ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

আক্তারুজ্জামান সিনবাদ

শিল্পকলা ॥ বাস্তবতার আয়না

প্রকাশিত: ০৬:৫২, ১৪ জুলাই ২০১৭

শিল্পকলা ॥ বাস্তবতার আয়না

‘শিল্প হলো একটা বস্তুগত ভাষা, যার শব্দগুলো দৃশ্যমান জিনিস-’ গুস্তাভ কুরবে। কুরবে ছিলেন একজন ব্যক্তিত্বশালী মানুষ ও সমাজ সচেতন শিল্পী। অতীত গৌরবের পরিবর্তে বর্তমান সমাজ ও সাধারণ মানুষের জীবন কাহিনীকে তুলে ধরাই একজন শিল্পীর কাজ বলে তিনি মনে করতেন। তাই তো সমাজের নিষ্ঠুর বাস্তবতাকে তিনি তার চিত্রমালায় মূর্ত করে তুলে ধরেছিলেন। তাঁর চিত্র ছিল সমাজ জীবনের ভাষ্য। আর তিনি ছিলেন একজন গতানুগতিক রীতির বোহেমিয়ান। তাই তো তাঁর ছবিকে অতিবাস্তব ও সমাজতান্ত্রিক বলে আখ্যায়িত করা হয়। তাঁর ছবির বিশেষত্ব হলো এই যে, তিনি চোখে যা দেখেছেন পটেও ঠিক তাই এঁকেছেন। কোন কিছু বৃহৎ করে, মহৎ করে দেখার চেষ্টা তিনি কোন দিন করেননি। তিনি ছিলেন সোশ্যালিস্ট তাই তাঁর আঁকার বিষয় ছিল স্টেশন, কারখানা, খনি, অন্নহীন দীন গ্রামবাসী, পাথর ভাঙ্গা মজুরের দল ইত্যাদি। তিনি সাধারণ মানুষ ও সাধারণ কাজকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করেছেন। ১৮৪৯-৫০ সালের মধ্যে তেল রঙে আঁকা ‘দ্য স্ট্রোন ব্রেকারস’ গুস্তাভ কুরবের একটি বিখ্যাত ছবি। বাস্তববাদী এ চিত্রটিতে এক ধরনের প্রতিবাদ লক্ষণীয়। আর কুরবে সচেতনভাবেই বিষয়বস্তুকে উপস্থাপনে গুরুত্ব দিয়েছেন। রাস্তার পাশে একটি কিশোর ও একজন বৃদ্ধের পাথর ভাঙ্গার দৃশ্য যা সাধারণ অর্থে সুন্দর নয়। কুরবে এ চিত্রে সমাজের শ্রমজীবী মানুষকে তুলে ধরেছেন। একজন বৃদ্ধ পাথর ভাঙছে আর একটি বালক পাথর খ- তুলছে। বৃদ্ধের কাজ করার সামর্থ্য নেই আর বালকের বয়স হয়নি। এমনি এক শ্রমকঠিন জীবনের একঘেয়ে বাস্তবতার আয়না এই চিত্র। দ্ররিদ্রতার সবচেয়ে সম্পূর্ণ অভিব্যক্তি এই চিত্রে ফুটে উঠেছে। পুরনো এক প্রাকৃতিক পরিবেশে একজন বয়স্ক মানুষ তার বাম পায়ের হাঁটু গেঁড়ে নিচু হয়ে পাথর ভাঙছে। তার হাতুড়ি উর্ধে উত্থাপিত। হাঁটুর নিচে খড়টুপি ও মাথায় হ্যাট। সূর্যের তাপে তার ত্বক শুকিয়ে গেছে। মাথাটি হ্যাট দ্বারা ছায়াময়। তার পরনে মোটা টাউজার্স জোড়াতালি দেয়া। তার জুতার নীল মুজা রঙ চটে হালকা হয়ে গিয়েছে। পেছনে দাঁড়িয়ে একটি যুবক। তার মাথা কালচে আচ্ছন্ন করে আঁকা। তার পরনে ছেড়া জামা। সামনে পাথরের টুকরোর ওপর কোদাল রাখা। যুবকের বাম পাশে শাবলসহ ঝুড়ি, তীব্র রোদ, পাশেই শান্তশীতল ছায়া। আছে চামচসহ খাবারের পাত্র। আলো-ছায়ার বৈপরীত্যে দারুণভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সমগ্র চিত্রপট। যুবকের চামড়ার পায়ে মোজা আটকিয়ে রাখার জন্য ফিতা বিশেষ পর্যন্ত পাজামার সঙ্গে বিশেষভাবে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। তার চামড়ার জুতাও খুব পুরনো। এমতাবস্থায় পাথর ভেঙ্গে