ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

নিভৃতচারী কথাসাহিত্যিক -দিল মনোয়ারা মনু

প্রকাশিত: ০৬:২৪, ২২ ডিসেম্বর ২০১৭

নিভৃতচারী কথাসাহিত্যিক  -দিল মনোয়ারা মনু

বাংলাদেশের অগ্রভাগ সাহিত্যিকদের মধ্যে রিজিয়া রহমান অন্যতম। রিজিয়া রহমান মূলত ষাটের দশকের কথাশিল্পী। ষাটের দশকের জনপ্রিয় লেখকরাই সত্তর ও আশির দশকে সেনাশাসনে অবরুদ্ধ জাতিসত্তার পুনরুদ্ধারের জন্য যে নিরন্তর লড়াই চালিয়ে গেছেন সেই লড়াইয়ে রিজিয়া রহমানও ছিলেন প্রধানতম কথাশিল্পী। আমার কাছে রিজিয়া রহমান শুধু প্রিয় লেখকই নন, বাংলাদেশের প্রধান কথাসাহিত্যিকদের একজন বলেই মনে হয়। একজন ভাল মানুষই প্রকৃতপক্ষে ভাল লেখক হতে পারেন। রিজিয়া রহমান সেই সত্যেরই এক সার্থক প্রতিভূ। চল্লিশ বছরের বেশি সময় তাকে একান্তভাবে জানার এক দুর্লভ সুযোগ আমি পেয়েছি। দীর্ঘদিন সাপ্তাহিক বেগম এবং পাক্ষিক অনন্যা পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্বে থাকায় একজন লেখক এবং সর্বোপরি একজন মানুষ রিজিয়া রহমানকে আমার জানার সুযোগ হয়েছে দিনে দিনে, পরম ভালবাসা এবং শ্রদ্ধায়। প্রথম জানা তাকে একজন লেখক হিসেবে। অর্থনীতিতে উচ্চ ডিগ্রীধারী রিজিয়া রহমান বড় চাকরি বা সুযোগ সুবিধার প্রলোভনের পথে না হেঁটে নিজেকে পরিপূর্ণভাবে সমর্পন করেছেন সংসার, সংসারের চারপাশের মানুষ এবং অতি অবশ্যই লেখার ক্ষেত্রে। দেশ ও সমাজের কাছে তার দায়বদ্ধতা তাই তার লেখার মধ্যে নিত্য প্রতিভাত। এই মহান লেখক সমাজ অর্থনীতি সংস্কৃতি রাষ্ট্রনীতি এবং রাজনীতি সচেতন লেখার মধ্য দিয়ে তার দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছেন, ওঠে এসেছে দেশের যে কোন সঙ্কট বা আন্দোলন। এই সৃষ্টিশীল মানুষটিকে আভিজাত্য ততটা আকর্ষণ করেনি যতটা করেছিল বাংলার আকাশ-বাতাস-সাগর-গিরী-নদনদী, ঘাসফুল, পাখি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও প্রকৃতি। এই প্রকৃতি তার সৃষ্টিশীলতাকে শুধু পরিপুষ্টই করেনি, করেছে মানবিকও। তাকে জানতে চাইলে জানতে হবে তার ভাবের গভীর ব্যঞ্জনা বিশ^ব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার গভীর উৎসুক উৎকন্ঠিত দৃষ্টি এবং দৃষ্টির সর্বজনীনতা। মানবতার দীর্ঘ করুন আর্তি, ইস্পাত কঠিত তীক্ষè বোধকে অবশ্যই দেখতে হবে পরিপূর্ণভাবে না হলে তাকে বোঝা যাবে না। প্রখ্যাত সাহিত্যিক শংকরকে প্রশ্ন করা হয়েছিল- ইতিহাস আর উপন্যাসের মধ্যে পার্থক্য কি? প্রতি উত্তরে বলেছিলেন ইতিহাসের চরিত্রগুলো সত্য। সত্য জানতে আমাদের ইতিহাসের ওপরই নির্ভর করতে হয় আর উপন্যাসের চরিত্রগুলো মিথ্যা, ঘটনগুলো নির্ভেজাল সত্য তাই সত্য জানতে হলে উপন্যাসের ওপর নির্ভর করতে হবে। রিজিয়া রহমানের পারিবারিক পরিম-ল ছিল লেখক