জাম্বুরা ফুলের উচ্ছল গন্ধ, স্কুলের মাঠের ঘাসের গন্ধ... হাজারো গন্ধে আমার নাকের ফুটোতে জ্বালা ধরে গেল। আমি অস্থির হয়ে উঠলাম। আমার সারা অস্তিত্বজুড়ে হাজার হাজার নাক প্রাণভরে একসঙ্গে নিঃশ্বাস নিতে থাকল। আমি হা করে সব গন্ধের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে অক্সিজেনের জন্য হাঁসফাঁস করতে থাকলাম। হঠাত গন্ধগুলো সব চলে গেল। আমি ভোঁতা নাকে বুক ভর্তি অক্সিজেন নিয়ে খুব ফাঁকা অনুভব করতে লাগলাম। আমার খুব কান্না পেতে লাগল। আলতো একটা স্পর্শে এবার আবার নতুন যন্ত্রণা শুরু হলো। ছোট, নরম একটা মেয়ে শিশুর হাত আমার গালে। সেই কবে গ্রামের দূরের কোন এক আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়ে খুব আদর করে কোলে নিয়েছিলাম এই শিশুটিকে। সে আমার গাল ছুঁয়ে দিয়েছিল। আহ, এরপর ঘুসি টের পেলাম স্পষ্ট। স্কুলের মাঠে খেলতে খেলতে বন্ধুর সঙ্গে মারামারি-হাতাহাতি, ভেজা রক্তের স্বাদ জিবে যেন টের পেলাম। স্পর্শগুলো আসতেই থাকল। এলোমেলো আলত আলত ছুটে যেতে থাকল। চুলের ভেতর মায়ের আঙ্গুল, পিঠে বাবার হাত, বুকের ভেতর ভাইয়ের বুক... স্পর্শ... চুম্বন, স্খলন, মিলন... প্রথম এবং আরও অনেক পরের আরও অনেক কিছু কিংবা হয়ত প্রায় সব... ধীরে ধীরে উদ্দাম যন্ত্র সঙ্গীতের ঊর্ধমুখী লয়ের মতো এসব যন্ত্রণা বাড়তে লাগল। আমার চোখের সামনে হাজারো মুখ আর দৃশ্য, জিভে হাজারো স্বাদের ছোটাছুটি, নাকে হাজারো গন্ধের জ্বালা, কানে আসছে গান সুর আর চেনা অচেনা, ভাললাগা না লাগার হাজারো সস্তা বা ভারি কথা... ডাক, আহ্বান, ধমক, হুঙ্কার, অভিশাপ, আশীর্বাদ, আদর... শরীরের চামড়ার প্রতি ইঞ্চিতে ভিজে যাচ্ছে সেই সব স্পর্শে... আমার সারা দেহ, মন ঝনঝন করতে লাগল। আমার সকল ইন্দ্রীয় একসঙ্গে পাগল হয়ে উঠেছে। সব একসঙ্গে চীৎকার করে পাল্লা দিয়ে স্মৃতি রোমন্থন করছে। আমাকে ভয়ঙ্কর যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমি ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলছি। আমি মুক্তির আশায় হাঁপাচ্ছি। আমার সকল ইন্দ্রিয়ের স্মৃতি চিপে ধরেছে বোবায় ধরার মতো। না চাইলেও আমায় এর স্বাদ, গন্ধ, বর্ণ সব নিতে হচ্ছে। আমি তাল হারিয়ে ফেলছি। আমি চীৎকার করে উঠি সর্ব শক্তিতে। তারপর হঠাত... অন্ধকার হয়ে সব থেমে গেল। সব থেমে গেছে, সবাই হারিয়ে গেছে। সবাই চলে গেছে। সব গেছে,সব। কিছু নেই এখন। মহাশূন্যের চেয়েও শূন্য আমি এখন। আমি ফাঁকা, আমি ফাঁপা, আমি কেউ নই। আমি কিছু নই আর... ও’স হড়ঃযরহম, ও’স ধ নরম নরম হড়ঃযরহম হড়.ি.. আমি কি মরে গেছি? আমি কি শেষ হয়ে গেছি? আমি কিছুই টের পাচ্ছি না। আমার চোখ, নাক, জিভ, কান, হাত-পা নেই। কিছুই নেই। আমি কোথাও নেই। কিছুই নেই চারপাশে। চারপাশ বলেও আর কিছু নেই এখন। ওহ! এটা কি হচ্ছে? কি হচ্ছে আমার সঙ্গে? আমার চীৎকার আসে না, কারণ আমার কণ্ঠ নেই। আমি হাতড়াই কিন্তু কিছু ধরতে পারি না, কারণ আমার হাত নেই। আমি দেখতে পাই না, শুনতে পাই না। আমি নেই, আমার কিছুই নেই। নেই... নেই... শুধু নেই... আহ! কি কষ্ট। কি কষ্ট হচ্ছে আমার... না থাকার কষ্ট, নাই হয়ে যাওয়ার কষ্ট... আহ, চুলে-কপালে জলের স্পর্শ পেলাম। শান্তি কি একেই বলে? চোখ খুলতে পারলাম। দেখতে পাচ্ছি। আহ, এই সুদর শিশুটি কে? দীপ্র? ওর নরম গাল ছুঁয়ে দিলাম। বিছানায় উঠে বসে দেখলাম জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট আসছে। দীপ্র বিজ্ঞের মত হাত-পা গুটিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ‘কিরে বৃষ্টি এল, জানালাটা লাগাবি না?’ দীপ্র উত্তর দেয়ার প্রয়োজন মনে করল না। বরং ঘড়ি দেখিয়ে জানালো আমি প্রায় আধা ঘণ্টা ঘুমিয়েছি, আর আমার প্রশ্নের উত্তর দেয়ার সময় অনেক আগেই পেরিয়ে গেছে। হাসতে গিয়েও হাসলাম না। ওকে কোলে বসিয়ে ওর গালে একটা চুমু দিয়ে বললাম, ‘আমার জীবনের সবচেয়ে দামী জিনিস হচ্ছে, আমার স্মৃতি।’ দীপ্রর কুঁচকানো চোখ আর কপাল সমান হলো। মুচকি হেসে চোস্ত ইংরেজী উচ্চারণে বলল, ‘ণবং, ও শহবি রঃ’ একদৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে সে চীৎকার করতে লাগল, ‘মামী, মামি, মামা রিয়েলি লাভস ইউ...।’ বুঝতে পারলাম দীপ্র চমৎকার মিলিয়েছে... ও আচ্ছা, বলতে ভুলে গিয়েছি আমার স্ত্রীর নামও ‘স্মৃতি’। অনেকদিন পর আনন্দে হাসলাম আর খুব তৃপ্তি নিয়ে জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখতে দেখতে ভিজে যেতে থাকলাম।
×