ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নুরুল করিম নাসিম

গল্পের গোলটেবিল

প্রকাশিত: ০৬:৫৯, ১৭ মার্চ ২০১৭

গল্পের গোলটেবিল

সেদিন অভিনব এক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। একটি সাহিত্যপত্রিকা, বয়স প্রায় দু’বছর, গল্পের গোলটেবিলের আয়োজন করেছিল ঢাকার সেগুনবাগিচার একটি অডিটোরিয়ামে। ছোট ছিমছাপ কক্ষ, বিশ/তিরিশজন চতুষ্কোণ টেবিলের চারধারে বসতে পারে, সবার সামনে মাইক্রোফোন স্থাপন করা আছে। রাজনীতির জলজ্যান্ত সমসাময়িক বিষয় নিয়ে বিভিন্ন চ্যানেলে, বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা জমজমাট গোলটেবিলের আয়োজন করে থাকে। কমপক্ষে দশ থেকে পনেরো জন সেইসব গোলটেবিলে অংশগ্রহণ করেন। বহুমান্ত্রিক তর্ক-বিতর্কে ভরে উঠে আলোচনা। আবার চ্যানেলগুলো যেসব গোলটেবিল আয়োজন করে, সেখানে বড়জোর দু’জন থেকে চারজন আলোচক থাকেন। সেখানে তর্ক-বিতর্ক মাঝে মাঝে কলহে পরিণত হয়। সঞ্চালক বাধ্য হন দ্রুত সমাপ্তি টানতে। কিন্তু গল্পের গোলটেবিল একটু ভিন্নমাত্রার। সম্ভবত: ঢাকায়, তথাসারা বাংলাদেশে এ রকম গোলটেবিল আগে আমি শুনিনি, দেখিওনি। শিল্পসাহিত্য ও সংস্কৃতির কাগজ নতুনমাত্রা গত ৪ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার বিকেল ৪:৩০ মিনিটে (২০১৭) সাম্প্রতিক ধারার ছোটগল্পের উপর এই গোলটেবিলের আয়োজন করে। ঢাকা থেকে আরও যেসব সাহিত্যপত্রিকা প্রকাশিত হয় ‘কালি ও কলম’ শব্দঘর, উত্তরাধিকার, ইচ্ছে করলে এরাও এ রকম গোলটেবিলের আয়োজন করতে পারে। কবিতা পাঠের আসর এবং সাহিত্য-অনুষ্ঠান প্রায়শ: আমাদের চোখেপড়ে, কিন্তু সাহিত্যের এই শাখাটি নিয়ে ইদানীং কেউ খুব একটা মাথা ঘামায় না। ঢাকা থেকে ‘গল্পকার’, গল্পকথা, গল্পপত্র, বয়ান বের হচ্ছে। কিন্তু একমাত্র মোহাম্মদ মুহিউদ্দিন সম্পাদিত গল্পকার ছাড়া অন্যগুলো নিয়মিত নয়। গল্পকার শুরু থেকে প্রত্যেক ইংরেজী মাসের প্রথম সপ্তাহে পাঠকের হাতে পৌঁছে যায়। মনেপড়ে, সত্তর দশকে কামাল বিন মাহতাব (ক্যাপ্টেন) সম্পাদিত ‘ছোটগল্প’ বেশ ক’বছর নিয়মিত প্রকাশিত হতো। তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে পত্রিকাটিও হারিয়ে গেল। কবি আনওয়ার আহমেদ ‘কিছুধ্বনি’ নামে গল্পের পত্রিকা ও কবিতাবিষয়ক অন্য একটি সাহিত্যপত্র বের করতেন। সেসব আজ ইতিহাস। সেদিনের গল্পের গোলটেবিলে বেশ উপভোগ করেছিলাম। অনেকদিন পর, বলা চলে কয়েক দশক পরে, এই প্রথম গল্প নিয়ে আলোচনার আয়োজন করা হলো। