সদা বহমান স্বচ্ছ নদীর ছোট ছোট ঢেউয়ের মতো ছোট ছোট ধ্রুপদী শব্দ কুড়িয়ে আনি। তারপর অলীক রঙের আবির মেশানো বর্ণিল আলতার বাটিতে তাদের চুবিয়ে নেই। বর্ণ চিরস্থায়ী হলে একটার পিঠে আরেকটা লাগিয়ে মালা গাঁথি। মূলত এভাবেই আমার কবিতাগুলো অম্লান আলো দেখতে পায়। ভূ-লোক দ্যু-লোক থেকে কুড়িয়ে আনি স্বপ্নময় চেতনা, উৎকর্ষ উপাদান, উপমা। শব্দদের সঙ্গে উপমাদের বিয়ে দেই। পরস্পরের সংসার একটা বাক্য হয়ে একক পরিবার গঠন করে। এ রকম বেশ কয়েকটি পরিবারে একটা মহল্লার মতো হয়। মহল্লাটি একটা কবিতা। আমি থেমে থেমে, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে, কখনও বা ত্বরিত গতিতে আমার রচিত গুচ্ছস্তবক মহল্লাগুলোতে ঘুরে আসি। ঘুরে আসতে হয়। কখনও কারও সংসার ভাল টিকছে না দেখলে (কোন শব্দের সঙ্গে কোন উপমার সম্পর্ক শ্রেয় না ঠেকলে) সেই সংসার ভেঙে দেই। নতুন বিয়েতে ভরিয়ে তুলি আরেক সংসার। এভাবেই ক্রমাগত বহু বাক্যে (সংসারে) গড়ে উঠে একেকটা কবিতা।
কবিতাদের সঙ্গে নিভৃতে আমার একান্ত কথা হয়। তাদের কখনও পুরনো বইয়ের ভেজা পাতা থেকে রোদে এনে শুকোতে দিতে হয়, কখনও আবার অশান্ত উদ্দীপ্ত হয়ে উঠলে আলতো আদরে ঘুম পাড়িয়ে দিতে হয়। এভাবেই কেটে যায় কবিতাদের জীবনযাপন। নতুন কবিতা আসে নতুন রূপক নিয়ে। পুরনোরা তখন বৃদ্ধ হয়ে প্রাজ্ঞ হয়, পাকাপোক্ত হয়। নতুনেরা হয় তার চেয়েও দুরন্ত। হয়ত আরও বহুদিন পরে আমার লেখা নতুন কবিতাগুলো রং বদলাবে, বিন্যাস বদলাবে, বদলিয়ে ফেলবে নিজেদের গতিপথ। সহ¯্র পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও বিরাজমান ধ্রুবসত্য এই যে, আমি তাদের একক জনক। তারা সব আমার সৃষ্ট এ্যান্ড্রোমিডা, হারকিউলিস অথবা সপ্তর্ষি (নক্ষত্র)। প্রশস্ত মহাবিশ্বের বুকে বহুবচনের এক বিশেষণ।
** জীবন
একদিন চৌকাঠের ওপর হঠাৎ করেই
উদ্ভূত হবে শ্মশান, যাকে পোড়াতেন তিনি
তাকে বহুযতœী পুতুলের খোলসে রেখেছেন এখন
যিনি ভষ্মপর্ব দেখে যাবেন, তার জন্য দামী চন্দন
উল্লিখিত ঝরাপাতার লেনে বিবস্ত্র দাঁড়িয়ে
সেই যে সন্ধ্যাকালীন মন্ত্র জপছি
এখনো দেখতে পাইনি সুসংগত কোনো জীবন
যাকে সহজেই পরখ করে মেনে চলা যায়
যেইসব দিন রৌদ্রের বুকে মুখ লুকোতে গিয়ে
কেটে গেছে; যেইসব কৈশোরে উন্মুক্ত ঘুড়ির মতো
দিব্যি চলেছি পাহাড়িয়া জুমে হেঁটে
ফসলি মাঠের পরে জন্মানো ঘাস আর মাঝিদের
চির আবাসনে দেখেছি যখনি পহেলা মৃত্যুভয়,
থমকে গেছে বোধহীন অন্ধসুরের তান
এক-কপাল সিঁদুর শুকিয়ে ঝরে পড়েছে রান্নায়
লাল মরিচের মতো; তখনো দেখি জীবন
কেবল গড়িয়েই চলেছে ঘাতক জল¯্রােতে
মিশে গেছে তার ওপর জলের শ্মশান, দীঘল সন্ধ্যায়
** প্রহসন
রোদ-হুক-অলা ব্লাউজের বোতাম খুলে ফেলেছে দস্যি মেঘ
কন্যার প্রতিবাদ সৌরদেবের কাছে সক্রোধে তাই,
দ- চাই কালোমেঘার- অবশেষে
আমার রোদ্দুরপনার বিলুপ্তি হলো...!
