ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

রুশদীর উপন্যাসে জোকার চরিত্রে ট্রাম্প

প্রকাশিত: ০৪:২৮, ৫ অক্টোবর ২০১৭

রুশদীর উপন্যাসে জোকার চরিত্রে ট্রাম্প

ঔপন্যাসিক সালমান রুশদী মার্কিন নির্বাচনের আগেই ধারণা করছিলেন ট্রাম্প জয়ী হবেন। ব্যক্তিগতভাবে হিলারির প্রতি তার সমর্থন থাকলেও তিনি তার অবশ্যম্ভাবী পরাজয় দেখতে পেয়েছিলেন। তার সর্বশেষ উপন্যাস ‘দি গোল্ডেন হাউজ’-এ ধরনের কথা না থাকলেও সেটি আমেরিকার টালমাটালময় ও ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ পটভূমিতে লেখা একটি রাজনৈতিক উপন্যাস যেখানে ট্রাম্পকে রূপক চরিত্রে হাজির করা হয়েছে এবং তাকে শাণিতভাবে আক্রমণও করা হয়েছে। ‘দি গোল্ডেন হাউজে’ ট্রাম্পের নাম কোনভাবেই উল্লেখ করা হয়নি। তবে ওতে ‘বিশাল বিজয়ী সবুজ চুলের কার্টুন কিং’ হিসেবে যাকে দেখানো হয়েছে তার আসল পরিচয় যে ট্রাম্প সে ব্যাপারে পাঠকের কোন সন্দেহ থাকবে না। উপন্যাসটি বারাক ওবামার প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিষেক দিয়ে শুরু হয়েছে এবং শেষ হয়েছে ট্রাম্পের নির্বাচনী বিজয় দিয়ে। ট্রাম্প এখানে প্রতীকী চরিত্রে একজন খলনায়ক এবং জোকার হিসেবে উপস্থিত। উপন্যাসে ট্রাম্প চরিত্রটির নাম গ্যারি ‘গ্রিন’ গোয়াইনপ্লেইন। ইনি একজন রুচিবিবর্জিত অমার্জিত অথচ ধনাঢ্য ব্যক্তি যার চুলের রং সবুজ এবং যিনি নিজেকে জোকার হিসেবে সম্বোধিত হতে পছন্দ করেন। এ জোকার রুশদীর প্রিয় আমেরিকার প্রতি যে কি হুমকির সৃষ্টি করেছে তার বর্ণনা আছে উপন্যাসে। এই জোকার নিউইয়র্ক নগরীজুড়ে চিৎকার করছে। তর্জন গর্জন করে বেড়াচ্ছে এবং ধ্বংস ও বিপর্যয় বয়ে নিয়ে আসছে আর অন্যদিকে মূল চরিত্রগুলো তাদের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যাবলী মোকাবেলা করে চলেছে। রুশদীর ভাষায় উপন্যাসের বেশিরভাগটাই এক অতি বাস্তববাদী উপন্যাস। এখানে আছে এক বাস্তব জগত এবং সে জগতে আছে বাস্তব মানুষ যারা তাদের বাস্তব ইহজাগতিক সমস্যাবলী মোকাবেলা করে চলেছে। রুশদী হলেন প্রথম পর্বের শিল্পীদের একজন যিনি তার সাহিত্যকর্মে ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হওয়া নিয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন। কিন্তু ট্রাম্পের সঙ্গে তার নিজেরই বহু দিক দিয়ে মিল আছে যা অনেকে হয়ত চিন্তাও করতে পারবে না। তারা দু’জনেই সংবাদপত্রের পাতায় ঘন ঘন আবির্ভূত হয়েছেন। পর্যায়ক্রমে হলেও তাদের একাধিক নারীর সঙ্গে বিবাহ হয়েছে। বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তাদের দু’জনেরই ঝগড়া বিবাদ হয়েছে এবং দু’জনেই