ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

মোস্তাফা জব্বার

একুশ শতক ॥ রিজার্ভ চুরি, পাকিস্তানী হ্যাকার ও একাত্তরের যুদ্ধ

প্রকাশিত: ০৬:৫৯, ৫ জুন ২০১৬

একুশ শতক ॥ রিজার্ভ চুরি, পাকিস্তানী হ্যাকার ও একাত্তরের যুদ্ধ

॥ চার ॥ বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির বিষয়গুলোকে পর্যবেক্ষণ করে আমি শুরুতেই বলেছিলাম একে কেবল একটি চুরির ঘটনা হিসেবে দেখা উচিত হবে না। এর সঙ্গে বাংলাদেশের চিরশত্রুদের কি সম্পর্ক আছে সেটিও খতিয়ে দেখা দরকার। সেই সময়েই বিডিনিউজ ২৪ প্রকাশ করেছে চুরির ঘটনায় পাকিস্তানী হ্যাকার যুক্ত থাকার খবরটি। এরপর ফরাসউদ্দিন ও ইব্রাহিম খালেদের মন্তব্য পেলাম। স্মরণ করতে পারি যে, সাম্প্রতিককালে জামায়াতের আমির নিজামীর ফাঁসি হয়েছে এবং নিজামীর বিচারের ওপর পাকিস্তান চরম শিষ্টাচারবর্জিত মন্তব্য করেছে। অতীতেও তারা তাই করেছে এবং বাংলাদেশের মানুষ পাকিস্তানের সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি তুলেছে। পাকিস্তান জামায়াতে ইসলাম নিজামীর ছবিসহ মিছিল করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে রাজপথে সেøাগান দিয়েছে। আমরা দেশের ভেতরে যে অবস্থা দেখছি তার সঙ্গে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় আচরণ পুরোটাই মিলে যায়। রিজার্ভ চুরির ঘটনায় ম্যালওয়্যারের চরিত্র ব্যাখ্যা করেই ফায়ারআই যে মন্তব্য করেছে তাতে কোন রাষ্ট্র এর সঙ্গে যুক্ত ছিল সেটি ধারণা করা যায়। এখন তো স্পষ্টই প্রমাণ হলো যে, আমাদের রিজার্ভ চুরি পাকিস্তানই করেছে। বিডিনিউজ ২৪-এর খবর এরকম, “বাংলাদেশের রিজার্ভ চুরিতে ‘পাকিস্তানী হ্যাকার গ্রুপ’। বাংলাদেশের রিজার্ভ চুরিতে তিনটি হ্যাকার গ্রুপের সংশ্লিষ্টতার তথ্য পেয়েছে বিশ্বজুড়ে আলোচিত এই সাইবার আক্রমণের তদন্তকারীরা, যার মধ্যে একটি গ্রুপ পাকিস্তানের। বাংলাদেশের নিযুক্ত করা সিলিকন ভ্যালির সাইবার নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান ফায়ারআইয়ের তদন্তে এই তথ্য মিলেছে বলে বিশ্বের বাণিজ্য বিষয়ক অন্যতম শীর্ষ সংস্থা ব্লুমবার্গ জানিয়েছে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্ক থেকে এই রিজার্ভ চুরির ঘটনার তদন্তে এফবিআই বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতরের ব্যক্তিদের সন্দেহ করছে বলে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। ব্যাংক লেনদেনের আন্তর্জাতিক মাধ্যম সুইফটের মাধ্যমে ভুয়া বার্তা পাঠিয়ে রিজার্ভের ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার গত ফেব্রুয়ারিতে চুরি যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানি ফায়ারআইকে ফরেনসিক তদন্তের দায়িত্ব দেয় বাংলাদেশ। সেই তদন্ত এখনও শেষ না হলেও ফায়ারআইয়ের তদন্তকারীর মাধ্যমে এই চুরিতে পাকিস্তানী একটি হ্যাকার গ্রুপের জড়িত থাকার তথ্য জানা গেল। বাংলাদেশে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচার এবং পাকিস্তানের কূটনীতিকদের জঙ্গী সংশ্লিষ্টতা নিয়ে ঢাকা ও ইসলামাবাদের সম্পর্কে টানাপোড়েনের মধ্যে এই সংবাদ প্রকাশ করল ব্লুমবার্গ। ফায়ারআইয়ের দু’জন কর্মকর্তা ব্লুমবার্গকে বলেছেন, পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়ার দুটি হ্যাকার গ্রুপ এই সাইবার চুরিতে জড়িত বলে ফরেনসিক পরীক্ষায় তারা তথ্য পেয়েছেন। তবে অন্য হ্যাকার গ্রুপটি কারা এবং কোন্ দেশের তা এখনও নিশ্চিত হতে পারেননি ফায়ারআইয়ের তদন্তকারীরা। হ্যাকিংয়ের বিষয়ে কথা বলতে পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র এবং তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মন্তব্যের জন্য যোগাযোগ করেছিল ব্লুমবার্গ। তবে কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। জাতিসংঘে উত্তর কোরিয়া মিশনের কর্মকর্তাদের টেলিফোন এবং ইমেইল করা হলেও তারা কোন মন্তব্য করতে রাজি হয়নি বলে ব্লুমবার্গ জানিয়েছে। আর্থিক খাতের কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে লক্ষ্য করে উত্তর