ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

কবি আবুল হাসান ও নির্মলেন্দু গুণ ॥ আত্মখননের সিসিফাস

প্রকাশিত: ০৬:২৩, ৩ মার্চ ২০১৭

কবি আবুল হাসান ও নির্মলেন্দু গুণ ॥ আত্মখননের সিসিফাস

আবুল হাসান ও নির্মলেন্দু গুণ ষাটের দশকের কবি। তারা ছিলেন কবি এবং বন্ধু- ‘একই জীবনের ভিন্ন প্রকাশ’। মেধাবী ছাত্র হিসেবে ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু দু’জন যত না ছাত্র ছিলেন তার চেয়ে বেশি ছিলেন কবি। প্রথাগত লেখাপড়া সিঁকেয় তুলে শুরু করলেন অপ্রথাগত পাঠ। উন্মূল উদ্বাস্তু যৌবনের দিনগুলোয় কাটে সীমাহীন আড্ডা আর নেশায়। দু’জন কবিতা খুঁজলেন হাঁটলেন চষলেন ঢাকার অলিগলি, নিষিদ্ধ পল্লী, ইন্টারকম, হাসপাতাল, রেডিও, টিভি, পত্রিকা অফিস, সাহিত্য আসর, ময় চোলাই খানায়। এ সময় আমেরিকান বিটনিকদের ‘ঘড়’ি-এর ‘অশালীন’ উচ্চারণগুলো যখন নিয়ম ভাঙ্গার যতেœ তরুণ কবিদের অর্কেস্ট্রায় শোনাচ্ছিল বিটোফেন মোজার্ট, পল রবসন, লেলন, হ্যারিসের কণ্ঠ। তখন ঢাকার হাত উঁচুতে ছিলেন কবি আবুল হাসান ও নির্মলেন্দু গুণ। তারা খুঁজলেন ফস্টাস, নের্ভাল, বোদলেয়ার, র‌্যাবোঁ, কপার্ট ব্রুক, ডিলান টমাস, রবার্ট লোয়েল, সিলভিয়া প্লাথ, গিনসবার্গকে। আর চিত্রধ্যানের জন্য মাতিস, সেজান ডালি, পিকানো, ভ্যানগগ, ম্যাকস্ এনসট্, মার্ক শাগালকে। আদর্শের জন্য মাও সেতুং, হো চি মিন, যে গুয়েভারা, ফিদেল ক্যাস্ট্রো, সার্ত্রে, কাফকা, জাঁ জিনেকে। ‘তোমরা ঈশ্বরকে ফিরিয়ে নাও’, ‘ভালো থাকার যাতনা বুঝি’, দুঃখগুলো কবিতার সাথে’- শব্দগুলো যখন দু’জন কবিকে চিনে রাখার জন্য যথেষ্ট নয় তখন ঘোষণা হলো ‘আমরাই একমাত্র কবি’ অর্থাৎ আবুল হাসান এবং নির্মলেন্দু গুণ। সত্যি তারা দু’জন মিলে আধুনিক কবিতাকে নিয়ে গেলেন সমাজ, রাজনীতি, মানুষ ও সমকালকে সত্যের এক উন্মূল চোখের শাণিত স্বরে; কবিতার উচ্চারণে শিল্পের রীতি যেখানে ভারমুক্ত ছিল না সেখানে তাদের নগ্ন বাহুর অতসিরা অনাদী ও অন্তর করে পাঠককে কবিতার কাছে এনে দিয়েছে শিল্পভাবনার অতল। নির্মলেন্দু গুণ ভাষাকে কবিতার জন্য ব্যবহার করেছেন সহজ উচ্চারণে। কিন্তু মানুষ দুর্বলের দিকে তাকিয়ে যখন আকাশের ভাবনায় নত হয়েছে তখন কবির ‘প্রেমাংশুর রক্ত’ ভাবনা আকাশের মতোই ক্রুদ্ধ, মিষে গেছে সেই আকাশে। সে ভাবনা যেমন নৈরাশ্য, অনিকেত শব্দগুচ্ছের প্রসূন খচিত; তবু কবির জয়যাত্রা ভাল থাকার জন্য নয়Ñ মানুষের জন্য ভাল থাকার জয়যাত্রা- তখন ভাল থাকার যাতনা কবির কাছেই আসলে অব্যক্তিক। কিন্তু সেখানে নষ্ট, বোহেমিয়ান, নিঃসঙ্গ আবুল হাসানের কলমে উঠে আসে ‘সাধু হে আনন্দ দাও’ অথবা ভালবাসার যাতনায় ‘ঝিনুক নীরবে সহো’। এও যে রক্ত মানুষের কথা। ‘অন্তরে বিরাগী বৈরাগী কবি ছিলেন আবুল হাসান।’ বরিশালের মেয়ে সুলতানা রাজিয়া খোন্দকারকে ভালবেসেছিলেন। ‘রাজিয়া রংয়ের রাজহাঁসে’ ঘর হয়নি তার। প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন। পরে মেধার শিক্ষিত, সুন্দরী সুরাইয়া খানমকে ভালবেসেছিলেন। কবি নির্মলেন্দু গুণের সহচর হয়ে গেলেন ‘নিষিদ্ধ পল্লী হয়ে গুলিস্তান’। হয়ত অভিমানে থেকেছেন ‘প্রেমিকের প্রতিদ্বন্দ্বী।’ কিন্তু নিশ্চিত জীবন অবধি নারীর প্রেমে থেকেছেন আন্তশীল তপস্যি।তাইতো কবিরা মনীষার কাছে থেকে যান ঋদ্ধিমান ও সন্ত। কবি আবুল হাসানও তাই। ১৯৭০ সালে নির্মলেন্দু গুণের ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ প্রকাশের পর বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। অল্প সময়ে বইয়ের সাধু সন্ত কবি নির্মলেন্দু গুণ তরুণ কবিদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এসব তরুণ ‘সোনাগাছি’দের ঝোলা ব্যাগে উড়ছে গিনসবার্গ, বোদলেয়ার, র্যাঁবো, ভের্লেন, ফস্টাস, নের্ভাল, কপার্ট ব্রুক, ডিলান টমাস, রবার্ট লোয়েন, সিলভিয়া প্লাথ। তারা নির্মলেন্দুর ‘হুলিয়া’কে একটি সিপটিকি টেলেমেকাসে পাঠ সারেন। একই বছর বন্ধুকবি আবুল হাসানের ‘শিকারী লোকটা’র এশীয় কবিতা উৎসবের প্রথম পুরস্কার তাকেও গৌরবের অংশীদার করে। গুণের ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’র দুই বছর পর অর্থাৎ ১৯৭২ সালে আবুল হাসানের প্রথম কাব্য ‘রাজা যায় রাজা আসে’ প্রকাশ পায়। বইটি প্রকাশের অল্প সময়ের মধ্যে সব কপি নিঃশেষ হয়ে যায়। বাংলা ভাষার এই দুই কবির কবিতা এখনও সমানভাবে রাজত্ব করে চলেছে। বলা হয়ে থাকে, ‘জীবনানন্দের পর এ দেশে নির্মলেন্দু গুণ ও আবুল হাসানই পরবর্তী কবিদের সবচেয়ে অনুস্মরণীয় কবি।
×