জনপ্রিয় ছায়াছবিতে অভিনয় করেছেন। ট্রাম্প করেছেন হোম এলোন ২তে এবং রুশদী ‘ব্রিগেট জোন্সেস’ ডায়রিতে। অবশ্য দু’জনের এই তুলনা শুনে রুশদী হেসে উঠে বলেন ‘এই তুলনায় আমি আতঙ্কিত বোধ করছি। এমন অনেক কাকতালীয় ঘটনা আছে। রুশদী বলেন, ট্রাম্পের চাইতে আমি গ্রীক ট্র্যাজেডি নিয়েই বেশি ভাবছি। উপন্যাসটিতে বার বার এই প্রশ্ন এসেছে যে একই সঙ্গে কারোর পক্ষে শয়তান ও সজ্জন হওয়া সম্ভব কিনা। তিনি বলেন, এই উপন্যাসটির ৯৫ ভাগ তিনি মার্কিন নির্বাচনের আগেই লিখে ফেলেছিলেন। আর সে সময় পুরোপুরি আশা করেছিলেন যে ট্রাম্প জয়ী হবেন যদিও হিলারির প্রতি তার ব্যক্তিগত সমর্থন ছিল। তিনি বলেন, একদিন তিনি হলুদ রঙের এক ক্যাবে করে যাচ্ছিলেন। এক শিখ ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছিল। সে জানাল ট্রাম্পকে ভোট দেবে। রুশদী তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘কেন এ ধরনের একটা কাজ করবে?’ ড্রাইভার বলেছিল, ‘ওহ জনাব, মি. ট্রাম্প সোজাসাপটা কথার মানুষ। উনি আপনার ও আমার মতো লোকদের পছন্দ করেন না। যা বলার সরাসরি বলেন, রুশদী বলেন, ‘তখনই বুঝেছিলাম ট্রাম্পের জয় হতে যাচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘হিলারির জয় হলে তার গোটা পা-ুলিপি নতুন করে লিখতে হতো। আমি অতিমাত্রায় বিশ্বাস করতে চেয়েছিলাম যে ট্রাম্প জীয় হবেন না। কিন্তু আমার উপন্যাস ভেবেছিল অন্যরকম।’ ট্রাম্পের সঙ্গে রুশদীর দু’একবার দেখা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন এই ঔপন্যাসিক। ‘একবার কয়েক বছর আগে মেট্রোপলিটান ওপেরায় সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে আমার পাশ দিয়ে ধেয়ে যাচ্ছিলেন। আমাকে দেখে আঙ্গুল তুলে উল্লেখ করলেন ‘ও, তুমিই সেই লোক!’ আরেকবার রুশদী ইউএস ওপেন চলাকালে ট্রাম্পের কাছে গিয়েছিলেন। রুশদী বলেন, ‘তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন আমি টেনিসে আগ্রহী কিনা। বলেছিলাম হ্যাঁ, পছন্দ করি। উনি বলেছিলেন, ‘আমার বক্সটা সেরা। অন্য আর যে কোন বক্সের চেয়ে ভাল। ইউএস ওপেন এ যে কোন সময় তুমি আমার বক্সটা চাইলে নিতে পার। তোমাকে সানন্দে দিতে রাজি।’ রুশদী এই অফার নিতে রাজি হননি। এই উপন্যাসটির কথা যদি প্রেসিডেন্টের কানে যায় তাহলে কি করবেন এমন প্রশ্নের জবাবে রুশদী বলেছিলেন, তার টুইট পাওয়ার জন্য আগ্রহী হয়ে থাকব। এ উপন্যাসের জন্য যে কোন রকম আঘাত আসলে তা মোকাবেলায় যথেষ্ট প্রস্তুত তিনি। ‘মিডনাইটস চিল্ড্রেন’-এ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে চিত্রিত করার জন্য তার আইনী মামলা মোকাবেলা