ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

আক্তারুজ্জামান সিনবাদ

কাঠের আঁচড়ে বঙ্গবন্ধু

প্রকাশিত: ০৭:০৭, ১৯ জানুয়ারি ২০১৮

কাঠের আঁচড়ে বঙ্গবন্ধু

সময়ের দায়বদ্ধতার ও সমসাময়িক আদিখ্যেতা এড়িয়ে শিল্পযান এগিয়ে যায় দক্ষ শিল্পীর কর্তৃত্বে। শিল্পী তার কর্মের বলিষ্ঠতা দ্বারা উন্মোচন করেন এর অনন্য অধ্যায় এবং উপস্থাপন করেন তার অবলোকিত সমাজকে। শিল্পের রয়েছে ঐতিহাসিক এবং অতীতের দায়বদ্ধতা, যার পরতে পরতে ফুটে উঠে জাতির ইতিহাসের নীলনক্সা। তেমনি একজন শিল্পীই পারে ইতিহাসের একজন মুখপাত্র হয়ে ঐতিহাসিক অধ্যায়ের প্রভাতের সঙ্গে বর্তমানের সূর্যালোকের মিলন ঘটাতে। শিল্পী শেখ আসমান তেমনই একজন শিল্পী যার শিল্পমানসে শ্রদ্ধার সঙ্গে বার বার উদ্ভাসিত হয়েছে জাতির জনকের ছবি। আর তার বাস্তব রূপ দিয়েছেন কাঠখোঁদাই চিত্রের মাধ্যমে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বাংলাদেশে এই প্রথম কাঠখোঁদাই মাধ্যমে আঁকা ৪৫টি চিত্রকর্ম নিয়ে ‘পুরুষোত্তম’ শিরোনামে শিল্পী শেখ আসমানের একক শিল্পকর্ম প্রদর্শনী শুরু হয়েছে বাংলাদেশ শিল্পকলার জাতীয় চিত্রশালার ৫নং গ্যালারিতে। প্রদর্শনীটি উদ্বোধন করেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। শেখ আসমান বছরের পর বছর ধরে অক্লান্তভাবে কাজ করে চলেছেন বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে নিয়ে। গ্যালারিতে প্রদর্শিতব্য কাঠখোঁদাই ছবিগুলোর দিকে তাকালে বোঝা যায় তিনি বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের প্রতি কতটা শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ৪৫ বছর উপলক্ষে শিল্পী ৪৫টি চিত্র সিরিজ আকারে এঁকেছেন। আর এ সিরিজ চিত্রগুলো ক্রমানুসারে শোভা পাচ্ছে গ্যালারির দেয়াল জুড়ে। ‘স্বদেশ প্রত্যাবর্তন’ সিরিজের চিত্রগুলোতে বঙ্গবন্ধুর হিথ্রো বিমানবন্দর থেকে ভারত হয়ে বাংলাদেশে ফেরার কাহিনী চিত্রগুলো দক্ষতার সঙ্গে ফুঁটিয়ে তুলেছেন শিল্পী। বঙ্গবন্ধুর জাদুকরি নেতৃত্ব, জাতির প্রতি অপরিসীম আস্থা ও ভালবাসার গুণে তিনি বাঙালীদের একমন, এক প্রাণে পরিণত করতে পেরেছিলেন, এই ছবিগুলো তাই প্রমাণ করে। এই সিরিজের ছবিগুলোতে জাতির পিতাকে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় উপস্থাপন করেছেন শিল্পী। যুদ্ধাহত দেশ প্রত্যাবর্তন মুহূর্তে বেদনাহত মুজিব, ঘনিষ্ঠ জনের সঙ্গে হাস্যোজ্জ্বল মুজিব, সহযোদ্ধা রাজনীতিকদের সঙ্গে বক্তৃতারত মুজিব এমনই অনেক ইমেজকে নিরন্তর কাঠেখোঁদাই করে শিল্প সৃষ্টি করেছেন শেখ আসমান। কাঠের