ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ফেসবুক বন্ধুদের সামাজিক উন্নয়ন

বগুড়ায় আর্সেনিকমুক্ত সুপেয় পানির ব্যবস্থা

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ৫ মার্চ ২০১৭

বগুড়ায় আর্সেনিকমুক্ত সুপেয় পানির ব্যবস্থা

সমুদ্র হক ॥ রামেশ্বরপুর গ্রামের লোক ভাবতেও পারেনি অচেনা কয়েক তরুণ এসে আর্সেনিক মুক্ত সুপেয় পানীয়জলের ব্যবস্থা করে দেবে। একই রকম অবাক সাখারিয়া, চালিতাবাড়ি গ্রামের লোকজন। স্থানীয় পদ্ধতিতে ড্রিলিং করে মাটির গভীরে পাইপ বসানোর সময় কৌতূহলী লোকজনের প্রশ্ন; এই তরুণ- তরুণীরা কারা? একজনের উত্তর ফেসবুক ফ্রেন্ডস। শুনে তো ভ্রান্তি বিলাস। একজন বলল ‘ও ভাই ফেসবুক আবার এ্যাগলে করে নাকি, তাহলে তো ফেসবুক ওলাগেরক আরও খবর দেওয়া লাগবি।’ সিটিজেন জার্নালিজম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুক পর্দার আড়ালে থেকে সমাজের কল্যাণ ও উন্নয়নে দেশে দেশে নীরব বিপ্লব ঘটিয়ে চলেছে। মাঠ পর্যায়ে না দেখলে তা বোঝা যাবে না। তারই ছোট্ট উদাহরণ বগুড়া সদর ও পূর্বের গাবতলীর কয়েকটি গ্রাম। গাবতলীর রামেশ্বরপুর ও কাছাকাছি এলাকা সদরের শাখারিয়া চালিতাবাড়ির লোকজন কয়েক বছর ধরে আর্সেনিক ঝুঁকিতে বাস করছে। গ্রামের অনেক টিউবঅয়েল জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর (ডিপিএইচই) লাল রঙে সিল্ড করে দিয়েছে। এলাকার লোকজন সুপেয় পানির জন্য ব্যবহার করে কুয়ার পানি। সেখানেও বিপত্তি। মাটির নিচে গভীরের পানি না হলে আর্সেনিক মুক্ত হওয়া যায় না। এলাকার অনেক লোক আর্সেনিকোসিসে ভুগছে। খবরগুলো প্রকাশ হলে কর্তৃপক্ষ একটু নড়চড়ে বসে। তারপর যে অবস্থা সেই। এই জায়গাটিতেই এগিয়ে এসেছে ফেসবুক। বগুড়ার এক নারী সাংবাদিক নাসিমা সুলতানা ছুটু ফেসবুকে তার বন্ধু তালিকায় ১৮ বছর পর খুঁজে পেলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসমেট মেহেদী মাসুদ বিপুকে। তিনি স্কটল্যান্ডে থাকেন। ফেসবুকের বন্ধুর সংখ্যা বাড়ানোর নিয়মে বন্ধু হয় সিলেটের ইফতেশাম। থাকেন লন্ডনে। তারা মানুষের উন্নয়নে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে খবর সংগ্রহ করতে থাকে। সেই খবর ছড়িয়ে দেয়া হয় ফেসবুকে। গত বছর গড়ে তোলা হয় ‘প্রজন্ম বাংলাদেশ’ নামের সামজিক যোগাযোগ সংগঠন। বগুড়া অঞ্চলের খবর সংগ্রহ এবং কোন্ এলাকার মানুষের কি সমস্যা তা যোগাযোগ মাধ্যমে জানিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব পড়ে নাসিমা সুলতানা ছুটুর ওপর। তারপর বগুড়া ও সিলেট অঞ্চলের মানুষের সমস্যার খবর ফেসবুকে ছবিসহ পোস্ট হতে থাকে। ইফতেশাম লন্ডন থেকে ও মেহেদী মাসুদ বিপু স্কটল্যান্ড থেকে তাদের রোজগারের কিছু অর্থ রেখে দেয় সামাজিক উন্নয়নে। এ ছাড়াও ফেসবুকের অন্যান্য বন্ধু সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় । বগুড়ার গ্রামগুলোতে আর্সেনিক মুক্ত পানির ব্যবস্থায় কি ধরনের টিউবঅয়েল বসাতে হবে, তার খরচ কত