করেছিলেন রুশদী। ‘স্যাটানিক ভার্সেস‘ রচনার জন্য ১৯৮৯ সালে আয়াতুল্লাহ খোমেনীর কাছ থেকে মৃত্যুদ-ের ফতোয়া পেয়েছিলেন। ‘দি গোল্ডেন হাউজ’ আসলে আধুনিক আমেরিকায় বসবাসরত অভিবাসীর সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতার এক মহাকাব্য। ১৯৯৯ সাল থেকে রুশদী নিউইয়র্ক সিটিতে বসবাস করে আসছেন। এই নগরী তার কাছে বড়ই প্রিয়। কিন্তু সেই নগরী এখন নানাভাবে হুমকিগ্রস্ত হতে দেখে তিনি ব্যথিত। এর আগে চার দশক ইংল্যান্ডে বাস করেছেন। গত বছর মার্কিন নাগরিকত্ব লাভ করেছেন। তার কাছে এ দেশটির এক বড় আকর্ষণ বাকস্বাধীনতার সংস্কৃতি। ‘দি গোল্ডেন হাউজ’-এর বিষয়বস্তু ট্রাম্প নন। তার নাম একটি বছরের জন্যও উল্লেখ করা হয়নি। তথাপি আমেরিকার ৪৫তম প্রেসিডেন্ট এই গ্রন্থের ওপর বিশাল এক কালোছায়া বিস্তার করে আছেন। জোকার চরিত্রটির মধ্য দিয়ে রুশদী দেখিয়েছেন যে ইতিহাসে এমন কোন অগ্রগতি নেই যেটাকে নস্যাত করে দেয়া যায় না। ট্রাম্পের নির্বাচনের পূর্ববর্তী বছরগুলোর পটভূমিতে উপন্যাসটির যাত্রা শুরু করে রুশদী সম্ভবত, বলতে চেয়েছেন যে, ট্রাম্পের আবির্ভাব শূন্য থেকে ঘটেনি। রুশদীর নিজের ভাষায় : ‘কেন এ ধরনের একটা বই লেখা সম্ভব হয়েছে বলে আমি মনে করি তার একটা কারণ হলো ট্রাম্প যা কিছুর প্রতিনিধিত্ব করছেন এবং যা কিছু লেলিয়ে দিয়েছেন তার অনেক কিছুরই অস্তিত্ব আগে থেকেই ছিল। ওবামার যুক্তরাষ্ট্রের উত্থান ও পতনের ব্যাপারটা রুশদীর ভাষায় আশাবাদের মুহূর্ত থেকে তার বিপরীত মুহূর্তে যাত্রার মতো। এই ষিয়টিই তার মতে তার উপন্যাসকে কাঠামোগত ভারসাম্য দিয়েছে। তিনি বলেন তখন ও এখনকার মধ্যে একটা সুস্পষ্ট যোগসূত্র আছে। শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের একটা বড় অংশ সহ্য করতে পারছিল না যে আট বছর ধরে একজন কৃষ্ণাঙ্গ হোয়াইট হাউসে ছিলেন। আর তার মতে ‘দুর্ভাগ্যবশত’ হিলারি নির্বাচনের জন্য একজন বাজে প্রার্র্থী ছিলেন। তার প্রতি বামপন্থী লোকজন, তরুণ ও মহিলাদের একটা বড় অংশের যে অবিশ্বাস্য মাত্রায় ঘৃণা ছিল আমার মনে হয় আমিসহ প্রত্যেকেই সেটাকে যথেষ্ট খাটো করে দেখেছিলাম।’ তথাপি তিনি হিলারিকে ভোট দিয়েছিলেন। ভোট দিয়ে আসার পর টুইট করেছিলেন; ‘প্রেসিডেন্ট হিলারিকে দেখতে পাওয়ার প্রত্যাশায়।’ সেটাই ছিল হিলারির উদ্দেশ্য তার শেষ টুইট। রুশদীর উপন্যাসের চরিত্র জোকারটির যে জয় হবে তার মধ্যে কোন ম্যাজিক ছিল না। আট বছর আগে ওবামার জয়লাভের মধ্য দিয়ে যে বিষাদ উপন্যাসের শুরু হয়েছিল ২০১৬ সালে সেই জোকার চরিত্রটির বিজয়ের মধ্য দিয়ে সেই উপন্যাসটির সমাপ্তি ঘটেছে। সূত্র : টাইম ও অন্যান্য
×