ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন তার হিরো

সংগ্রামের ভাস্কর্য গড়তেও সংগ্রাম, অপরাজেয় আবদুল্লাহ খালিদ

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ২২ মে ২০১৭

সংগ্রামের ভাস্কর্য গড়তেও সংগ্রাম, অপরাজেয় আবদুল্লাহ খালিদ

মোরসালিন মিজান ॥ আজকের বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ মানে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।’ রণাঙ্গনে অস্ত্র হাতে যে লড়াই, জীবন বাজি রেখে যে সংগ্রাম, খুব একটা সামনে আসতে পারে না। গৌণ যারা, চেতনা আর চেতনার কথা বলে সামনের সারিতে জায়গা করে নিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে মুক্তিযুদ্ধকেই আড়াল করার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম প্রয়াস পরিলক্ষিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ভাস্কর সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদ কী অনুমান করেছিলেন, একদিন এভাবেই বদলে যাবে ফোকাস পয়েন্ট? হয়তবা ইতিহাসে তোমাদের নাম লেখা রবে না...। এমন শঙ্কা থেকেই কি তিনি কংক্রিটের ভাষায় মুক্তিযোদ্ধাদের ইতিহাস লেখার উদ্যোগ নিয়েছিলেন? তা না হলে সদ্য স্বাধীন দেশে অনেকেই যখন চাওয়া পাওয়ার হিসেব কষছিলেন আব্দুল্লাহ খালিদ তখন ভাস্কর্য গড়ায় মন দিয়েছিলেন। কেন? আগামী প্রজন্মের সামনে তাদের সত্যিকার হিরোদের উপস্থাপনের সচেতন চেষ্টা থেকেই কি গড়েছিলেন ‘অপরাজেয় বাংলা?’ কিংবদন্তি শিল্পস্রষ্টা আর নেই। নিভৃতচারী মহান ভাস্কর শনিবার রাতে চিরবিদায় নিয়েছেন। কিন্তু তার হয়ে ঠিক কথা বলছে ‘অপরাজেয় বাংলা।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ভাস্কর্যের দিকে গভীর মনোযোগসহকারে তাকালে নিশ্চিত উপলব্ধি হয়, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আব্দুল্লাহ খালিদকে বিপুলভাবে আলোড়িত করেছিল। অস্ত্রহাতে শত্রুর মোকাবেলা করা বীরদের অবদানকে তিনি সামনে রাখতে চেয়েছিলেন। অনুপ্রেরণার অনন্ত উৎস হিসেবে দেখতে এবং দেখাতে চেয়েছিলেন। একাত্তরের অর্জন, পূর্ব পুরুষের বীরত্ব বুকে ধারণ করবে পরবর্তী প্রজন্মÑ এমনটি ছিল তার চাওয়া। ভাস্কর্যটির দিকে সাদা চোখে তাকালে দেখা যায়, সেখানে দু’জন বীর মুক্তিযোদ্ধা। অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে। একজন গ্রামবাংলার প্রতিনিধি। অন্যজন শহুরে। টগবগে তরুণ। তাদের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছেন মহিয়সী এক নারী। তার সহযোগীর ভূমিকা। তিনটি ফিগার একত্রিত করলে জনযুদ্ধের ছবিটাই ফুটে ওঠে। গ্রাম শহর নারী পুরুষের সম্মিলিত শক্তির প্রতি সম্মান জানান ভাস্কর। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা ঐক্য ধরে রাখারও যেন আহ্বান জানান। বাঙালীর শিল্প সাহিত্য সঙ্গীত চারুকলার চর্চা কোন উৎসমূল ধরে এগোবে, বলে দেন সবার আগে। কংক্রিটের ভাষায় খালিদ বলা শুরু করেন ১৯৭২-৭৩ সালে। শেষ হয় ১৯৭৯ সালে। ৬ ফুট উঁচু বেদির ওপর ফিগারেটিভ কাজ। ফ্রি স্ট্যান্ডিং ভাস্কর্যের উচ্চতা ১২ ফুট। প্রস্থ ৮ ফুট। ৬ ফুট ব্যাস। সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে এটি অনেক বড় কাজ। এবং আজকের প্রেক্ষাপটেও। সংগ্রামের ভাস্কর্য গড়তেও সংগ্রাম করতে হয়েছে ভাস্করকে। ভাস্কর নিজ থেকে ভাস্কর্যে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের তুলে ধরার উদ্যোগ নেন। স্বাধীনতার পর থেকেই এমন একটি চিন্তা নিয়ে এগোচ্ছিলেন তিনি। তার চিন্তার সঙ্গে মিলে যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের চিন্তা। এগিয়ে আসে ডাকসুও। এভাবে প্রাথমিক শুরু বলে জানা যায়। ভাস্কর্যটি কী হবে মনের চোখে আগেই দেখেছিলেন খালিদ। কিন্তু মডেল ভাস্কর্য গড়তে তিনজন নারী পুরুষ চাই। চোখের সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাদের দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। কে রাজি হবে? খোঁজাখুঁজি শুরু করেন খালিদ। অনেক খোঁজাখুঁজির পর তিনজনকে খুঁজে বের করতে সক্ষম হন। একজন বদরুল আলম বেনু। তৃণমূলের মুক্তিযোদ্ধার মডেল করা হয় তাকে। শহুরে তরুণ মুক্তিযোদ্ধার মডেল হন সৈয়দ হামিদ মকসুদ। হাসিনা আহমেদ মডেল হন সেবিকার। সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করে