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নির্বাহী সম্পাদক ড. ফজলুল হক তুহিন আশ্বাস দিলেন এ ধরনের গোলটেবিল শিল্পসাহিত্যের ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের উপর ভবিষ্যতে অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা। কবিতা নিয়ে নিয়মিত অনুষ্ঠানের কোন শেষ নেই। সেই তুলনায় ছোটগল্প নিয়ে তেমন কেনো কিছু হয় না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় গল্প সাহিত্যের খুব অবহেলিত একটি শাখা। গল্প না হলে কোন সাহিত্য পত্রিকা পরিপূর্ণ রূপ পায় না। দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকী গল্প ছাড়া অসম্পূর্ণ থেকে যায়। কিন্তু প্রায় অধিকাংশ সম্পাদকের অভিযোগ ছাপার মতো ভাল গল্প পাওয়া যায় না। হাতেগোনা দু’তিনজন গল্পকার ব্যতীত তেমন আর গল্পকার নেই। কেউ কেউ মনে করেন, কবিতার মতো গল্পও বৃত্তবন্দী হয়ে আছে। গল্পকে এই বৃত্তের ভেতর থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সেদিনের গল্পের গোলটেবিল বৈঠকে পঞ্চাশ দশকের প্রবীণ গল্পকার হাসনাত আব্দুল হাই ছিলেন, আবার শূন্য দশকের নবীন গল্পকার সাফি উল্লাহও ছিলেন। সত্তর দশকের গল্পকার হিসেবে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। আরও অনেকেরই থাকার কথা ছিল, কিন্তু থাকেননি। হতে পারে, তেমন একটা প্রচার হয়নি। আজকের এই ডিজিটাল যুগে আয়োজন করা ফেসবুকে খবরটি দিতে পারতেন। অনুষ্ঠানে সঞ্চালক ছিলেন মাসিক ‘গল্পকার’ পত্রিকার সম্পাদক মুহাম্মদ মুহিউদ্দিন। বাংলাদেশে গল্পবিষয়ক যেসব সাহিত্যপত্র আছে, মাঝেমধ্যে তারা এ রকম গোলটেবিলের আয়োজন করতে পারে। প্রত্যেক দশকের অন্তত: একজন কি দু’জন প্রতিনিধিত্বমূলক গল্পকার তাদের গল্পভাবনা এই গোলটেবিলে তুলে ধরতে পারলে পাঠক, সম্পাদক এবং গল্পকাররা উপকৃত হবেন। আগ্রহী প্রকাশককেও এ ধরনের অনুষ্ঠানে ডাকা যেতে পারে। তারা কেন ছোটগল্পের বই প্রকাশে ক্রমশ: আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন, সেসব গভীর গোপন কারণগুলো তাদের মুখ থেকে সরাসরি আমরা শুনতে পাবো। দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য সাময়ীকির সম্পাদকরাও তাদের অভিজ্ঞতা ও চিন্তাভাবনা জানাতে পারেন। সাম্প্রতিক ছোটগল্পের প্রবণতা নিয়ে সেদিন বেশ তর্ক-বিতর্ক জমে উঠেছিল। কিন্তু সময় ধার্য করা হয়েছিল খুব সীমিত। এ ধরনের অনুষ্ঠান কমপক্ষে দু’তিন ঘণ্টা ব্যাপ্তি দাবি করে, ১ ঘণ্টা নয়। সত্তর দশকে বাংলাদেশ বেতার দু’সপ্তাহে একদিন গল্পপাঠের আয়োজন করতো। আশির দশকের শুরুতে গল্পকার রশীদ হায়দার দর্শনীর বিনিময়ে গল্পপাঠের অনুষ্ঠান করেছিলেন। জনাব নুরুল ইসলাম প্রতি শুক্রবার গল্প প্রতিযোগিতার আয়োজন করতেন। দীর্ঘদিন তিনি এই অনুষ্ঠানটি চালিয়ে ছিলেন। এই সময়ের সৃজনশীল সাহসী মানুষদের এগিয়ে আসতে হবে, তা’ নাহলে গল্পচর্চা একটি বৃত্তের ভেতর নিরন্তর ঘুরপাক খেতে থাকবে।
×