তৈরির অনুকূল। বাবা’র বাড়ি পশ্চিমবঙ্গ হলেও মা’র বাড়ি ঢাকা জেলার পদ্মাপাড়ে। তাই পদ্মাপাড়ের মানুষ সম্পর্কে তার অন্যরকম জানাশোনা। ওদের কথা তার কথাশিল্পে নিবিড়ভাবে অঙ্কিত হয়েছে। বস্তুতে জনজীবনের কাছাকাছি বেঁচে থাকা নিয়ত সংগ্রামশীল মানুষের সংস্কৃতি ও জাপনকে তিনি তার বেশ কয়েকটি উপন্যাসে অবলম্বন করেছেন। রিজিয়া রহমানের জন্ম যুদ্ধের ভেতরে, ঠিক দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের সময়ে। তার কাছে শুনেছি জ্ঞান হতেই তিনি শুনেছেন সাইরেন বাজছে, বোমা পড়ছে। ক্ষণে ক্ষণে ব্লাকআউট ও গোড়া সৈন্য ভারী ট্রাক রাস্তায় চলছে। দমদমে বোমা পড়ে অসংখ্য মানুষ মারা গেছে, রক্তে ভেসে গেছে সর্বত্র। কারও হাত নেই, পা নেই। যুদ্ধের এই ভয়াবহতাই তাকে চিরকাল যুদ্ধকে ঘৃণা করতে শিখিয়েছে। রিজিয়া রহমানের জন্ম কলকাতায় কিন্তু বাবা সরকারী চাকরি হওয়ায় তার বদলির কারণে ঘুরেছেন দেশের নানা জেলা শহর। ১৯৪৭ সালের কিছু আগে তিনি ফরিদপুরে বদলি হয়ে আসেন, আর ফেরা হয়নি। তখন তার বয়স মাত্র সাত বছর। স্মৃতি থেকে বলেছিলেন সেদিন অনেক কথা। সেই বয়সে তিনি কলকাতা এবং ফরিদপুরের পার্থক্য চমৎকারভাবে বিশ্লেষণ করেছিলেন। কলকাতাকে তিনি তুলনা করেছেন লন্ডনের সঙ্গে। হাওড়া, আলীপুর চিড়িয়াখানা, চৌরঙ্গীর বনেদীখানা, আধুনিকতা ঔজ্জ্বল্য যেমন তাকে মুগ্ধ করেছিল তেমনি আধুনিক নাগরিক সুবিধার ভেতর থেকে বেড়িয়ে এসে ফরিদুরের জোনাক জ¦লা রাত, হ্যারিকেনের আলো, নদী-নালা, নদীতে ইলিশের নৌকা, নদীর তীর ঘেষে গাছ গাছালির ঘন নিরবতা, তার ভেতরে লুকিয়ে থাকা লেখকসত্ত্বাকে চমৎকৃত অভিভূত করেছে। সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করেছিল পদ্মার বিশাল ব্যাপ্তি ও গভীর শক্তিময়তা। পরবর্তী সময়ে তিনি যখন মিসিপিসি ও নায়েগ্রা দেখেছেন তখন বিশাল ক্যানভাসে ভেসে উঠেছে পদ্মার উদ্দামতা, প্রবলতা, নিজস্ব ইতিহাস এবং ঐতিহ্য। ছোটবেলা বাইরে খেলাধুলার চেয়ে বই পড়তেই তিনি বেশি পছন্দ করতেন। মায়ের জন্য কেনা বসুমতি, প্রবাসী লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তেন। চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ার সময়ে রিজিয়া রাজা নামে তার জীবনের প্রথম গল্প লেখেন। কিছু সময় পরে তার লেখা কবিতা প্রথম ছাপা হয় কলকাতার সত্যযুগ-এ এবং তার পরপরই দৈনিক সাংবাদ-এ ছাপা হয় তার লেখা ছোট গল্প। রিজিয়া রহমানের প্রথম উপন্যাস ছাপা হয় দৈনিক ইত্তেফাকে। গল্পগ্রন্থ আত্মসাক্ষরা দিয়ে তার লেখক জীবন শুরু তারপর লিখেছে অনেক কালজয়ী উপন্যাস, ঘরভাঙ্গা ঘর, রক্তের অক্ষর, বং থেকে বাংলা, বাঘবন্দী, ধবল জোৎনা উল্লেখযোগ্য। প্রতিটি উপন্যাসেই তার লেখক চিন্তার বহুমাত্রিকতা ধরা পড়ে। রক্তের অক্ষর উপন্যাসটি