আব্দুল্লাহ খালিদ বলেছিলেন, মডেল পাওয়া মোটেও সহজসাধ্য ছিল না। তার ওপর লম্বা সময় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার মতো ধৈর্য আছে এমন লোক খুঁজে বের করা ছিল কঠিন কাজ। এ অবস্থায় তিনজন মডেল দিনের বিভিন্ন সময়ে এলিফান্ট রোডের এ্যারোপ্লেন মসজিদের সামনে অবস্থিত একটি হোটেলে সিটিং দিতে থাকেন। এভাবে কয়েক মাস কাজ করার পর তৈরি হয় মডেল ভাস্কর্যটি। এর পর মূল কাজ শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে। কিন্তু বাঙালীর দুর্ভাগ্য, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নির্মম নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। মুক্তিযুদ্ধের মহানায়কের মৃত্যুতে ইতিহাসের চাকা উল্টো ঘুরতে শুরু করে। প্রভাব পড়ে খালিদের কাজেও। বন্ধ হয়ে যায় ‘অপরাজেয় বাংলা’র কাজ। সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ তার এক লেখায় উল্লেখ করেছেন, সামরিক শাসন আমলে একটা ট্যাংকের নল সবসময় অর্ধনির্মিত ‘অপরাজেয় বাংলা’র দিকে তাক করা থাকত। এ অবস্থায় কাজ বন্ধ ছিল টানা তিন বছর। ভাস্কর্যটি গড়ার স্বপ্ন তবু বুকে লালন করেন শিল্পী। আবেদন নিবেদন নিয়ে এর কাছে ওর কাছে ছুটে যান। ধারাবাহিকভাবে লেগে থাকার এক পর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আগ্রহে ১৯৭৯ সালের জানুয়ারি মাসে আবার শুরু হয় ভাস্কর্য নির্মাণের কাজ। শিশির ভট্টাচার্যের একটি স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, আব্দুল্লাহ খালিদ বিরতিহীনভাবে কাজ করতেন, অনেক সময় রাতেও লাইট জ্বালিয়ে কাজ চলত। কংক্রিট-ঢালাইয়ে অপরাজেয় বাংলার চরিত্রগুলোর অবয়ব পুরোপুরি ফুটে উঠেনি, ছেনি-হাতুড়ি দিয়ে অবয়ব-প্রতষ্ঠার কাজ করতে হয়েছে প্রায় এক বছর ধরে। জানা যায়, উগ্র মৌলবাদীদের সঙ্গেও ফাইট করতে হয়েছে ভাস্করকে। বিভিন্ন সময় ধর্মের দোহাই দিয়ে সৌন্দর্যের এই চর্চা বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। ৮০’র দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ধর্মান্ধ অংশটি ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলার দুঃসাহস দেখায়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পাকিস্তানী ভাবধারায় বিশ্বাসীরা গণস্বাক্ষর সংগ্রহ কর্মসূচী ঘোষণা করে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্র ছাত্রদের প্রতিরোধের মুখে টিকতে পারেনি অপশক্তি। এমনকি দুজনকে আটক করে উত্তম মধ্যম দেয়া হয়েছিল। মুখে চুন-কালি লেপে দেয়া হয়েছিল বলেও জানা যায়। এভাবে ভাস্কর্য গড়ার ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত হয় প্রতিবাদ প্রতিরোধের ইতিহাস। শেষ পর্যন্ত অপরাজেয় থাকেন সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদ। ডাকসুর তৎকালীন সাংস্কৃতিক সম্পাদক ম. হামিদ এ কাজের সঙ্গে লম্বা সময় ধরে যুক্ত ছিলেন। প্রতিকূল পরিস্থিতির কথা জানিয়ে তিনি বলেন, সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর অপরাজেয় বাংলা ভাস্কর্যটি নির্মাণে মৌলবাদী গোষ্ঠীর বাধা আসতে শুরু করে। কিন্তু সে সময় এটি নির্মাণ আমাদের জন্য একটি আন্দোলন ছিল। সে আন্দোলনে আমরা সব সময়ই অব্দুল্লাহ খালিদকে পেয়েছি সামনের সারিতে। তিনি কখনও মৌলবাদীদের কাছে মাথা নত করেননি। ১৯৭৯ সালে সম্পূর্ণ কাজ শেষ করে খালিদ। একই বছর ১৬ ডিসেম্বর ভাস্কর্যটির উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধন করেন একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। এভাবে ‘অপরাজেয় বাংলা’ গড়ার আগে পরের ইতিহাসের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সংশ্লিষ্ট করা হয়। ভাস্কর্যটি নির্মাণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে বাঙালীর মূল মন্ত্র হিসেবে উপস্থাপন করে গেছেন ভাস্কর। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস বীরত্বকে বুকে ধারণ করে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা হয়ে আছে তার অপরাজেয় বাংলা। আজ ‘অপরাজেয় বাংলা’ মানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। রাজধানী শহর ঢাকা। এবং অপরাজয় বাংলা মানে বাংলাদেশ! এই বাংলাদেশের জয় হোক।
×