ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কী -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৩:৪৩, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৬

নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কী -স্বদেশ রায়

আমরা সব সময়ই বলি, নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে হবে। আমাদের ইতিহাস একটু নাড়াচাড়া করলে আমরা দেখতে পাই ঠিক এমনিভাবে পাকিস্তান আমলে বার বার উচ্চারণ করেছি, আমাদের বাঙালী হতে হবে। কিন্তু আসলে বাঙালীর সংজ্ঞা কখনই পরিষ্কার করা হয়নি- এমনকি স্বাধীনতার পর এই দীর্ঘ সময় পার হয়ে গেলেও। যা হোক, বাঙালীর সংজ্ঞা না হোক, বাঙালী বলতে কী ও কাদের বুঝি তা এ কলামে আগেই লিখেছি। কিন্তু শুধু যে ডিসেম্বর মাস এসেছে সে জন্য নয়, বার বার মনে হয়- এই যে আমরা প্রতি মুহূর্তে নতুন প্রজন্মকে বলছি- মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে হবে। আসলে এ বিষয়টি পরিষ্কার হওয়া দরকার। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা একটি বহমান প্রক্রিয়া। মানুষের মুক্তির সীমানা অসীম তাই মুক্তিযুদ্ধ কখনই শেষ হওয়ার নয়। পার্থক্য হলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এর রূপ পরিবর্তন হবে। ষাটের দশকে বাঁশের লাঠি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল, তখন চেতনা ছিল সবাইকে যার যার অবস্থানে থেকে নিজস্ব ভূ-খণ্ড সৃষ্টির জন্য প্রস্তুতি নেয়া। তখন ওটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। সত্তরের দশকে শুরু হলো মুক্তির জন্য প্রাণ দেয়ার হুড়োহুড়ি, কার আগে কে দেবে প্রাণ দেশ মাতৃকার বেদিতলে ওটাই ছিল তখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। আবার পঁচাত্তরের পর থেকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারই ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এ মুহূর্তে তরুণ প্রজন্মের জন্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কী? এ মুহূর্তে তরুণ প্রজন্মের জন্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মোটা দাগে দুটি- এক. অর্থনৈতিক উন্নতির ভেতর দিয়ে দেশ ও সমাজকে এগিয়ে নেয়া। দুই. বাঙালী জাতীয়তাবাদকে পুনরুদ্ধার ও যুগোপযোগী করে বিকশিত করা। মোটা দাগে বর্তমানের নতুন প্রজন্মের কাঁধে এ দুই হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন। বাংলাদেশ এ মুহূর্তে অর্থনৈতিকভাবে বিকশিত হওয়ার একটি উর্বর ক্ষেত্র হিসেবে দেখা দিয়েছে। কিন্তু সেই অর্থনৈতিক বিকাশের জন্য যা কিছু করার দরকার, সব কিছুই হতে হবে প্রযুক্তিনির্ভর। কৃষি থেকে শুরু করে সুপার পারমাণবিক বিকাশ সবই হতে হবে প্রযুক্তিনির্ভর ও মেধা নির্ভর। সর্বোপরি ইনোভেটিভ। তাই বাংলাদেশের এই ২০১৬-এর বিজয় দিবসকে সামনে রেখে তরুণ প্রজন্মের মানসিকভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এসেছে