লেখার পর তাকে নানা জনের নানা কথা শুনতে হয়েছে, অশ্লীলতার অভিযোগে। মাত্র ১১০ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসে পতিতাবৃত্তির সঙ্গে তিনি যুক্ত করেছেন বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমাজ বাস্তবতা এবং মুক্তিযুদ্ধকে। পতিতালয়ের প্রতিটি চরিত্রই আশ্চর্য উপস্থাপন, জীবন্ত স্বতন্ত্র্য মানবিক নান্দনিক ও বহুস্তরান্বিত। দেহ ব্যবসা করতে করতে এরা প্রত্যেকে বড় হচ্ছে কিন্তু প্রত্যেকেই স্বাতন্ত্র্যম-িত। দীর্ঘ পনেরো বছর ঘুরে বেড়িয়েছেন ঢাকা শহরের অলিগলি বাঁকাপথ বস্তি। দেখেছেন মিটিং, মিছিল, রেললাইন আর তার ধারে গড়ে ওঠা বস্তি। তাই তার উপন্যাস একটি ফুলের জন্য তো মুক্তিযোদ্ধা পঙ্গু রিক্সাওয়ালার যাপিত জীবনের করুণ ইতিহাস ওঠে এসেছে। রিজিয়া রহামন বিশ^বিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করার পর স্কুল, বেসরকারী ও সরকারী কলেজে অধ্যাপনা করেছেন, যদিও বেশিদিন নয় । এ সম্পর্কে তার একটি চমৎকার ব্যাখ্যাও আছে। তিনি মনে করেছিলেন এর ফলে তিনি লেখার প্রতি আরও সৎ ও নিবেদিত হতে পারবেন। অন্যের অধীনতা মেনে চলতে গেলে হয়ত তার ভেতরের স্বাধীন চিন্তাটাই এক সময়ে হারিয়ে যাবে। প্রতিভাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তার এই স্বাধীন চিন্তার পৃষ্ঠপোষকতা করতে একান্তভাবে সহযোগিতা করেছেন তার ভূতত্ত্ববিদ, স্বচ্ছল, সংবেদনশীল স্বামী। স্বামীর চাকরিসূত্রে তিনি বহু জায়গা ঘোরার সুযোগ পেয়েছেন, সেই সুযোগ তাকে লেখার জন্য বাস্তবমুখী বিভিন্ন ধারার জীবন গল্প জানার সুযোগ করে দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে তার ‘একাল সেকাল’ গ্রন্থের বর্ণনা তিনি এভাবে দেন। চা বাগানের পটভূমিতে লেখা এই গ্রন্থে চা বাগানের সাঁওতাল শ্রমিকদের দৈনন্দিন জীবন খুব কাছ থেকে তিনি দেখেছেন, ওদের ঝকঝকে তকতকে উঠোন, দলবদ্ধ নাচ, শৃঙ্খলা, ছেলেদের মদ খেয়ে বেহুশ হয়ে থাকা সবকিছু খুব কাছে থেকে দেখেছেন। লেখক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেছেন, লেখার ক্ষেত্রে নিবেদিত হওয়ার কোন বিকল্প নেই। জনপ্রিয়তার সঙ্গে শক্তিমান অবশ্যই হতে হবে তাহলেই পারবেন একটি শক্তিশালী পাঠক গোষ্ঠী তৈরি করতে। বিশ^াস এবং কাজে পার্থক্য থাকলে চলবে না। এ প্রসঙ্গে তিনি তার ‘একাল সেকাল’ গ্রন্থের উল্লেখ করেন। ৪৫০ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থ তিনি পাঁচ বারে এই লেখাটি শেষ করেছেন। সবচেয়ে মজার বিষয় এই বইটিই পরবর্তী সময়ে তিনবার পুরস্কৃত হয়েছে। রিজিয়া রহমানের সঙ্গে শেষ বার যখন তার লেখালেখি নিয়ে আমার কথা হয় তখন তিনি ‘আবেজান’ নামের একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখছিলেন। মসলিন শাড়ির