ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ভারতে গ্রেফতার দুই বাংলাদেশী জঙ্গীর মুখোমুখি হচ্ছে পুলিশ

প্রকাশিত: ০৪:৫৬, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৭

ভারতে গ্রেফতার দুই বাংলাদেশী জঙ্গীর মুখোমুখি হচ্ছে পুলিশ

গাফফার খান চৌধুরী ॥ ঢাকায় বড় ধরনের নাশকতা চালানোর পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে ভারতে গ্রেফতারকৃত পশ্চিমবঙ্গের খাগড়াগড় জঙ্গী আস্তানায় বিস্ফোরণে জড়িত দুই বাংলাদেশী জঙ্গীর মুখোমুখি হচ্ছে বাংলাদেশ পুলিশের একটি দল। গ্রেফতারকৃত জঙ্গী ও ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগ ও তথ্য আদানপ্রদান হচ্ছে। দুই জঙ্গীর কাছ থেকে বাংলাদেশে দেশী-বিদেশী জঙ্গীদের নেটওয়ার্ক, অস্ত্র গোলাবারুদের মজুদ, হুন্ডির মাধ্যমে কাদের কাছে টাকা পাঠানো হয়, সেইসব চক্র ও জঙ্গীদের তৎপরতা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করা হবে। ঢাকায় জঙ্গীদের কোথায় কোথায় নাশকতা চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে, পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কারা মদদ দিচ্ছে, কাদের অর্থায়ন করার কথা, সেসব জানার চেষ্টাও অব্যাহত থাকবে। সংশ্লিষ্ট ওই সূত্র বলছে, গত ২১ নবেম্বর কলকাতা রেলস্টেশন থেকে লালবাজারের স্পেশাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ) সামশাদ মিয়াঁ ওরফে তনবির ও রিয়াজুল ইসলাম ওরফে সুমন নামে দুই বাংলাদেশীকে গ্রেফতার করে। সামশাদদের সঙ্গে গ্রেফতার হয় অস্ত্র ব্যবসায়ী মনোতোষ দে ওরফে শ্যামল দে ওরফে জিয়ারুল। তাদের ১৪ দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছে কলকাতার আদালত। তারা বাংলাদেশের নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) সদস্য বলে ভারতীয় পুলিশ জানিয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা মূলত নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জেএমবির সদস্য। গ্রেফতারকৃতরা কলকাতার আশেপাশে আস্তানা গেড়ে বাংলাদেশে বড় ধরনের নাশকতামূলক কাজকর্ম চালানোর পরিকল্পনা করছিল। এমন পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত আরও কয়েকজন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য। তারাও সশরীরে ভারতের কলকাতায় গিয়ে ঘাঁটি গাড়ার কাজে জড়িত। অভিযানের আগেই তারা পালিয়ে যায়। গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে ডায়েরি উদ্ধার হয়েছে। তাতে নাশকতামূলক কর্মকা- চালানোর পরিকল্পনার ছক রয়েছে। সেই ছক রীতিমত চমকে ওঠার মতো। তাতে কলকাতার বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান, এমনকি বহু বাসস্টপ, রেলস্টেশন গ্রেফতারকৃতরা হেঁটে ঘুরে রেকি করেছে বলে তথ্য রয়েছে। ভবিষ্যতে চূড়ান্ত নাশকতা চালানোর প্রাথমিক কাজ সেরে রাখার অংশ হিসেবে গ্রেফতারকৃতরা এসব কাজ করেছে। গ্রেফতারকৃতরা সাংকেতিক পদ্ধতিতে কথাবার্তা চালাতো। হুন্ডির মাধ্যমে নিয়মিত টাকাও পেত তারা। গ্রেফতারকৃতরা বেশ কয়েক জন কলকাতার স্থানীয় বাসিন্দাকেও তাদের জঙ্গী দলে ভেড়াতে সক্ষম হয়েছে। ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান সামশাদ ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র। ২০১৪ সালে সিলেটে পড়ার সময় মামুন নামে একজনের মাধ্যমে সে জঙ্গীবাদে জড়ায়। মামুন বাংলাদেশ পুলিশের হাতে আগেই গ্রেফতার হয়েছে। এসটিএফ-এর ডিসি মুরলীধর শর্মা গণমাধ্যমকে জানান, সামশাদের মগজ ধোলাই করেছিল এবিটি’র বাংলা টিমের প্রধান ২০ লাখ টাকা পুরস্কারঘোষিত বরখাস্তকৃত মেজর জিয়া। সামশাদ ও রিয়াজুল দেড় বছর আগে হায়দরাবাদের মান্নেগুড়ার এক কারখানায় কাজ করত। মাস তিনেক পরে ওই কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা কর্নাটকের বেলগাঁওতে নির্মাণ কর্মী হিসেবে কাজ শুরু করে। সেখানেই ভুয়া আধার কার্ড ও প্যান কার্ড তৈরি করে সামশাদ। বেলগাঁওতে দু-তিন মাস কাজ করার পর সামশাদ ও রিয়াজুল পুনেতে যায়। সেখানে কয়েক মাস