পড়বে, রক্ষণাবেক্ষণ কারা করবে এসব বিষয় নিয়ে প্রকল্পের মতো করে সাজানো হয় প্রজেক্ট প্রোফাইল। তা ই-মেলে পাঠানো হয় বিদেশে ফেসবুক বন্ধুদের কাছে। এর পর বাস্তবায়নের পালা। নাসিমা সুলতানা ছুটু ডিপিএইচই’র প্রকৌশলীকে নিয়ে গ্রামে গিয়ে পরীক্ষা করিয়ে নেন মাটির কতটা গভীরে গেলে আর্সেনিক মুক্ত পানি পাওয়া যাবে। কি ধরনের টিউবঅয়েল বসাতে হবে। প্রকৌশলীর রিপোর্ট অনুযায়ী উন্নতমানের টিউবঅয়েল ও পাইপ কিনে গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। ভূগর্ভের যত মিটার নিচে পাইপ বসানো দরকার তত মিটারই ড্রিলিং করে বসানোর সিদ্ধান্ত হয়। রিপোর্ট অনুযায়ী প্রথমে রামেশ্বরপুরের গ্রামে ৮০ মিটার নিচেই সুপেয় নিরাপদ পানির আধার খুঁজে পাওয়া যায়। ছুটু টিউবঅয়েল, পাইপ আনুষঙ্গিক জিনিস এবং বসানোর মিস্ত্রি ও যোগানদার নিয়ে প্রথমে রামেশ্বরপুরের কমরছট্ট গ্রামে যান। গ্রামের লোক তো অবাক। দেনদরবার করে যে টিউবঅয়েল পাওয়া সহজ হয় না, অথচ কয়েক তরুণ টিউবঅয়েল, পাইপ, মিস্ত্রি ও জিনিসপত্র নিয়ে গ্রামে উপস্থিত। গ্রামের মুরব্বিদের ডেকে বৈঠক করে কোন্ জায়গায় টিউবঅয়েল বসালে গ্রামের বেশি লোকের পানি প্রাপ্তি সহজ হবে তেমন জায়গা বেছে নেয়া হয়। গ্রামের মুরব্বিরা জায়গা নির্ধারণ করে দেন। টিউবঅয়েল বসানোর কাজ শুরু হয়। গ্রামের লোক যেভাবে পারে সহযোগিতা দেয়। এই টিউবঅয়েলে ওই এলাকার তিনশ’ পরিবার উপকৃত হয়। এর পরই বগুড়া সদরের শাখারিয়া ও চালিতাবাড়িতে একইভাবে লোকজনকে উদ্বুদ্ধ করা হয়। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বররা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। সেখানেও দুটি টিউবঅয়েল বসিয়ে দেয় ফেসবুকের বন্ধুরা। এই এলাকাতেও ৮০ থেকে ৯০ মিটার নিচে পাইপ বসানো হয়। ওই এলাকার অন্তত ৮শ’ পরিবার উপকৃত হয়েছে এই টিউবঅয়েল পেয়ে। এরপর খোঁজ চলে গ্রীষ্মের সময় কোন্ কোন্ এলাকার লোকজন পানির কষ্টে ভোগে। সেই এলাকার খবরাখবর সংগ্রহের কাজ ইতোমধ্যেই হয়ে গেছে। নাসিমা সুলতানা জানালেন, শুধু সুপেয় পানির আধার বের করে টিউবঅয়েল স্থাপনের মধ্যেই তাদের কাজ সীমাবদ্ধ নেই। গ্রামের অবকাঠামো উন্নয়নে ফেসবুক বন্ধুরা যতটা পারে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। শীত মৌসুমে তারা কম্বল বিতরণ করেছে। যে এলাকায় জলাবদ্ধতা লোকজনের পারাপারের অসুবিধা বেশি সেখানে কি করা যায় তা নিয়ে ভাবা হচ্ছে। বগুড়া ও সিলেটের এসব খবর পৌঁছে যাচ্ছে ফেসবুক বন্ধুদের কাছে। দুই হাজার সালের ৪ ফেব্রুয়ারি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মার্ক জাকারবার্গ কয়েক বন্ধু মিলে শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগের ফেসবুক ডটকম নামের যে ওয়েবসাইট চালু করেন তা এখন বিশ্বজুড়ে সামাজিক যোগাযোগে অসাধারণ বিপ্লব ঘটিয়েছে। ফেসবুক বন্ধুরা এখন দেশে দেশে মানুষের কল্যাণে কাজ করছে। পিছিয়ে নেই বাংলাদেশও। একের দেখাদেখি অন্যরা এগিয়ে আসছে।
×