ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ভাগ্যের সন্ধানে বিদেশে ছুটছে নারী, জয় করছে সব বাধা

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ২১ ডিসেম্বর ২০১৬

ভাগ্যের সন্ধানে বিদেশে ছুটছে নারী, জয় করছে সব বাধা

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ ফরিদপুরবাসী আয়েশা বেগম আর কিছুদিনের মধ্যেই দুই বছরের জন্য সৌদি আরবে পাড়ি জমাবেন। স্বামী ও দুই সন্তানকে রেখেই তিনি নিজ ইচ্ছায় বিদেশ যাবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সংসারে আর্থিক সচ্ছলতা আনতেই নাকি বিদেশ যেতে চাচ্ছেন তিনি। ‘কতটা কষ্টে থাকলি, মানুষ নিজ দেশ ছাইড়ে বিদেশ যাতি চাই। আমার স্বামী কহনও (কখনও) আমার আর ছাওয়াল-মিয়ার (ছেলে-মেয়ের) খোঁজখবর রাহে (রাখে) না। কোন কাজ কর্মও করে না, সারাদিন ঘুরে বেড়ায়। আমার দুই পোলাপানরে মানুষ করার জন্যই আমি বিদেশ যাচ্ছি। হনে (সেখানে) গিয়ে মানষের বাড়িতে কাজ করে ১৮ হাজার টাহা করে পাব। ওই টাহা বাড়িত পাঠাইলে আমার দুই পোলাপাইন ভালভাবে মানুষ হতে পারব।’ ৩০ বছর বয়সী আয়েশা বেগম অনেকটা বাধ্য হয়েই বিদেশ যাওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানালেন। মূলত সংসারে আর্থিক সচ্ছলতা আনতে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও আয়েশার মতো অনেক নারীই বিদেশগামী হচ্ছেন। ১৯৯১ সাল থেকে শুরু করে ২০১৬ সালের নবেম্বর মাস পর্যন্ত এই আড়াই দশকে বিদেশ পাড়ি দিয়েছেন পাঁচ লাখ ৬৪ হাজার ৭৫৬ নারী। যার মধ্যে এ বছরের নবেম্বর মাস পর্যন্ত পাড়ি জমিয়েছেন এক লাখ ৮ হাজার ৭৬৯ জন। গত বছর এক লাখ ৩ হাজার ৭১৮ নারী বিদেশ গিয়েছিলেন। তাদের অনেকেরই ভাগ্য বদলেছে। আবার অনেকেই খালি হাতে প্রাণ নিয়ে ফিরে এসেছেন। তারপরও বাংলাদেশের কর্মঠ নারী শ্রমিকেরা তাদের ভাগ্যের সন্ধানে প্রতিদিনই বিদেশ পাড়ি দিচ্ছেন। তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসছে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, বর্তমানে ১৬০ দেশে প্রায় ৯০ লাখ বাংলাদেশী শ্রমিক কাজ করছেন। যেখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী শ্রমিকও রয়েছে। গত ১০ বছরে বিভিন্ন দেশে নারী শ্রমিক রফতানি বেড়েছে সাত গুণ। ১৯৯১-২০০৩ সাল পর্যন্ত এক যুগে ১৯ হাজার ২৩৯ নারী বিদেশ গিয়েছেন। সেখানে ২০০৪ সালেই বিদেশে নারী শ্রমিক যাওয়ার হার বেড়ে যায় পাঁচ গুণ। ২০০৮ সালে এই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ২০ হাজার ৮৪২ জনে। ২০১৫ সালে নারী বিদেশগামীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ৩ হাজার ৭১৮ জনে। চলতি বছরের নবেম্বর মাস পর্যন্ত বিদেশ গিয়েছেন ১ লাখ ৮ হাজার ৭৬৯ জন। গত বছরের তুলনায় এ বছর প্রায় ৬ হাজার নারীকর্মী বিদেশ পাড়ি জমিয়েছেন। গাজীপুরের মেয়ে রোজিনা খাতুন আঙুলের ছাপ দিতে হাজির হয়েছেন প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে। সেখানেই কথা হলো তার সঙ্গে। দুই বছর আগে ৩০ হাজার টাকা খরচ করে জর্দানে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে যান তিনি। চলতি বছরে ছয় মাসের জন্য ছুটিতে দেশে ফিরে আসেন রোজিনা। ছুটি কাটিয়ে নতুন ভিসায় তিনি আবার দুই বছরের জন্য ফিরে যাচ্ছেন জর্দান। বললেন, ‘হেনকার (সেখানকার) ম্যাডাম ও স্যার খুবই ভালা (ভালো) মানুষ। আমি তাগো (তাদের) সঙ্গেই থাকি। প্রথম যহন (যখন) গেছিলাম, একটু ডর (ভয়) করত। এহন (এখন) আর কোন ডর নাই। বাসার কাজকর্মই করতে হয়। তাগো (তাদের) বাসাতেই আবার কাজে যামু (যাব)।’ স্বামী ছেড়ে যাওয়ার পর এক মেয়ে নিয়ে বিপাকে পড়ে যান রোজিনা। অবশেষে জনশক্তি রফতানিকারকদের স্থানীয় প্রতিনিধির সাহায্যে সরকারীভাবে প্রশিক্ষণ নিয়ে সার্টিফিকেট পাওয়ার পর জর্দানে পাড়ি জমান তিনি। তার অনুপ্রেরণায় এলাকার অন্যান্য নারীও বিদেশ যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছেন বলে জানালেন রোজিনা। নারীকর্মী রফতানি বাড়ার পেছনে মূল কারণটি হলো কম খরচে বিদেশ যাওয়ার ব্যবস্থাসহ থাকা-খাওয়া ও চিকিৎসা ব্যয়ের নিশ্চয়তা। নারী জনশক্তি রফতানি বাড়াতে ঢাকাসহ দেশের ৬ বিভাগীয় শহরে ৬ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ‘হাউজকিপিং’র প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। সৌদি আরব, জর্দান, লেবানন, দুবাই, আবুধাবি, কাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কিছু দেশে গৃহশ্রমিকের চাহিদা থাকায় বাংলাদেশের নারীরা স্বাচ্ছন্দ্যে সেসব দেশে গিয়ে কাজ করতে সক্ষম হচ্ছে। জনশক্তি, প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান ব্যুরোর (বিএমইটি) সাম্প্রতিক তথ্যে দেখা গেছে, ২০১৫ সালে সৌদি আরবে গেছেন মোট ২০ হাজার ৯৫২ নারী। সেখানে চলতি বছরের নবেম্বর মাস পর্যন্ত গিয়েছেন ৬০ হাজার ৯১৬ নারী। এই হার গত বছরের চেয়ে আড়াইগুণ বেড়েছে। এছাড়া চলতি বছরের নবেম্বর মাস পর্যন্ত জর্দানে ২০ হাজার ৭৬৩ জন, ওমানে ১১ হাজার ৮৭৫ জন, কাতারে ৫ হাজার ৭৩ জন, আরব আমিরাতে ৪ হাজার ৭৪৫ জন, লেবাননে দুই হাজার ৩১৬ নারীকর্মী পাঠানো হয়েছে। বিদেশে পাড়ি জমানো নারীদের বেশিরভাগই গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। এছাড়া কিছু নারী যাচ্ছেন গার্মেন্টসকর্মী হিসেবে। জর্দানে বর্তমানে প্রায় ১০ হাজারেরও বেশি নারীকর্মী পোশাক শিল্প খাতে কাজ করছেন। জনশক্তি, প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান ব্যুরোর এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, বিদেশে যেসব নারী গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে যাবেন, তাদের ন্যূনতম বেতন হবে ১৬ হাজার টাকা। ওভারটাইমসহ বেতন ২০ হাজার টাকায় দাঁড়াবে। চাকরির মেয়াদ হবে দুই বছর। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মোবাইলের মাধ্যমে সবসময় যোগাযোগ রাখতে পারবে। এছাড়া বিদেশে কর্মীদের পাঠানোর আগে যে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে তার খরচ সরকারই বহন করবে। ইতোমধ্যেই বিদেশগামী নারীকর্মীর সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। যদিও নারী শ্রমিকরা বিদেশে কাজ করার ক্ষেত্রে নিরাপত্তাজনিত সমস্যা ছাড়াও ভাষা, সংস্কৃতি, সে দেশের নিয়ম-কানুন নিয়ে প্রায়ই সমস্যায় পড়েন। অতীতে অনেক নারীই বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। অনেকেই দালালের খপ্পরে পড়ে প্রতারিত হয়েছেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নারীদের অগ্রযাত্রায় দুর্বার গতি এসেছে।
×