থাকার পর হায়দরাবাদে ফিরে এসে একটি কম্পিউটার কোর্স করে। কয়েক মাস রাঁচি ও পাটনায় কাটিয়ে চলতি বছর দুর্গাপূজার সময় কলকাতায় আসে। মুরলীধর জানান, আটক দুই বাংলাদেশী বিস্ফোরক পদার্থ কেনার জন্য রাঁচি ও পাটনায় একাধিক জায়গায় গিয়েছিল। সে বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে। সামশাদদের সঙ্গে আটক মনোতোষের কাছ থেকে ভারত বা বাংলাদেশের কোনও পরিচয়পত্র পাওয়া যায়নি। তবে সে আগেও একাধিকবার অস্ত্র আইনে গ্রেফতার হয়েছে। মূলত অস্ত্র ব্যবসার কারবারি মনোতোষ বিহারের মুঙ্গের থেকে অস্ত্র কিনত। সে গত ৬ মাসে ৪/৫ বার বাংলাদেশে অস্ত্র পাঠিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের ইন্টেলিজেন্স এ্যান্ড স্পেশাল এ্যাফেয়ার্স বিভাগের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, বিষয়টি তাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। গ্রেফতারের পর পরই ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে তাদের যোগাযোগ হয়েছে। গ্রেফতারকৃত জঙ্গীদের কাছ থেকে তথ্য পেতে স্বল্প সময়ের মধ্যেই একটি দল ভারতে যাচ্ছে। তবে রিমান্ডে থাকা জঙ্গীরা কি তথ্য দিচ্ছে, সে বিষয়ে জানতে ভারতের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ অব্যাহত আছে। সে মোতাবেক কাজও চলছে। ওই দুই জঙ্গীর কাছ থেকে বাংলাদেশে দেশী-বিদেশীদের জঙ্গীদের তৎপরতা কোন পর্যায়ে রয়েছে, তাদের সদস্য সংখ্যা কত, তাদের অর্থায়নকারী ব্যক্তি বা দল, ঢাকায় তাদের কি ধরনের কোথায় কোথায় নাশকতা চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে, সেসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কারা কিভাবে সহযোগিতা করছে, হুন্ডির মাধ্যমে কাদের মাধ্যমে জঙ্গীদের কাছে অর্থ লেনদেন হয়, বিস্ফোরকের মজুদ, কলকাতা থেকে পালিয়ে যাওয়া জঙ্গীদের নাম ঠিকানা, পলাতক মেজর জিয়া সম্পর্কে তথ্য পাওয়া, জঙ্গী নেতা হাঁতকাটা মাহফুজসহ এদেশে গ্রেফতার হওয়া ও পলাতক থাকা জঙ্গীদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করা হবে। এ বিষয়ে ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের সহযোগিতা করছে এবং করবে। ইতোমধ্যেই ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের কাছে বেশকিছু পলাতক জঙ্গীর তালিকা দিয়েছে। তারা বাংলাদেশে আত্মগোপনে রয়েছে বলে জানানো হয়েছে। তাদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে। আমাদের তরফ থেকেও ভারতের কাছে একটি তালিকা দেয়া হয়েছে। তালিকাভুক্ত জঙ্গীরা ভারতে পালিয়ে থেকে দুই দেশেই নানা ধরনের নাশকতামূলক কর্মকা- চালানোর চেষ্টা করছে। এই কর্মকর্তা আরও জানান, গুলশানে হলি আর্টিজানে হামলার অন্যতম পরিকল্পনা ও অস্ত্র গোলাবারুদ সরবরাহকারী ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের খাগড়াগড়ে জেএমবির নেটওয়ার্ক ও আস্তানা গড়ে তোলার অন্যতম কারিগর সোহেল মাহফুজ গ্রেফতার হওয়ার পর দুই দেশের জঙ্গী কর্মকান্ড সর্ম্পকে অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে মাহফুজ নসরুল্লাহ নামে পরিচিত ছিল। খাগড়াগড়ের জেএমবির আস্তানায় গ্রেনেড তৈরির সময় বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনার অন্যতম হোতা সোহেল মাহফুজ ভারতের মোস্টওয়ান্টেড আসামি। ভারত সরকার তাকে জীবিত বা মৃত ধরিয়ে দিতে ১০ লাখ রুপী পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। তার সম্পর্কে তথ্য পেতে কয়েক দফায় ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের একাধিক দল বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন। ২০০৬ সাল থেকে মাহফুজ ভারতে পালিয়ে ছিল। সেখানেই সে জেএমবির আস্তানা গড়ে তুলে ভারতে ও বাংলাদেশে নাশকতার পরিকল্পনা করছিল। মাহফুজ ছাড়াও বিভিন্ন সময় গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে প্রায় সাড়ে সাত শ’ জঙ্গীর জবানবন্দীতে পাওয়া তথ্য মোতাবেক ভারত ও বাংলাদেশে জঙ্গীবিরোধী বিভিন্ন কর্মকান্ড চালানো হচ্ছে।
×