দেশের অর্থনৈতিক নেতৃত্ব এখন তাদের দিতে হবে। ১০ ডিসেম্বর দেয়া শেখ হাসিনার একটি ভাষণে কিন্তু এমন ইঙ্গিত আছে। তিনি তরুণদের শিল্প গড়ার জন্য এগিয়ে আসতে বলেছেন। বাস্তবে রাষ্ট্র ও তরুণদের এই ক্ষেত্রে এক কাতারে আসতে হবে। রাষ্ট্রকে সেই শিল্প গড়ার দিকে এগিয়ে যেতে হবে যেখানে তরুণের উদ্ভাবনী মাথা অনেক বেশি কাজ করতে পারে। আর তরুণদেরও মনে রাখতে হবে, শুধু একটি জয়বাংলা সেøাগানকে অস্ত্র সম্বল করে এক একজন মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধে গিয়েছিলেন, এদের কেউ ফিরেছিলেন মেশিনগান হাতে, কেউ ট্যাঙ্ক চেপে বিজয়ীর বেশে। তাই দেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্য, নিজেকে একজন শিল্পপতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য শুধু সিদ্ধান্তটি বড়। অন্য কোন কিছু বড় নয়। রাষ্ট্র এখনও অনেক ক্ষেত্রে পুরনো নিয়মে চলে, এ রাষ্ট্রে অর্থনৈতিক কাজ করার জন্য অনেক বাধা। অর্থাৎ মুক্তিতে বাধা। সোজা কথায় রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সেক্টর শুধু নয়, রাষ্ট্রের সিস্টেমের ভেতর একটি বড় অংশ এখনও পরাধীন যুগে রয়ে গেছে। পরাধীনতার এ দেয়াল মুক্তির পরেও থাকে। অচলায়তন ভাঙ্গার পরেও মহাপঞ্চক থেকে যান। এই মহাপঞ্চককে জোর করে বা শারীরিকভাবে সরানো যায় না, নতুন পঞ্চক হয়েই কিন্তু মহাপঞ্চককে সরাতে হয়। যেমন করে পাহাড়ের বড় বড় পাথরকে ঝর্ণার জল ছন্দের তালে নেচে নেচে আনন্দের সঙ্গে নুড়ি তৈরি করে ফেলে এক সময়ে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তারপর কোন এক সময় সে নুড়ি বালুতে পরিণত হয়ে মহাসাগরের পানিতে মিশে যায়। তরুণ প্রজন্মকে তাই ওই ঝর্ণার পানির মতো হতে হবে, যাদের ছন্দ থাকবে, আনন্দ থাকবে আবার থাকবে পাহাড় ভাঙ্গার সীমাহীন শক্তি। আসলে এই শক্তি আসে কিন্তু আনন্দ থেকে যাকে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন প্রাণশক্তি। হাজার হাজার তরুণ যখন তাদের প্রাণশক্তি নিয়ে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এসে দাঁড়াবে তখন দেখা যাবে সব চোখের অলক্ষ্যে মহাপঞ্চক নামক ওই বিশাল পাথরের মতো বাধা নুড়ি হতে হতে এক সময়ে মহাসাগরের বালু হয়ে গেছে। আর এখানেই তো তারা এ প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধা। প্রতি প্রজন্মেই কিন্তু প্রতিটি জাতির এমনি মুক্তিযোদ্ধারা জন্মায় এবং তারা তাদের প্রাণশক্তি দিয়ে সবকিছু জয় করে। বাংলাদেশের এই যে অর্থনৈতিক বিজয়, এশিয়ায় শুধু নয় গোটা বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড়াবার জন্য যে অর্থনৈতিক বিজয় অর্জন করতে হবে- তার সূচনা ও শক্ত ভিত্তি এই প্রজন্মকেই গড়তে হবে। নেতা হিসেবে শেখ হাসিনা তা উপলব্ধি করেছেন, এখন তরুণদের কাজ বাকিটুকু। বাঙালী এক সময়ে দুঃখ বিলাসী জাতি ছিল, তার সব কিছুতেই সে দুঃখকে বড় করে