নাম আবেজান। এর অর্থ হচ্ছে চলমান জল। এর পাশাপাশি তখন মালয়েশিয়ার চাষীদের জীবন নিয়ে লেখা একটি গ্রন্থও অনুবাদ করছিলেন। আর্থসামাজিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে লেখা রিজিয়া রহমানের একটি অনন্য গ্রন্থ ‘বং থেকে বাংলা’। এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হওয়ার পূর্বে সাপ্তাহিক ‘বেগম’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। সৌভাগ্যক্রমে তখন আমি বেগম পত্রিকার সঙ্গে জড়িত। ‘বং থেকে বাংলা’র পান্ডুলিপি পড়ার মধ্য দিয়ে আমি প্রথম গভীরভাবে নিজস্ব কৃষ্টি, ঐতিহ্য ও স্বদেশ ভাবনার মননশীল লেখক রিজিয়া রহমানকে চিনতে পারি। রিজিয়া রহমানের জন্ম ১৯৩৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই তার লেখালেখি শুরু। বিশ^বিদ্যালয়ের পড়া শেষ করে একটি প্রতিষ্ঠানে রিসার্চ অফিসার হিসেবে কাজ করার সঙ্গে লেখার প্রতি আরও সিরিয়াস হন। ষাটের দশকেই বাংলাদেশের সাহিত্য জগতে তিনি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তার প্রথম গ্রন্থ ‘অগ্নিস্বাক্ষর’। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা তিরিশেরও বেশি। শতাধিক ছোটগল্প লিখে তিনি নন্দিত হয়েছেন। স্মৃতিচারণমূলক সমালোচনা, প্রবন্ধ, রম্য ও শিশুতোষ লেখায়ও তিনি সিদ্ধহস্ত। দৈনিক ও সাপ্তাহিকে কলাম লিখেও তিনি খ্যাতি পেয়েছেন। ‘ত্রিভুজ’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদনাও করেছেন তিনি। এক কথপোকথনের মধ্য দিয়ে আমাদের জাতিসত্ত্বার শিকড় অনুসন্ধানী এই নিরলস লেখক গবেষককে আমি ভিন্ন ভিন্ন আলোয় আবিস্কার করে চমৎকৃত হয়েছি। মানুষের জীবনের অসঙ্গতি, বঞ্চনা, সমাজ জীবনের মনস্তত্ব, মানবিক মূল্যবোধ, অধিকারকে যেভাবে তিনি তার লেখায় তুলে এক পারঙ্গম কথাশিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তা অভাবনীয়। তাই গল্প, উপন্যাসের আঙ্গিকের নিরীক্ষায় তিনি সর্বোতভাবে বিবর্তনশীল আধুনিক এবং নতুন পথের দিক নির্দেশক। বিষয় ও প্রকরণ উভয় ক্ষেত্রেই এ কথার সত্যতা মেলে। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ নদী নিরবধি, হে মানব মানবী, ঘরভাঙ্গা ঘর, উত্তর পুরুষ, রক্তের অক্ষর, বং থেকে বাংলা, অরন্যের কাছে, ঝড়ের মুখোমুখি, একাল চিরকাল, প্রেম আমার প্রেম, একটি ফুলের জন্য, শিলায় শিলায় আগুন, সূর্য সবুজ রক্ত ও ধবল জোৎ¯œা। মানবিক চেতনা, সামাজিক অগ্রগতি, নারী অধিকার, জেন্ডার ধারনা, তার লেখায় এনেছে এক ভিন্ন স্বাদ এবং স্বতন্ত্র মাত্রা। হয়ে উঠেছেন ক্রমান্বয়ে সামাজিক অগ্রগতি, রাষ্ট্রীয় আন্দোলন নারী জাগরণের এক অপরাজেয় শক্তির প্রতীক। সাধক এবং মহৎ লেখক হিসেবে সাধনায় মিলেছে সৃষ্টি ও কর্মের যুগপৎধারা এবং ঘটেছে বিশ^াস