ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

অভিমত ॥ বিশ্ব ইতিহাসে ইতিবাচক পরিবর্তন

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ২৮ জানুয়ারি ২০১৮

অভিমত ॥ বিশ্ব ইতিহাসে ইতিবাচক পরিবর্তন

মিয়ানমার রাষ্ট্রটি (পূর্বে বার্মা হিসেবে পরিচিত) বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থিত একটি প্রতিবেশী রাষ্ট্র। নাগরিকদের অধিকাংশই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। সেখানে মুসলিম ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীরও বসবাস। যারা রোহিঙ্গা গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত। রোহিঙ্গাদের ঐতিহাসিকভাবে আরাকানীয় ভারতীয় বলা হয়ে থাকে। এরা পশ্চিম মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের একটি ইন্দো-আরিয়ান জনগোষ্ঠী। ২০১৬-১৭ সালের আগস্ট মাসে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন অভিযান শুরুর পূর্বে আনুমানিক সেখানে ১ থেকে ১.৩ মিলিয়ন রোহিঙ্গা বসবাস করত। অধিকাংশ রোহিঙ্গা ইসলাম ধর্মের অনুসারী হলেও কিছু সংখ্যক হিন্দু ধর্মের অনুসারীও রয়েছে। ২০১৩ সালে জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের বিশ্বের অন্যতম নিগৃহীত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী হিসেবে উল্লেখ করেছে। ১৯৮২ সালের বার্মিজ নাগরিকত্ব আইন অনুসারে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করা হয়েছে। ৮ম শতাব্দী পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের ইতিহাস সন্ধান পাওয়া সত্ত্বেও বার্মার আইনে এই সংখ্যালঘু নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীকে তাদের জাতীয় নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের আন্দোলনের স্বাধীনতা, রাষ্ট্রীয় শিক্ষা ও সরকারী চাকরিসহ বিভিন্ন নাগরিক সুবিধা হতে বঞ্চিত করা হয়েছে। জাতিসংঘ ও ঐঁসধহ জরমযঃং ডধঃপয মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো দমন ও নির্যাতনকে জাতিগত নির্মূল হিসেবে আখ্যা দিয়েছে এবং আশঙ্কা করছে সেখানে গণহত্যার মতো অপরাধের তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যেতে পারে। অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের মতে, তারা পশ্চিম মিয়ানমারে অনেক আগে থেকে বসবাস করে আসছে। তাদের বংশধররা প্রাক-ঔপনিবেশিক ও ঔপনিবেশিক আমল থেকে আরাকানের বাসিন্দা ছিল। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে মিয়ানমার সরকারের মনোভাব হঠাৎ বদলে যায়। তারা মনে করে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী। ২০১৬-১৭ সালের আগস্ট মাসে সামরিক বাহিনী কর্তৃক অভিযান শুরু করলে মিয়ানমারের সামরিক ও বেসামরিক বাহিনীর অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন, হত্যা-জখম ও লুটপাটে বিভিন্ন পর্যায়ে প্রায় দশ লাখের অধিক রোহিঙ্গা মিয়ানমার সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করে। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত ঈষবৎধহপব ঙঢ়বৎধঃরড়হ-এ প্রায় ৪ থেকে ৫ হাজার রোহিঙ্গা নিহত হয়। হাজার হাজার রোহিঙ্গা আহত হয়। অনেকের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়। অধিকাংশ নারী ধর্ষণের শিকার হয়। সারা বিশ্বের বিবেকবান মানুষ যখন এই নির্যাতনকে সভ্য জগতের অসভ্য ও বর্বর কর্মকা- হিসেবে আখ্যা দিচ্ছে, তখনও মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ কোন ভ্রƒক্ষেপ করছে না। অথচ মিয়ানমারের বেসামরিক নেতৃত্ব আউং সান সুচিকে বিশ্ব শান্তির দূত হিসেবে ১৯৯১ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। সারা পৃথিবীতে প্রতিবছর শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করার জন্য বা বিশ্ব শান্তি স্থাপনে ভূমিকা রাখার জন্য নোবেল কমিটি কর্তৃক অনন্য এ সম্মানজনক পুরস্কার প্রদান করা হয়। অদ্যাবধি এ শান্তি পুরস্কারকে বিশ্ববাসী মর্যাদার চোখে দেখে থাকে। প্রথমত : নোবেল কমিটি কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করার পর সেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি সামগ্রিকভাবে