আঁশের বৈচিত্র্যে মুজিব অভিব্যক্তির রূপ অপেক্ষকৃত বেশি প্রকাশ-জর্জর ভাষা পেয়েছে। এ মহান নেতার সংগ্রামমুখর এবং বিচিত্র অভিজ্ঞতাপূর্ণ জীবন আমাদের প্রতি মুহূর্তে অনুপ্রাণিত করে। তাই তো এ মহান নেতা কখনও উঠে এসেছেন কবির কবিতায়, শিল্পীর কণ্ঠে, রাজনৈতিকের দর্শনে, বুদ্ধিজীবীর লেখনীতে, ইতিহাসবিদের বিশ্লেষণে, তারুণ্যের চেতনায়, চিত্রকরের চিত্রপটে আর কোটি কোটি মানুষের অকুণ্ঠ ভালবাসায়। শুকনো প্লাইউড এর বুকে বুরিন চালিয়ে দক্ষতার সঙ্গে ক্যানভাসে দ্বীপ্ত করেছেন ইতিহাসের মহানায়ককে। ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন শিল্পানুরাগী মানুষের মাঝে। শিল্পী শেখ আসমান এ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর প্রায় অর্ধশতাধিক প্রতিকৃতি এঁকেছেন। এসব প্রতিকৃতিতে বঙ্গবন্ধুর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন বিভিন্নভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। ‘জাতির পিতা’ সিরিজের ছবিগুলো এ সাক্ষ্য বহন করে। কাব্যময় রেখা আর মোহবিন্যাসহীন রঙের ব্যবহারে ছবিগুলো হয়ে উঠেছে প্রাণবন্ত। রং মাখা কুচি কুচি রেখার বিন্যাসে গতিময়তায় ধরা দিয়েছে বক্তৃতারত বঙ্গবন্ধু, স্মিত হাস্যোজ্জ্বল বঙ্গবন্ধু, পাইপ মুখে বঙ্গবন্ধু, বিজয়ীর বেশে বঙ্গবন্ধু, চিন্তামগ্ন। এ রকম নানাবিধ অভিব্যক্তিকে শিল্পী তার চিত্রপটে স্বযতেœ তুলে এনেছেন। তার শিল্পকর্মে ইতিহাসের মহানায়কের গৌরবকে ক্যানভাসে দীপ্ত করে দেয়ার প্রয়াস স্পষ্ট। চিত্রপটে বঙ্গবন্ধুর চেহারার মাধুর্যটিকে সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর মনোহরণকারী ব্যক্তিত্বকে ফুটিয়ে তুলেছেন সৃজনের আলোয়। প্রতিটি চিত্রকর্মের আড়ালেই বঙ্গবন্ধুর প্রতি শিল্পীর শ্রদ্ধা-ভালবাসা আর নিরলস পরিশ্রম লক্ষণীয়। চিত্রগুলো দেখলেই মনে হয় তিনি যেন সামনেই জীবন্ত হয়ে রয়েছেন। শিল্পীর নির্মিতির করণকৌশল স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাধীন। প্রতিকৃতি অঙ্কনের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করেই শিল্পী অতলস্পর্শী ব্যক্তিত্বকে স্পর্শ করে অভিব্যক্তির মাধুর্যতায় স্পর্শ করেছেন জননন্দিত জননায়ক বঙ্গবন্ধুকে। শিল্পী শেখ আসমান শিল্পের সামাজিক ও ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতাকে ধারণ করেছেন মনে প্রাণে। শিল্পের ভাষায় কাঠ কেটে শিল্পী কোন রঙিন দৃশ্যচিত্র নয়, বরং ইতিহাসের প্রমাণ খ- নির্মাণ করতে চেয়েছেন। নির্মাল্য নাগ তাঁর শিল্প চেতনা গ্রন্থে ‘ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোন’ প্রবন্ধে বলেছেন ‘প্রয়োজন বস্তুনিষ্ঠভাবে ইতিহাসের গভীরে যাওয়া। কারণ সেখানে লুকিয়ে আছে প্রকৃত সত্য এবং তথ্য।’ ‘বাংলার তর্জনী’ সিরিজের চিত্রগুলোতে শিল্পী শেখ আসমান দ্রুতগামী চিত্রবিন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের প্রাণ পুরুষের চিত্র নির্মাণ করেছেন কাঠখোঁদাই মাধ্যমে। কাঠখোঁদাই মাধ্যমে করা বঙ্গবন্ধুর কাজে যেন নতুন এক দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেছেন শেখ আসমান। কাঠ কেটে রেখার প্রবাহ নির্মাণ করার এক ধরনের প্রচেষ্টা শিল্পীর কাজে বর্তমান। সুন্দর অসুন্দরের তফাৎ নয়, বিমূর্ত বা আধা বিমূর্ত নয়, চিন্তার সঙ্গে চেতনার যোগসাজেশে পুরোদস্তুর বাস্তব জ্ঞানভিত্তিক চিত্রকাঠামো নির্মাণে ব্রতীপালন শিল্পী শেখ আসমান। এই সিরিজের ছবিগুলোতে জাতির জনকের গণমুখিতা এবং প্রত্যাশা ও স্বপ্ন পূরণের এক দুর্বার বাণী যেন ব্যক্ত করতে চেয়েছেন। তর্জনী উঁচানো নেতার মধ্যে শিল্পী বীর বাঙালীর শৌর্যকে তুলে ধরেছেন। ছবিগুলোতে রঙের ছাপগুলো বেশ মার্জিত এবং সাবলীল। হয়তো দ্রুত কাজ করার কারণে এই সাবলিলতা শিল্পীর কাজে খুব স্পষ্ট। শিল্পী শেখ আসমান শুধু জাতির পিতার মুখাবয়ব নয়, আত্মীয় পরিজন, জনতা পরিবৃত বঙ্গবন্ধুকেও এঁকেছেন। এঁকেছেন পরিবারের অন্য সদস্যদের ছবিও। সন্তানের সঙ্গে মুজিব ¯েœহশীল পিতা, স্ত্রীর পাশে পরম নির্ভরতা, নিজের পিতার বুকের ওপর মুজিব শ্রদ্ধায় অবনত, কাঠখোঁদাই মাধ্যমে ‘আশীর্বাদ’ সিরিজ এ ছবিগুলো রেখা ও টেক্সচারের বুননে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, শেখ জামাল, শেখ কামাল, শেখ রাসেলের ছোট বেলার ছবিগুলো পরম যতেœ কাঠখোঁদাই করে উপস্থাপন করেছেন। সেই সঙ্গে এঁকেছেন হাস্যোজ্জ্বল বঙ্গমাতার প্রতিকৃতি। শিল্পী শেখ আসমান গভীর ভালবাসার প্রকাশ ঘটিয়েছেন জাতির পিতা ও তাঁর আত্মীয় পরিজনদের চিত্ররূপ দিয়ে। এ প্রদর্শনীকে বলা যেতে পারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের এক সচিত্র এ্যালবাম। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বঙ্গবন্ধুর চেতনাকে বিকশিত করতে, ধারণ করতে শিল্পী শেখ আসমানের কর্মচিন্তা এবং প্রচেষ্টা দুই-ই প্রশংসার দাবিদার। চিন্তার কাঠামোতে রাজনৈতিক সচেতনতার আদলে তার চিত্রের আলোক বিন্যাস নতুন ধারার জন্ম দিতে পারে। কাঠ কেটে রেখার গতিময়তা, আলো-ছায়ার বিন্যাসে বিষয়ের উপস্থাপনা শিল্পের দোরগোরায় পৌঁছে দিয়েছে তার চিত্রকর্মগুলোকে। প্রদর্শনী চলবে ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত।
×