দেখাতে ভাল বাসত। নিজেকে দুঃখের মাঝে মৃত্যুর মাঝে হারিয়ে দিতে ভাল বাসত। রবীন্দ্রনাথই প্রথম প্রাণশক্তির গান শোনান, তারপরে বঙ্গবন্ধু প্রাণ জাগিয়ে বাঙালীকে নিজস্ব ভূখ- দিলেন। শেখ হাসিনা তরুণ প্রজন্মকে অর্থনৈতিক যুদ্ধে ঝাঁপ দিতে বলছেন। আর এটাই এ মুহূর্তের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এ চেতনাতেই প্রাণশক্তি ও চিন্তাশক্তির মিলন ঘটিয়ে বাঙালীকে নামতে হবে, নামতে হবে তরুণ প্রজন্মকে। আবার এই অর্থনৈতিক উন্নয়ন, অর্থনীতি ও সমাজ বিকাশের জন্য যে বস্তুগত অবকাঠামো উন্নয়ন একে টিকিয়ে রাখতে এ মুহূর্তে প্রয়োজন ষাটের দশকে, সত্তরের দশকে বাঙালীর যে নিজস্ব সংস্কৃতিতে ফেরার আন্দোলন ছিল, যুদ্ধ ছিল তাকে যুগোপযোগী করে আবার ফিরিয়ে আনা। এই সংস্কৃতি না ফিরলে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সপক্ষে হবে না। ওই উন্নয়নের অর্থ বরং ব্যয় হবে মুক্তির ধারাবাহিকতা ধ্বংস করার জন্য। এ কারণে নতুন প্রজন্মকে এই বাঙালী সংস্কৃতিকে যুগোপযোগী করে বিকশিত করতেই হবে। বিজয় দিবসকে সামনে রেখে এই সত্য সকলকে স্বীকার করতে হবে যে, বাঙালী সংস্কৃতিকে যে কালো আবরণে ঢেকে ফেলা হচ্ছে ওই আবরণের নাম ধর্ম। বর্তমান মুহূর্তে সকল দেশে সকল সংস্কৃতিকে ঢেকে ফেলছে এই ধর্ম। ধর্মের আচরণ আর জাতিগত সংস্কৃতি এক নয়। ধর্মের আচরণ ব্যক্তির, এর কিছু ইহজাগতিক ও কিছু পারলৌকিক। তার সীমারেখা ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবনে। অন্যদিকে যে মাটিতে, যে জলবায়ুতে মানুষ বেড়ে ওঠে ওই মাটি ও জলবায়ুর সঙ্গে মিলিয়ে একটি উন্নত মানব সমাজ গড়ে তুলতে, রবীন্দ্রনাথ যাকে বলেছেন, আনন্দিত ও আলোকিত- সেই সমাজ গড়ে তুলতে গেলে তাকে প্রস্ফুটিত করতে হবে সংস্কৃতিকে। ধর্ম ঘরের ভেতর সযতেœ রক্ষিত এক সম্পদ হতে পারে কিন্তু সংস্কৃতি বাড়ির উঠানের ফুল বাগানটি, যার আর্থিক মূল্য মাপা যাবে না আর যার থেকে উৎসারিত আনন্দ ও আলো পরিমাপের কোন সীমা নেই। অসীমের যাত্রী সে। তরুণ প্রজন্মকে এই অসীমের যাত্রী হতে হবে। কারণ সে তো মুক্তির যাত্রী। তার পথের কোন শেষ নেই। সে শুধু আলোর মশালটি নিয়ে দৌড়াবে। যখন তার দৌড় শেষ হবে, পরের প্রজন্মের হাতে তুলে দিয়ে যাবে সে মশাল। আর সংস্কৃতির এই মশালটি এমন- একে নিয়ে যতই দৌড়ানো হয়, ততই এর তেলের পরিমাণ বাড়তে থাকে, আলোর শিখা আরো উজ্জ্বল হয়। তাই এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের হাতে যায় আরও উজ্জ্বলতর আলোর শিখার সে মশাল। আর সংস্কৃতির এই আলোর মশাল যখন উজ্জ্বলতর হয় তখন যে সব কালো বর্ম দিয়ে মানুষকে ঢেকে ফেলার চেষ্টা করা হয়- সেগুলো অতি সহজে আলোর নিচে ছায়া হয়ে যায়। যুগে যুগে কালো বর্মকে ছায়া করে দিয়ে এভাবেই কিন্তু মুক্তি এনেছে আলো। সেই আলো এখন দুয়ারে দাঁড়িয়ে, তরুণ প্রজন্মকে তাই বলা যায়- সময় বহিয়া যায়- হাতে তুলে নাও আলোর মশাল। [email protected]
×