যতক্ষণ না সুবিচার, ততক্ষণ উন্মুক্ত থাকবে বুক
প্রতিজ্ঞা করলো-
ওদিকে সভাস্থ হয়েছে নথিপত্র, বিচারকার্য শুরু হলো
প্রস্তুত উকিল- আসামিপক্ষের
জেরা করার নামে বারদুয়েক মুক্তবক্ষ দেখে নিলো সে
জোছনার মতো শাদা- ফকফকে
কন্যার বিপক্ষে শক্ত অবস্থান, উভয়স্থানে
নামতেই হবে সেহেতু বৃষ্টি, অমোঘ বর্ষণ-
যেহেতু কন্যার কোনো উকিল জুটল না, সাফাই গায় এমন
সুতরাং দস্যি মেঘেরি জয় নিশ্চিত-
বিচারালয় বন্ধ হলে তখন সূর্যের বুকে মুখ লুকোলো
হাত-পা ছুড়ে প্রতিবাদ, কলুষে ভরাট দেবতারাও-
ন্যায়বিচার অপ্রাপ্য, এখন আমার সহায় কি হলো!
যার সখ্যয় পড়েছি এই রঙিন ব্লাউজ,
রোদ-হুক-অলা বোতামে শুভ্র জোছনার মতো তার অধিকার
সব নস্যাৎ হলো- কালোমেঘাই রায় পেল...
তখন মৌসুম বর্ষার, অজ¯্র অপঘাতের-
কন্যার খোলা বুক কাঁপে সখার তরে, যেন সে
দেখেছে সবইÑ দোষটা তারই
দ-দাতার বিচারে ভুগতে হয়, নির্জলা রোদেদেরই
** বেড নাম্বার ০৯
মাত্র দেখতে শেখা উৎফুল্ল আইরিসের ভেতরের কথাগুলো আরো গোপন হচ্ছে
অচেতন রোগীর বাম অ্যাওর্টা থেকে গড়িয়ে পড়ছে মঙ্গলকামী পরিজনদের আয়ু
প্রশ্বাসের ব্যারোমিটার ভুলভাল জানিয়ে দিচ্ছে আসন্ন করুণ সময়ের মাত্রা
ব্যবহারবহুল খালি থালায় শুকনো পড়ে আছে বাসি হৃৎপি-
স্পর্শজাতক দ্রব্য হয়ে স্মৃতিপট থেকে খসে পড়ছেসমূহ দিনের কথা, ছেড়ে যাচ্ছে বিমুখ সকাল
অন্তর্মুখী ব্যতিচারগুলো সাদা রক্তের সাথে ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে পড়ছে... লাল ব্যাডশিটে
** ধূমায়িত শূন্যের প্রতি নিবেদন
আদৌ কি বিপুল সমাগমে মুখরিত জনাকীর্ণ প্রান্তর?
পথবহুল জীবনে কি স্বপ্নচ্ছটা ফুরিয়ে যায় এক সময়?
ভিখিরি রোদ্দুর কি খুঁজে ফেরে নিভৃতচারী ছায়ার আবাস?