আচরণ ও সৃষ্টির এক অপূর্ব সমন্বয়। এক দীর্ঘ আলোচনায় রিজিয়া রহমান বলেছিলেন প্রাচ্য প্রতীচের জীবনবোধ ও বৈষম্যের কথা। এই কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন এর পেছনে মূল প্রভেদটা সংস্কৃতির। ইউরোপিয়ান কালচার অনেক বেশি উন্নত তার কারণ এদের রয়েছে উন্নত টেকনোলজি। অন্যদিকে এশিয়ান কালচার দারুণভাবে জীবনমুুখী, তবে ইউরোপিয়ান কালচার সবসময়ই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। ফলে প্রগতিশীল চিন্তাভাবনায় তারা এগিয়ে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। মানবতাবোধ, গণতন্ত্র, অধিকার তখন তাদের সমাজে পূর্ণভাবে অধিষ্ঠিত। তিনি মনে করেন জনপ্রিয় ও সিরিয়াস সাহিত্য দুটোই সমাজে পাশাপাশি চলবে। এটাই নিয়ম। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য আজকাল বইপড়ার অভ্যাসটাই কমে যাচ্ছে। ক্লাসিক সাহিত্যতো একেবারেই কম। এই চর্চা কম বলেই সাহিত্যের সঙ্গে আমাদের দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। তীক্ষè জীবনবোধ সম্পন্ন অসাধারণ মানুষ তিনি। ছিন্নমূল শিশুদের প্রতি তার অসীম মমত্ববোধ। কত শিশুকে যে তিনি লেখাপড়া শিখিয়েছেন, সেবা দিয়েছেন, চিকিৎসা করিয়েছেন, তাদের পরিবারকে সহায়তা ও সহযোগিতা করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। আমি দীর্ঘদিন খুব কাছ থেকে তার এই মানবিক কাজগুলো দেখেছি। তার জীবনের একটি ইচ্ছা অসহায় সমস্যাপীড়িত মানুষদের জন্য একটি ‘হোম’ গড়ে তোলা। ছাত্রজীবনে রাজনীতি করেছেন, ডাকসুর সদস্যও হয়েছেন দু’বার। সবকিছু ছাপিয়ে তিনি একজন শক্তিমান লেখক। মূর্তি গড়া, ছবি আঁকার মতো নান্দনিক কাজগুলো থেকেও তিনি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন শুধুমাত্র লেখার জন্য। যে বিপুল সম্ভবনা নিয়ে তিনি যাত্রা করেছিলেন সেই সম্ভবনার বেশিরভাগ দ্বারই পার হতে পেরেছেন তিনি। তার ব্যক্তিত্বের অনেক অংশকে অবদমনও করতে হয়েছে লেখার জন্য, তার রাজনৈতিক মতাদর্শ থেকে হয়ত তিনি দূরে অবস্থান করছেন কিন্তু মানবিক মতাদর্শ তৈরিতে অবিচল রয়েছেন। জীবনের প্রতিটি বাঁকে তিনি ক্রমান্বয়ে সাহসী উদার হয়ে উঠেছেন- হয়ে উঠেছেন আধুনিক। সৃষ্টিধারাকে রেখেছেন অবিরাম, অব্যাহত। রাষ্ট্রীয় ও সমাজ, সঙ্কট, অসঙ্গতি, বৈষম্যের ফলে সৃষ্ট তার ভেতরে ক্ষোভ যন্ত্রণাকে চাপা দিয়ে রাখা যাবে না। ছাই চাপা দিয়ে আর যাই হোক মহান লেখকের ভেতরের আগুনটাকে নিভিয়ে দেয়া যায় না। কারণ কখনই শিল্পীর ভেতরের আগুন নেভেনা। তাইতো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনের কথা বলেছেন। সেই জীবনের কথা আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের দলিল হয়ে উঠেছে। তার লেখা অব্যাহত থাকুক।
×