ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

মিলু শামস

প্রকাশনা শিল্প এবং বইয়ের মান

প্রকাশিত: ০৩:৩৮, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

প্রকাশনা শিল্প এবং বইয়ের মান

কলকাতা বইমেলা এক বিশাল সমুদ্র। যেমন আয়তনে তেমনি গুণগত মানে। সব ধরনের পাঠককে তৃপ্ত করার পরিকল্পিত আয়োজন নিয়ে সাজানো হয় এ মেলা। প্রয়োজনীয় যে বইটির অনুসন্ধান মনে থাকে তা ঠিকই পাওয়া যায় কোন না কোন স্টলে। রয়েছে একাধিক ভিন্ন ভাষার বই। ক্লাসিক গল্প উপন্যাস অনুবাদ তো আছেই। পাবলিশার্স গিল্ড আয়োজিত একচল্লিশতম মেলা এটি। বিশাল পরিসর। লাল নীল হলুদ ইত্যাদি ছ’টি রঙের নামে ছ’টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে পুরো মেলা। প্রথমে নীল ব্লক। এর দ্বিতীয় হলটির নামকরণ হয়েছে বাংলাদেশের কবি সৈয়দ শামসুল হকের নামে। প্রথমটি মহাশ্বেতা দেবীর নামে। মাত্র দশ দিনের আয়োজন। কিন্তু সঠিক পরিকল্পনা এবং বইয়ের গুণগত মানের নিশ্চয়তা একে পৃথিবীর সেরা বইমেলাগুলোর একটির মর্যাদা দিয়েছে। যে মর্যাদায় আসীন হওয়া উচিত ছিল বাংলাদেশের বাংলা একাডেমি আয়োজিত একুশে বই মেলারও। কারণ এ দেশের জন্মই হয়েছে বাংলা ভাষার ওপর ভিত্তি করে। সেদিক থেকে বিচার করলে নিজেদের দৈন্যে লজ্জিত হতে হয়। এক মাস দৈর্ঘ্যরে একটা মেলা হয় ঠিকই। সেখানে বিভিন্ন প্রকাশনীর চোখ ধাঁধানো উপচে পড়া অসংখ্য বইও শোভা পায় কিন্তু মানসম্পন্ন বই ক’টি? যার যা মনে হচ্ছে তাই দিয়ে ঝকঝকে মোড়কের বই নিয়ে মেলায় হাজির হচ্ছে। এতে বইয়ের সংখ্যা যত বাড়ছে তত কমছে গুণগত মান। মান নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি এত বছর পরও নিশ্চিত হলো না। খোলা আকাশের নিচে এ মেলায় ঘুরতে ভাল লাগলেও কাক্সিক্ষত মানসম্পন্ন বই পাওয়া যত দিন যাচ্ছে ততই যেন অসম্ভব হয়ে পড়ছে। প্রকাশনায় ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার গত শতকের নব্বই দশক থেকে এ শিল্পকে এদেশে আমূল বদলে দিয়েছে। প্রকাশনার পেছনের কাজ কমিয়ে দিয়েছে। খুব অল্প সময়েই বাজারজাত করা যাচ্ছে উৎপাদিত বই। এতে প্রচুর বই বাজারে আসছে। প্রকাশনার মান বেড়েছে। প্রকাশকের সংখ্যা বেড়েছে। অনেক শিক্ষিত তরুণ আগ্রহী হচ্ছেন এ পেশায়। দেশ ভাগের পর বাংলা প্রকাশনার জগতে যে শূন্যতা এসেছিল ভাষা আন্দোলন তাতে গতি এনেছে। ভাষা আন্দোলন জন্ম দিয়েছিল কিছু তরুণ সৃজনশীল সাহিত্যিক। তাদের লেখা প্রকাশে প্রকাশনা শিল্প যেমন প্রাণ পেয়েছিল তেমনি পাঠকও পেয়েছিলেন সমৃদ্ধ সাহিত্য। স্বাধীনতার পর নানা সঙ্কট পেরিয়ে প্রকাশনা শিল্প এগিয়ে চললেও নব্বই দশক থেকে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার এক ধাপে একে এগিয়ে দিয়েছে অনেক বছর। এতে প্রকাশনা শিল্প বাংলাদেশে শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছেছে। কিন্তু সাহিত্যের অবস্থান শক্তিশালী হয়নি। এ সময় থেকে বিশ্বে অর্থনীতিসহ নানা ধরনের পরিবর্তনও প্রকাশনা শিল্পের প্রেক্ষাপটকে নানা মাত্রায় উন্মোচিত করেছে। টেলিভিশনের ঝড়ো হাওয়ার ঝাপটায় চেনা পরিবেশ কেমন যেন অচেনা হয়ে উঠছিল। তথ্য প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশে এরপর বার বার প্রশ্ন উঠেছে বই কি হারিয়ে