এইসব দার্শনিক প্রশ্নঘোরে বৎ হয়ে আছি পুরাকাল থেকেই
নতুন কবিতা লিখছি-
নিয়মের বাইরে যতগুলো প্রসন্ন সৌন্দর্য আছে;
তাদের মেলাবার চেষ্টা করছি এক মোহনায়, এক উত্তরে
বৈপরীত্য পাখিদের আলাপ শুনে একদিন মানুষ ভেবেছিল
মানুষেরও পাখনা আছে, হাজার পালকের সমষ্টির উড়াল
জেনেছিল ‘আকাশ’ হলো কবিদের কাব্যচর্চার প্রধান উপাদান
আর পাখি হবার প্রবণতা; তা হলো ব্যাপক স্বপ্নঘোর
জেনেছে মানুষ নিজেই অতঃপর-
নিঃসঙ্গ হওয়ার একমাত্র উপাদান কোলাহল
জীবনের চাইতে স্বপ্ন অতিমাত্রায় ছোট এক বিম্বস্বরূপ
এবং আলোময়ী পুরুষও নিভৃতে খোঁজে স্ত্রীর স্নেহমমতা...।
ওদিকে রূপসা নদীর বুকে জেগেছে আকাশমুখী আয়না
নতুন কবিতা লেখা হয়ে গেছে দ্যাখো মেঘলা কাগজীপাতায়
** স্মৃতিবচন
বিমল হারপুনে বাঁধা ধোঁয়াশা স্মৃতি খোলাসা হৃদয়
ক্ষুদে নোঙর লজ্জাবতীর মতো অস্তমন
গুটিয়ে নেয় ক্ষীণ পরিধিতে;
আজই আবার উত্থানের বচন গেয়ে যায়,
সেধে এসে শুনিয়ে যায় আকাশদস্যু মেঘগায়ক
ভেলায় চড়ে জাগিয়ে তুলে জল, অবিচল চরাচর
দর্পণতলশীর্ষে জাগে আর্তনাদের সান্নিধ্য
ফেয়ারওয়েল নৌযাত্রা, বছর পঞ্চাশেক আগেও এভাবে
উথলে ওঠে গুম হওয়া লাশের চোখে ঘুম
বিকট মৌন চিৎকার কোনো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র
সমাধানহীন বাষ্পপাপের সাথে নিরানন্দ দেহসহিত
অনাগত চৈত্রে মিলিয়ে যায়
** মহীরুহ বন্দনা
শৈশবী বিকেল,
ছনের গায়ে লেপ্টে থাকা হরিদ্রাবর্ণী ত্বক
আঁতুড়ঘরের সন্নিবদ্ধ অন্তর্দাহে বিমল হয়ে যাচ্ছে-
সদ্যগজানো গুল্মের আকারে ফেটে পড়ছে হিম-বসন
অন্যথাচারী দুঃস্বপ্নগুলো বালুলাগা মাটি থেকে
খুঁটে খাচ্ছে জলীয় শব্দের প্রপাত-
ব্যাকুলস্বভাবী পৌরুষ কান্নাগুলো হেলেদুলে মিলিয়ে যাচ্ছে
ছায়াহীন প্রকট গহ্বরে-
মহীরুহবন্দনা শেষে পৌষের বাঁটে মুখ রেখেছে সঙ্গীহীন রাত্রিনর
সহজিয়া তুষারে আমূল চোখ খুলেছে বহুল প্রত্যাশী
নীল প্রসূনÑ
আহ্লাদী মহুয়া বন গুল্মহীন পড়ে আছে নিসাড় অরণ্যে
অলক মীরা কিংবা নীলক সুদীপ্তা
ক্রমাগত ব্যস্ত জনজীবনের দিকে চোখ ফেরাতে ফেরাতে
ঘুমের ব্যথা ভুলে যায় নীলক
‘অলক তার দাদার মতো নির্লিপ্ত হয় না কেন?’
-প্রশ্ন করে মীরা
তাই বলে অলস গা ছেড়ে উদোমে ঘুরে বেড়ালে
মানুষ তো খারাপ বলবেই...
অথবা যদি ইচ্ছাকৃতই না রাখে যোগাযোগ!
কষ্ট হলেও ভাববে- এ সে-ই যে দারুণ মহাপুরুষ!
জর্জেটের ওড়নায় অশ্রুমোছা মীরার শেষ বাক্য ইতি টানে
নীলক জানে না সুদীপ্তা এখন কার ঘরে চিরবন্দী!
অলকের চোখেমুখে চিন্তার মসৃণ রেখা- গাঢ় হয় শুধু