বিশ্ব শান্তির পরিবর্তে বিশ্ব নাগরিকের অশান্তি বা দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়ায় তখন সে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নোবেল শান্তি-পুরস্কার ফিরিয়ে নেয়ার কোন ব্যবস্থা করা যায় কি না? মিয়ানমারের বেসামরিক নেতা আউং সান সুচি ১৯৯১ সালে গৃহবন্দী অবস্থায় নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন। নোবেল কমিটি আউং সান সুচিকে নোবেল দেয়ার পেছনে যে তিনটি কারণ উল্লেখ করেন তা হচ্ছে : ক. গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য তার অহিংস সংগ্রাম; খ. নিপীড়নের বিরুদ্ধে একজন আদর্শ; এবং গ. গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও জাতিগত শান্তি বজায় রাখায় তার শান্তিপূর্ণ সমর্থন ও অবিরত প্রচেষ্টার জন্য। অথচ ২০১৭ সালের আগস্ট হতে রোহিঙ্গাদের ওপর পরিচালিত ইতিহাসের নির্মম, জঘন্য ও বর্বরতম এ অভিযান বিশ্ব শান্তির অগ্রদূত হিসেবে বিবেচিত আউং সান সুচির সারা জীবনের শান্তির জন্য সংগ্রামকে আজ বিশ্ববাসীর কাছে প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে। মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত দমন-পীড়ন-নির্যাতন, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, ঘর-বাড়িতে আগুন, নির্বিচারে হত্যা, মৃত্যুর হুমকির দিয়ে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করার মাধ্যমে বিশ্ব মানবাধিকার আজ ভূলুণ্ঠিত। লাখ লাখ রোহিঙ্গা প্রাণের ভয়ে ভিটেমাটি ছেড়ে নিরাপদ জীবনের জন্য নৌকায় চড়ে নাফ নদী, বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার টেকনাফ ও উখিয়ার শরণার্থী শিবিরগুলোতে আশ্রয় নিচ্ছে। এ রকম একটি ভয়াবহ জাতিগোষ্ঠী নির্মূলের হত্যাযজ্ঞ পরিচালনার পর আউং সান সুচির নোবেল শান্তি পুরস্কার বাতিলের বিষয়টি নোবেল কমিটির বিবেচনা করা উচিত। অন্যথায় বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় প্রদত্ত নোবেল শান্তি পুরস্কার বিশ্ববাসীর কাছে সঠিকভাবে মূল্যায়িত হবে না। দ্বিতীয়ত : ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই ছোট বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। বিশাল জনসংখ্যার এ দেশকে যখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার নিরলস চেষ্টা, সততা ও আন্তরিকতা দিয়ে পরিচালনা করে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত রাষ্ট্রের মর্যাদায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা তার সততা, দৃঢ়তা, একনিষ্ঠতা, মানবাধিকারের প্রতি সম্মান, মানুষের দুঃখ-কষ্টে পাশে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে প্রায় দশ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশের ভূখ-ে আশ্রয় দিয়েছে। সারাবিশ্ব আজ তার সাহসিকতা এবং নেতৃত্ব গুণের প্রশংসায় মুগ্ধ। তিনি দশ লাখ রোহিঙ্গা শুধু আশ্রয়ই দেননি বরং এই ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বি¡ক জাতি গোষ্ঠীকে পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকার ব্যবস্থা গ্রহণ করে বিশ্ব ইতিহাসে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছেন। বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে একটি নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীকে রক্ষায় এ অনন্য ভূমিকা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বলতে বাধা নেই বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন সময় এর চেয়েও অনেক বেশি শরণার্থীদের যুদ্ধকালীন বা দুর্যোগকালীন সময় আশ্রয় দিয়েছে। যেমনÑ ভারত সরকার ১৯৭১ সালে প্রায় ১ কোটি বাঙালীকে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় দিয়েছিল। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে এ রকম কোন বিষয় ছিল না। বিশ্ব মানবাধিকার রক্ষায়, সকল জাতি গোষ্ঠীর অধিকার রক্ষায়, গণতন্ত্র রক্ষায় মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘবের মাধ্যমে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনন্য ভূমিকা রেখে চলেছে। লেখক : সিনিয়র সহকারী সচিব
×