যাবে? ভেঙ্গে পড়বে কি প্রকাশনা শিল্পের ভিত? সব আশঙ্কা পাশ কাটিয়ে প্রকাশনা শিল্প টিকে আছে। প্রকাশকরা আশাবাদী যতদিন মানুষ থাকবে বইও থাকবে ততদিন। বই কখনও হারাবে না। তথ্যপ্রযুক্তি প্রকাশনার শত্রু নয়। বরং এর সহায়তা নিয়ে বইয়ের উৎপাদন মান দিন দিন আরও উন্নত হবে। আজকের একটি সাধারণ প্রকাশনার প্রকাশিত বই আর বিশ-পঁচিশ বছর আগে প্রকাশিত বইয়ের তুলনা করলে পার্থক্য পরিষ্কার হয়ে যায়। মানুষের কেনার ক্ষমতাও বেড়েছে আগের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি। সব ঠিক আছে। কিন্তু ভেতরে বিষয়বস্তুর মান না বাড়লে পাঠক কি বই কিনবেন? অনেক সময়ই শোনা যায় বই বিক্রি আশানুরূপ হচ্ছে না। তরুণরা বই পড়ছে না। তরুণরা হয়ত তথ্যপ্রযুক্তির দিকে বেশি ঝুঁকেছে। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পড়ছে না বলে তাদের অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর আগে এটাও দেখা উচিত তারা কি পড়বে? তাদের পড়ার উপযোগী বই কি বাজারে প্রচুর পাওয়া যাচ্ছে? আবোল তাবোল বই দিয়ে তো এখনকার চৌকষ তরুণদের খুশি করা যাবে না। সংখ্যার দিক থেকে প্রচুর বই বাজারে আসছে কিন্তু গুণগত মানের জায়গাটা প্রসারিত হয়নি। বইয়ের প্রচ্ছদ, ছাপা, বাঁধাই দেখে চোখ জুড়িয়ে যায় কিন্তু মলাট খুলে বেশি দূর এগোনো যায় না। পড়ার উপাদান থাকছে খুব কম বইয়ে। তাত্ত্বিক আলোচনা বা ভাবগম্ভীর বিষয়বস্তুই যে ভাল বই এর পূর্বশর্ত তা নয়। আকৃষ্ট করার কিছু না কিছু আধুনিক উপকরণ না থাকলে পাঠক কেন বই কিনবেন। বিপণনের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। একটা সময় ছিল যখন পাঠক ছিল বইয়ের প্রতি একনিষ্ঠ। সেই পাঠকের চারপাশে বই ছাড়াও এখন আগ্রহের অনেক এলাকা তৈরি হয়েছে। তার সামনে বই তুলে ধরার কৌশলেও পরিবর্তন আনা দরকার। পাঠক ব্যস্ত। তার মন বিক্ষিপ্ত। কিন্তু যিনি প্রকাশনা খুলেছেন ব্যবসার জন্য তাকে তো পুরোপুরি পেশাদার মনোভাব নিয়েই এগুতে হবে। লেখক এবং পাঠক তৈরিতে প্রকাশকেরও ভূমিকা আছে। পশ্চিমবঙ্গের অনেক প্রকাশক এক সময় সে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাদের উত্তরসূরিরা অনেক বেশি ব্যবসা সচেতন। অনেক স্পষ্টবাদী। তারপরও তাদের সব কথার সার কথা লেখক। ভাল লেখা। মান সম্পন্ন বিষয়বস্তু। কোলকাতার দে’জ পাবলিশিং হাউসের কর্ণধার অপু দে এক সাক্ষাতকারে বলছিলেন, ‘অডিও ভিস্যুয়ালের যুগে মানুষ সব কিছু ড্রয়িংরুমে বসে পেতে চান। সাবান, তেলসহ বিভিন্ন কনজ্যুমার ডিউরেবল যেভাবে মানুষের বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছে যাচ্ছে, বইকেও একই পথে হাঁটতে হবে, কারণ সেটাও একটা পণ্য।... প্রকাশনা আর পাঁচটা ব্যবসা থেকে আলাদা, তাদের নৈতিক দায়িত্ব অনেক বেশি এই তত্ত্বকথা শুনতে ভাল, কিন্তু অস্তিত্বের প্রশ্নে মেনে চলা কঠিন। আজকের মুক্তবাজারে লড়াইয়ে টিকে থাকতে গেলে গোঁড়ামি ভেঙ্গে পণ্যকে ভোক্তার কাছে পৌঁছে দিতে হবে এটাই সাফ কথা। যাঁরা প্রকাশনা জগতের মূল কারিগর অর্থাৎ লেখকদের এই সময়কে ভাল করে উপলব্ধি করতে হবে’। প্রকাশনা শিল্প যত উন্নত হোক বইয়ের বিষয়বস্তু ভাল না হলে এক সময় সেখানেও ধস আসবে। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবার সময় এসেছে।
×