রাস্তা নির্মাণের জন্য ভাঙ্গা পাথরের ঝুড়ি বহন করছে সে। তাদের শক্তিশালী পোক্ত হাত। বয়স্ক মানুষটির গতিহীন শরীর, যুবকটির কাঁধ নমিত। তার চাল চলন ভারি, তার প্যান্ট ঢিলেঢালা। অযতেœর দুর্বিপাক তাকে নিজের আগ্রহ ও যৌবনের উচ্ছ্বাসতা থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। যেন বেঁচেও বেঁচে নেই। দরিদ্র শ্রমিক, রুক্ষ্ম ব্রাশ স্ট্রোক, বৃহৎ আকারের ক্যানভাস, অনাগ্রহ দৃষ্টিভঙ্গি। তুলি চালানো ও প্যালেট নাইফের ব্যবহার তাঁর প্রয়োগকৃত রঙের মতোই অনুভূতি সম্পন্ন। সন্তোষজনক আলো-ছায়ার ব্যবহার, সরল দৃশ্যপট, সেই সঙ্গে সারফেসের গুরুত্ব ইত্যাদি লক্ষণীয়। তুলির টান, রচনা, লাইন এবং রঙের মধ্যে ঘনিষ্ঠ অন্তর্ভুক্তি পরিলক্ষিত হয়। সমসাময়িক শিল্পীদের তুলনায় তাঁর কাজ ছিল যথেষ্ট রূঢ়। ‘স্ট্রোন ব্রেকারস’ চিত্রে সচেতনভাবেই বিষয়বস্তুকে সরাসরি উপস্থাপন করেছেন টেকনিক ও কম্পোজিশনের মায়াজালে ফেলে। এ চিত্রে তিনি কোন প্রাচীন নায়কদের অবলম্বন করেননি। কুরবে বলেছিলেন ‘আমি শুধু একজন সোশ্যালিস্ট নই, আমি একজন ডেমোক্র্যাট এবং একজন রিপাবলিকান, সংক্ষেপে আমি সমগ্র বিপ্লবকেই সমর্থন করি এবং সর্বোপরি আমি সম্পূর্ণরূপেই একজন বাস্তববাদী। কারণ বাস্তববাদী হওয়ার অর্থ হলো সত্যের একজন সৎ বন্ধু হওয়া।’ কুরবের ‘স্ট্রোন ব্রেকারস’ দারিদ্র্যের মধ্যে জন্ম নিয়ে সারা জীবন তাদের দরিদ্র থাকা, বিশ্বস্ততার নির্দয় মাটি এবং কঠোর কর্মময় পরিবেশে আঁকা। ধূসর, সাদা এবং বাদামি রং প্যালেট কার্যকরভাবে তাদের কাজ, বিষণœ, একঘেয়ে এবং যান্ত্রিক প্রকৃতি বহন করে। চিত্রটি বুর্জোয়া আর সেই সঙ্গে তাদের একাডেমি শৈলী বিক্ষুব্ধ। শ্রমিকদের বালুকাময় বাস্তবতা দেখা যায় চিত্রটিতে। ক্যানভাসের সবচেয়ে উপরে ডান কোনে পাহাড়। যেখানে উজ্জ্বল নীল আকাশের একটি অতিক্ষুদ্র প্যাচ মন ছুঁয়ে যায়। প্রভাব এই শ্রমিক বিচ্ছিন্ন এবং সুপারিশ করার জন্য তারা শারীরিক ও অর্থনৈতিকভাবে আটকা পড়ে আছে। বাস্তব কি কুরবে তা দেখাতে চান? তাই তিনি একজন বৃদ্ধ মানুষ এবং একটি বালক যে এখনও তরুণ তাদের বীরত্বপূর্ণভাবে উপস্থাপন করেছেন। মধ্য শতাব্দীর ফরাসী গ্রামীণ জীবনের বঞ্চনার একটি সাধারণ ঘটনাচিত্র এটি। কুরবে মজুরদের পূর্ণাবয়ব প্রতিকৃতি এঁকে তাদের মর্যাদা এবং গুরুত্ব দিয়ে ব্যতীক্রম সৃষ্টি করেছিলেন। তাই তো ‘দ্য স্ট্রোন ব্রেকারস’ ছবিটি অন্যান্য রিয়ালিস্টদের কাছে আদর্শস্বরূপ ছিল। বিশেষ করে সেই সব রিয়ালিস্ট যাঁরা প্রগতিবাদী সমাজ ও রাজনৈতিক প্রচারের স্বার্থে কমবেশি স্বাভাবিক রূপকে ব্যবহারের কথা বলেন। সমাজবাদের অন্যতম একজন প্রবক্তা প্রুধো ‘স্ট্রোন ব্রেকারস’ ছবিটিকে ‘প্রথম সমাজতান্ত্রিক’ ছবি বলে চিহ্নিত করেন। স্বভাবসিদ্ধ দক্ষতায় ফিগার ও চরিত্র স্পষ্টতা নিয়ে চিত্রিত। যার মধ্যে ফুটে উঠেছে সাধারণ মানুষের অভাবি জীবনযাত্রার যন্ত্রণা।
×