ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

নীলুফার বেগম

মিসবাহউদ্দিন খান

প্রকাশিত: ০৫:০৮, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৬

মিসবাহউদ্দিন খান

বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী মিসবাহউদ্দিন খানের জন্ম ১৯২৯ সালে চাঁদপুরের পুরান বাজার সংলগ্ন নানাবাড়ি শ্রীরামদির জমিদার বাড়ি। বাবা শিক্ষাবিদ আশেক আলী খান ছিলেন চাঁদপুর জেলার প্রথম মুসলমান গ্র্যাজুয়েট। মা সুলতানা আশেক ছিলেন খ্রীস্টান নারী মিশনারিদের দ্বারা প্রশিক্ষিত হৃদয়বান মহিলা। মিসবাহউদ্দিন খানের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর জেলার কচুয়া থানার গুলবাহারে। মিসবাহউদ্দিন খানের আট ভাই-বোন। সবাই জীবনে প্রতিষ্ঠিত। সাহিত্যিক, গবেষক ও অধ্যাপক ড. বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর তার ছোট ভাইদের একজন। মিসবাহউদ্দিন খানের তিন ছেলে। বড় ছেলে অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন একজন সুপরিচিত ইতিহাসবিদ। মেজ ছেলে ইয়াসিন ব্যবসায়ী ও ছোট ছেলে শাহিন আমেরিকায় অবস্থানরত ব্যাঙ্কার। মিসবাহউদ্দিন খান ছাত্রজীবনে লেখাপড়া, খেলাধুলা ও বক্তৃতায় ছিলেন তুখোড়। তিনি ১৯৪৯ সালে ইতিহাসে স্নাতক সম্মান ও ১৯৫০ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এরপর ঢাকার তৎকালীন কায়েদে আযম কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি চট্টগ্রাম বন্দরে যোগদান করেন। এখানে একটানা ৩০ বছর চাকরি করে ১৯৮৬ সালে ডক শ্রমিক ব্যবস্থাপনা বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। কর্মরত অবস্থায় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাট ইউনিভার্সিটিতে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। কর্মসূত্রে বহু দেশ ভ্রমণ করেন। প্রথম জীবনে তিনি কবিতা লিখতেন। তার কবিতার বইয়ের নাম লুসাই বালা। ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে তার বই তত্ত্বাবধায়ন ও তত্ত্বাবধায়ক, ব্যবস্থাপনায় করণিক কাজ, অফিস ব্যবস্থাপনা : দক্ষতা ও উন্নয়ন, ব্যবস্থাপনায় পত্রালাপ ও ডাক চালনা সংশ্লিষ্ট মহল কর্তৃক প্রশংসিত। ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত উল্লিখিত শেষের বই দুটি বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত। মিসবাহউদ্দিন খান ১২ খ-ে চট্টগ্রাম বন্দরের দলিলপত্র গ্রন্থনা ও সম্পাদনা করেছেন, যা বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রকাশ করেছে। এর আগে প্রকাশিত হয়েছে তার গ্রন্থ ‘হিস্ট্রি অব দ্য পোর্ট অব চিটাগং।’ তার মৃত্যুর কয়েক দিন পর প্রকাশিত বইয়ের নাম ‘নবীজীর সাহাবারা (অনুবাদ)’ কমপেনিয়াস অব দ্য প্রফেট বইটি চার খ-ে লন্ডনের মুসলিম এডুকেশন এ্যান্ড লিটারেরি সার্ভিস কর্তৃক প্রকাশিত। মূল বইয়ের লেখক ছিলেন আবদুল ওয়াহিদ হামিদ খান। মিসবাহউদ্দিন খান অতি যতেœর সঙ্গে বইটি অনুবাদ করেছিলেন। তিনি আত্মজীবনীও লিখেছেন। এতে রয়েছে তৎকালীন সমাজ কাঠামোর অবয়ব। বাংলা ও ইংরেজী দুই ভাষায় ছিলেন তিনি সিদ্ধহস্ত। ১৯৯১ সালে তিনি পঞ্চম জাতীয় সংসদের সদস্য হিসেবে চাঁদপুরের কচুয়া থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন। সংসদে থাকাকালীন বিভিন্ন সংসদীয় কমিটিতে তিনি একজন দক্ষ প্রশাসক, বন্দর বিশেষজ্ঞ, সমাজসচেতন সংসদ সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি একজন সফল সংগঠকও ছিলেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় তারই উদ্যোগে ও প্রচেষ্টায় চট্টগ্রাম বন্দর প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট গড়ে ওঠে। প্রশিক্ষকের ভূমিকাও দক্ষতার সঙ্গে পালন করেন তিনি। ১৯৮২ সালে তৎকালীন প্রশাসনিক স্টাফ কলেজ আয়োজিত প্রশিক্ষকদের সম্মেলনে তার চেষ্টায় গড়ে ওঠা চট্টগ্রাম বন্দর প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের পক্ষ থেকে যে নিবন্ধ পাঠ করেছিলেন ও বক্তব্য দিয়েছিলেন, তা সে সময়ে উপস্থিত সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। মিসবাহউদ্দিন খান একজন অকৃত্রিম দেশপ্রেমিক ছিলেন। ৩০ বছর চট্টগ্রাম বন্দরে কাজ করার অভিজ্ঞতা নিয়ে শুধু বইপত্র লিখেই ক্ষান্ত হননি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর কিভাবে পাকিস্তানী বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত করা যায়, কিভাবে আয়ত্তে আনা যায়Ñ এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তথ্য সরবরাহ ছাড়াও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সরাসরি সাহায্য সহযোগিতা করেছেন। নৌকমান্ড মোঃ খলিলুর রহমানের ‘মুক্তিযুদ্ধে নৌ-অভিযান’ বইয়ে উল্লেখ আছে, (পৃ. ৭৩-৭৫) মিসবাহউদ্দিন খান বাংলাদেশের নদী ও সমুদ্রবন্দরের টাইডাল চার্ট মুক্তিযোদ্ধাদের সরবরাহ করেন। তার ৫ নম্বর পোর্টের আবাসিক বাংলোয় মুক্তিযোদ্ধাদের রাখা, প্রশিক্ষণ দেয়া, নিজে গাড়ি (নং ৮৬৮৬) ড্রাইভ করে তাদের সমগ্র নদীবন্দর এলাকা পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করেন গ্রামের বাড়ির আত্মীয়দের পোর্ট দেখাতে এনেছেন এই কথা বলে। এসব কাজে মিসবাহউদ্দিন খানের স্ত্রীরও পরোক্ষ সহযোগিতা ছিল। এই বিজয়ের মাসে তার দশম মৃত্যুবার্ষিকীতে মুক্তিযুদ্ধে অবদানের কথা স্মরণ করে আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। লেখক : সাবেক যুগ্ম সচিব
×