ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

পর্যটকের সন্ধানে

প্রকাশিত: ০৩:৪৯, ৭ ডিসেম্বর ২০১৬

পর্যটকের সন্ধানে

যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই রয়ে গেছে বাংলাদেশের পর্যটন খাত। আলোর মুখ আর দেখে না। কে তাকে দেবে আলোর নিশানা, পথ দেখাবে অগ্রগতির, আকর্ষণের রথ কে চালাবে- সবই অন্তঃসারশূন্য প্রায়। কেবলই ঘোষণা আর ‘হেন করেঙ্গা তেন করেঙ্গা’ মার্কা বাক্যবর্ষণ ছাড়া এই খাতে আর কোন কিছুর ছোঁয়া লেগেছে বলা যাবে না। পর্যটন একটি শিল্প। কিন্তু একে অর্থনৈতিকভাবে অনুকূল করার পথটি সঙ্কুচিত। বিস্তার লাভ করার ক্ষেত্রগুলো প্রসারিত করা হচ্ছে না। অথচ পর্যটন এমন এক অর্থনৈতিক খাত, যেখানে প্রচুর বিনিয়োগ না করেই বিপুল আয় করা সম্ভব। পর্যটনের জন্য তেমন কিছু সৃষ্টি করতে হয় না। শুধু প্রকৃতি প্রদত্ত উপকরণকে রূপান্তরের মাধ্যমে আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করলেই চলে। পর্যটন স্থানগুলোকে সংরক্ষণ ও উন্নয়নের মাধ্যমে এ খাত থেকে বিপুল আয় সম্ভব। এ দেশে পর্যটন শিল্পের জন্য পর্যটকদের দর্শনীয় বস্তুর অভাব নেই। দেশে বিরাজমান প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী যুগে যুগে পর্যটকদের আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। দেশী-বিদেশী ভ্রমণকারী ও পর্যটকদের জন্য ছোট এই দেশে রয়েছে শত শত মনোরম আকর্ষণীয় স্থান ও সম্ভাবনাময় পর্যটন কেন্দ্র। কিন্তু সেজন্য দরকারি উদ্যোগ দৃষ্টিগ্রাহ্য হয় না। পর্যটন শিল্পকে ব্র্যান্ডিং করার কাজটি আজও হয়নি। পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ সমুদ্র সৈকত কিংবা ম্যানগ্রোভ বনের সৌন্দর্য বহির্বিশ্বে প্রচারিত হয় না। বিশ্বের কাছে এ দেশী খাদ্য, ঐতিহ্য, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি তুলে ধরার সহজ মাধ্যম পর্যটন। সেসব নিয়েও নেই পরিকল্পনা। বিদেশী পর্যটকদের নিরাপত্তা থেকে শুরু করে আধুনিক ব্যবস্থা ও চিত্তবিনোদনের নানারকম সুযোগ-সুবিধা তৈরি করা হয় না। অথচ পর্যটন খাতে বিনিয়োগ অন্যান্য খাতে বিনিয়োগের তুলনায় কোন অংশেই কম লাভজনক নয়। বরং কোন কোন দেশে অন্যান্য শিল্পের তুলনায় অধিক লাভজনক প্রমাণিত হয়েছে। পর্যটন শিল্পের প্রসারের ফলে জাতীয় ও রাজস্ব আয় বৃদ্ধি সম্ভব। দেশের যেসব অঞ্চল সাধারণভাবে শিল্পায়ন ও বাণিজ্যক কর্মকা-ের উপযুক্ত নয়, সেসব অঞ্চলে পর্যটন শিল্প প্রসারের মাধ্যমে চাকরির সুযোগ সৃষ্টি ও উন্নয়নের ধারা প্রবাহে সামাজিক সমতা সৃষ্টি সম্ভব। বেকারত্বের হার কিছুটা হলেও হ্রাস পেতে পারে। পর্যটন খাতে উদ্বৃত্ত অর্থের মাধ্যমে দেশের অন্যান্য শিল্পের ‘ব্যালেন্স অব পেমেন্ট’-এর বাণিজ্য ঘাটতি কিছুটা হলেও পূরণ করা সম্ভব। পর্যটন প্রসারের উদ্দেশ্যে হোটেল, মোটেল, রেস্তরাঁ, রাস্তাঘাট নির্মাণের ফলে দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন সম্ভব হয়। দেশীÑবিদেশী সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা তথা জ্ঞান লাভ করা যায় এই শিল্পের প্রসারের মাধ্যমে। পর্যটন শিল্পের বিকাশে সরকার আগেও বহু পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল। কিন্তু কোন পরিকল্পনাই বাস্তবায়ন করতে পারেনি। যেমন কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের পরিবেশ উন্নত করা, ইনানী বীচকে সমৃদ্ধ করা, সান্ধ্যকালীন নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা এবং সড়ক যোগাযোগের আধুনিকায়নের প্রতিশ্রুতি কাগজেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। তিন বছর মেয়াদী পর্যটন বর্ষের প্রথম বছর শেষ পর্যায়ে। ২০১৬ থেকে ২০১৮ সময়কালে প্রতি বছর দশ লাখ বিদেশী পর্যটক আনার লক্ষ্য নির্ধারণ শুধু নয়, এই সময়ের মধ্যে দেশের পর্যটন খাতে প্রায় পাঁচ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টির পরিকল্পনা করা হয়। অথচ পর্যটন শিল্পের যা হালহকিকত, তাতে বছর প্রতি দশ লাখ বিদেশী পর্যটক টার্গেট করাটা বিস্ময়কর। পর্যটন স্থানগুলোর যে হাল, তাতে বিদেশীদের আকৃষ্ট হওয়ার কোন কার্যকারণ নেই। বেশিরভাগের যে করুণ দশা তাতে কেউ আর দ্বিতীয়বার যেতে চায় না। যোগাযোগ ব্যবস্থার মতো অন্যান্য ব্যবস্থার মান খুবই খারাপ। চলতি পর্যটন মৌসুমে কক্সবাজারে পর্যটক আগমন হ্রাস পেতে পারে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কারণে। শুধু পর্যটনের ওপর নির্ভর করে অনেক দেশ আয়-উন্নতি বাড়িয়েছে। দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন ঘটানো গেলে। এ কাজ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানে ও বোঝে। কিন্তু গা লাগাতে চায় না। স্বাধীনতার পঁয়তাল্লিশ বছরেও শিল্পরূপ না পাওয়া পর্যটন খাতকে আলোকিত করার প্রত্যাশা থেকেই যাবে অনন্তকাল।
×