ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রধানমন্ত্রী আজ উদ্বোধন করবেন

পরমাণু চুল্লির ঢালাই- নতুন দিগন্তের সূচনা

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ৩০ নভেম্বর ২০১৭

পরমাণু চুল্লির ঢালাই- নতুন দিগন্তের সূচনা

স্টাফ রিপোর্টার ঢাকা ও ঈশ^রদী ॥ ১৯৬১ থেকে ২০১৭ এর ৩০ নবেম্বর। মাঝখানের সময়টি লম্বা ৫৬ বছরের। দীর্ঘ সময় একবার গ্রহণ একবার বাতিল এর মধ্যে আটকে ছিল রূপপুর পরমাণু বিদ্যুত কেন্দ্রর ভাগ্য। ’৭১ এ মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ’৭৩ এ একবার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু ’৭৫ এ বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর সেই স্বপ্ন হারিয়ে গিয়েছিল। ২০০৯ এ সরকার গঠনের পর আবার সেই স্বপ্ন জাগিয়ে তুললেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাশিয়ান ফেডারেশনের সঙ্গে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণে ২০১১ সালে চুক্তি করা হয়। পরবর্তীতে ২০১৩ সালে সই হলো ঋণ চুক্তি। এর মধ্যেই প্রকল্পের প্রথম ধাপের কাজ শেষ হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার পরমাণু চুল্লির সিমেন্টিং কাজের উদ্বোধন করতে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। এর মধ্য দিয়ে শুরু হবে মূল বিদ্যুত কেন্দ্রের নির্মাণ কাজের। দেশের ইতিহাসে নতুন দিগন্তের সূচনা হচ্ছে। বাংলাদেশ প্রবেশ করছে পরমাণু বিদ্যুত উৎপাদনের যুগে। পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশে^ ৩২তম দেশ হিসেবে নিউক্লিয়ার ক্লাবে যুক্ত হতে যাচ্ছে। মোট ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াটের কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট উৎপাদনে আসবে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে। আর দ্বিতীয় ইউনিট আসবে পরের বছর। এর আগে রূপপুরে আবাসন ছাড়াও অন্য অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। বিদ্যুত কেন্দ্রের অর্থায়ন, নির্মাণ এবং পারমাণবিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় রাশিয়া থাকছে বাংলাদেশের পাশে। শুরুর দিকে পরমাণু বর্জ্য ফেরত নেয়া নিয়ে সংশয় থাকলেও পরবর্তীতে আরও একটি চুক্তি করা হয়। ওই চুক্তিতে রাশিয়ার বর্জ্য ফেরত এবং পরিশোধন করার কথা উল্লেখ করেছে। তবে এজন্য তাদের আলাদা করে অর্থ পরিশোধ করতে হবে। দেশের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক প্রকল্প পাবনার রূপপুরে এক হাজার ২০০ মেগাওয়াটের দুটি পরমাণু বিদ্যুত কেন্দ্রের জন্য রাশিয়ার কাছ থেকে বাংলাদেশ সরকার ঋণ নিচ্ছে ১১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার। তবে এজন্য সুদে-আসলে রাশিয়াকে ফেরত দিতে হবে ২০ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশী মুদ্রায় রাশিয়ার কাছ থেকে নেয়া ৯১ হাজার ৪০০ কোটি টাকার শুধু সুদ বাবদই সরকারকে ফেরত দিতে হবে ৬৯ হাজার ২৩২ কোটি টাকা। রাশিয়ার বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশী কর্মী মিলে প্রায় এক হাজারের বেশি কর্মী দিন-রাত কাজ করছেন। এ প্রকল্পের জন্য থ্রি প্লাস রিএ্যাক্টর বসানো হয়েছে। যেটি বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ ও আধুনিক প্রযুক্তি। যা শুধু রাশিয়ার একটি বিদ্যুত কেন্দ্র রয়েছে। আর বাংলাদেশের রূপপুরেই হবে দ্বিতীয় ব্যবহার। প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের মাধ্যমেই পাওনিয়ার বেইজ ও ইরেকশন বেইজের কাজ সমাপ্ত হয়েছে। এছাড়া চলছে প্রটেকশন ড্যাম (বাঁধ) তৈরির কাজ। ২ দশমিক ৮ কিলোমিটার লম্বা এবং ১৩ মিটার প্রস্থ এ বাঁধের কাজও এগিয়েছে অনেকদূর। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রথম পর্যায়ে ২৬০ একর জমি অধিগ্রহণ করা ছিল। কিন্তু সেটি পর্যাপ্ত না হওয়ায় ইতোমধ্যেই আরও ৮০০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া আরও ২১৯ একর জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। এছাড়া নতুনভাবে অধিগ্রহণ করা পদ্মার বিশাল চরে চলছে মাটি ভরাটের কাজ। মূল প্রকল্প এলাকার বাইরে গ্রিনসিটি আবাসন পল্লী নির্মাণের কাজ অনেকটাই শেষ পর্যায়ে। পাবনা গণপূর্ত অধিদফতর এগুলো বাস্তবায়ন করছে। ইতোমধ্যেই তিনটি সুউচ্চ বিল্ডিংয়ের কাজ শেষ হয়েছে। এ এলাকায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ২০তলা ১১টি বিল্ডিং এবং ১৬তলা ৮টি বিল্ডিংয়ের কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে। ২২টি সুউচ্চ বিল্ডিং তৈরি হবে এ চত্বরে। এছাড়া থাকবে মাল্টিপারপাস হল, মসজিদ ও স্কুলসহ বিভিন্ন স্থাপনা। দেশের সব থেকে বড় প্রকল্পর উদ্বোধন উপলক্ষে বর্ণিল রঙে সেজেছে ঈশ^রদী। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দিবেন। এর আগে রাশিয়ার আন্তর্জাতিক প্রকল্প এএসই গ্রুপের প্রকৌশল বিভাগ রোসাটম স্টেট এটোমিক এনার্জি কর্পোরেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট মি. আলেকজান্ডার খাজিন, রোসাটমের মহাপরিচালক আলেকজি লিখাচেভ বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দিবেন। স্বাগত বক্তব্য দিবেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব আনোয়ার হোসেন। অনুষ্ঠানে সভাপতি হিসেবে বক্তব্য দিবেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস উসমান। এ সময় রাশিয়া ও ভারতসহ ১০ দেশের অতিথিদের উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে। বক্তব্য শেষে প্রধানমন্ত্রী সুইচ টিপে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের মূল পর্বের প্রথম কংক্রিট ঢালাই কাজের শুভ উদ্বোধন করবেন। এর আগে প্রধানমন্ত্রী হেলিকপ্টার থেকে নেমে নির্মানাধীন বিদ্যুত কেন্দ্রের পারমাণবিক চুল্লির মূল স্থান কংক্রিট ঢালাই কাজের সাইট পরিদর্শন করবেন। এদিকে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানকে সফল করতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস উসমান প্রকল্পের পিডি শৌকত আকবরসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা এবং সকল প্রকার প্রশাসনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে প্রকল্প এলাকায় অবস্থান ও মনিটরিং করছেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সর্বশেষ অবস্থা জানতে বুধবার সকালে প্রধানমন্ত্রীর এপিএস সাইফুজ্জামান শেখর উদ্বোধনী মঞ্চ, হ্যালিপ্যাড, নতুন রূপপুর স্কুল ও পাকশী রেলওয়ে ফুটবল মাঠ পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস উসমান, প্রকল্পের পিডি শওকত আকবরসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা, পাবনা-৫ আসনের এমপি খন্দকার গোলাম ফারুক প্রিন্স, নাটোর-১ আসনের এমপি এ্যাডভোকেট, আবুল কালাম আজাদ, ঈশ্বরদী, পাকশী ও লক্ষ্মীকুন্ডা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলে বিভিন্ন বিষয়ে জানার চেষ্টা করেন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস উসমান ও পাবনা জেলা প্রশাসক রেখা রানী বালো জানান, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। শেখ হাসিনার আগমনকে কেন্দ্র করে ঈশ্বরদী ও লালপুরের সর্বত্র গত ১৫ দিন থেকে উৎসবের আমেজ চলছে। ঢাকায় অবস্থানকারী ঈশ্বরদী এলাকার আইনজীবী নেতা এ্যাডভোকেট রবিউল আলম বুদু ও সাবেক কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগনেতা ব্যারিস্টার সৈয়দ আলী জিরুসহ অন্য নেতারা গত ২৪ নবেম্বর থেকে এলাকায় অবস্থান করে ঈশ্বরদী, আটঘরিয়া ও পাবনা এলাকায় গণসংযোগসহ নানাভাবে কাজ করে যাচ্ছেন অনুষ্ঠানকে সফল করার জন্য। লক্ষ্মীকুন্ডা ও পাকশী ইউপি চেয়ারম্যানদ্বয়সহ দলীয় নেতাকর্মীরাও অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন। পাকশী ও লক্ষ্মীকুন্ডা ইউনিয়ন এলাকার বিশাল জমিতে পরমাণু প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন হওয়ায় আনিসুর রহমান শরীফ ও এনামুল হক বিশ্বাস বলেন, উদ্বোধনী অনুষ্ঠান প্রকল্পের মধ্যে আয়োজন করায় অপেক্ষমাণ সাধারণ মানুষের চাহিদা পূরণের জন্য পাকশী রেলওয়ে আমতলা ফুটবল মাঠে ও নতুন রূপপুর স্কুল মাঠে তিনটি বিশালাকৃতির প্রজেক্টর এবং সাড়ে চার হাজার চেয়ার দিয়ে পৃথক দুটি প্যান্ডেল সাজানো হয়েছে। সেখান থেকে তারা প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শুনবেন ও দেখবেন। এলাকায় মাইকিংসহ নানাভাবে প্রধানমন্ত্রীর আগমনী বার্তা পৌঁছে দেয়া হয়েছে। সাধারণ জনগণ প্রজেক্টরের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীকে দেখে ও ভাষণ শুনে ডিজিটাল সরকারের ভাবমূর্তি বৃদ্ধি করবেন বলেও তারা জানান। প্রসঙ্গত ১৯৬১ পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের প্রথম উদ্যোগ নেয়া হয়। পরবর্তীতে ১৯৬২-১৯৬৮ পাবনা জেলার ঈশ্বরদী থানার পদ্মা পাড়ে রূপপুরকে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের স্থান হিসেবে নির্বাচন করা হয়। তখন কেন্দ্রটির জন্য ২৬০ একর এবং আবাসিক এলাকার জন্য ৩২ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ভূমি উন্নয়ন, অফিস, রেস্ট হাউস, বৈদ্যুতিক সাব-স্টেশন ও কিছু আবাসিক ইউনিটের নির্মাণ কাজ আংশিক শেষ করা হয়। শুরুতে ২০০ মেগাওয়াটের কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা করা হলেও পরবর্তীতে ১৯৭০ সালে পাকিস্তান সরকার তা বাতিল করে দেয়। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদনের একটি পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। যদিও পরবর্তীতে বিষয়টি আর আলোর মুখ দেখেনি। ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবারও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
×