কোরিয়ার হ্যাকারদের সাইবার আক্রমণের অভিযোগ বহু দিন থেকে করা হচ্ছে। তবে পিয়ং ইয়ং বরাবর তা নাকচ করে আসছে। বাংলাদেশের রিজার্ভ যে দুটি দেশে সরানো হয়েছিল তার একটি ফিলিপিন্সের তদন্তকারীরা এই সাইবার আক্রমণের জন্য চীনের হ্যাকারদের দুষলেও বেজিং তা নাকচ করে আসছে। নিরাপত্তার ব্যবস্থার কোন ফোকর গলে তিনটি হ্যাকার গ্রুপ সুযোগ নিয়েছে সে বিষয়ে এখনও নিশ্চিত হতে পারেননি ফায়ারআই কর্মকর্তারা। এক কর্মকর্তা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নেটওয়ার্কে হয়ত ম্যালওয়্যার বসানো হয়। হতে পারে এতে ব্যাংকের ভেতর থেকে কেউ সহায়তা করেছে। রিজার্ভ চুরির এই ঘটনা তদন্তে গঠিত সরকারী কমিটির প্রধান বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন ইতোমধ্যে বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রযুক্তি নিরাপত্তা ব্যবস্থায় গলদ এবং কর্মকর্তাদের দায়িত্বশীলতার অভাব ধরা পড়লেও সচেতনভাবে কোন কর্মকর্তা জড়িত বলে প্রমাণ পাননি তারা। এই ঘটনায় করা বাংলাদেশ ব্যাংকের মামলার তদন্তকারী সংস্থা সিআইডির কর্মকর্তারাও একই কথা বলছেন। তারা আবার সুইফটের দায়িত্বহীনতার দিকে অভিযোগ তুলেছেন। এর মধ্যেই এফবিআইয়ের এক কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল মঙ্গলবার জানায়, রিজার্ভ চুরির এই ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতরকার কেউ সহায়তা করেছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। ওই কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্তত একজন কর্মকর্তা এতে জড়িত বলে তদন্তে তথ্য পাওয়া গেছে। অন্য কয়েকজন হতে পারে সহায়তাকারী।” আমরা যদি ঘটনাটিকে এভাবে দেখি যে, পাকিস্তান রাষ্ট্রীয়ভাবে সেই দেশের ও তাদের বন্ধু হ্যাকারদের সমন্বিত করে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের টাকা চুরি করার কাজটি করেছে তাতে কি খুব ভুল বলা হবে? ফায়ারআইয়ের প্রথম প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে যে, এই রিজার্ভ চুরির জন্য অতি সাধারণ ম্যালওয়্যার পাঠানো হয়নি, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আক্রমণ করার জন্য যে ধরনের ম্যালওয়্যার ব্যবহৃত হয় তেমন ম্যালওয়্যার ব্যবহার করা হয়েছে। পাকিস্তানী হ্যাকারদের যুক্ত থাকার মানেই দাঁড়ায় যে, সেখানে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি যুক্ত ছিল এবং পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইও এর প্রায়োগিক দিকটা দেখেছে। প্রশ্ন হতে পারে যে, টাকা তো পাকিস্তানে যায়নি- তাহলে পাকিস্তান এই ঘটনায় কোন্ স্বার্থে যুক্ত হয়েছে? এর উত্তরটাও সহজ। পাকিস্তান টাকা তার দেশে নেয়নি তার অতীত ও বর্তমানের দিকে তাকিয়ে। পাকিস্তানে টাকা গেলে কাউকে প্রশ্নই করতে হতো না যে, এর সঙ্গে ঐ দেশটি যুক্ত। তাতে পাকিস্তান আন্তর্জাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতো, যেমনটি ফিলিপিন্সে এখন হচ্ছে। পাকিস্তান পরম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ফিলিপিন্সকে ব্যবহার করেছে এবং দুনিয়ার দৃষ্টি অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে সেদিকে নিতে পেরেছে। তাতেও পাকিস্তানের স্বার্থসিদ্ধি হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষতি মানেই পাকিস্তানের লাভ। এছাড়াও পাকিস্তান বা তাদের নিয়োজিত ব্যক্তিরা এই টাকার ভাগ যে পায়নি সেটিও প্রমাণিত নয়। বরং ফিলিপিন্সের জুয়ার আসর থেকে বের হয়ে যাওয়া টাকার হদিস না পাওয়া অবধি এটি বলা যাবে না যে, পাকিস্তানে ঐ টাকা যায়নি। পাকিস্তানের যেসব জঙ্গী ও সন্ত্রাসী বাংলাদেশে সক্রিয় বা পাকিস্তান বাংলাদেশে যাদের আইএসআইয়ের মাধ্যমে টাকা দেয় তারা টাকা পেয়েছে কিনা সেটিও স্পষ্ট নয়। তবে পাকিস্তানের স্বার্থের সবচেয়ে বড় বিষয়টি সম্ভবত কেউ আলোচনাই করেননি। বাংলাদেশের অর্থ মন্ত্রণালয়ের টিম ও পুলিশের তদন্ত অনুসারে সুইফট টিম প্রতিষ্ঠানের ৫ হাজার কম্পিউটারের সঙ্গে সুইফট টার্মিনালকে যুক্ত করে রেখে গিয়েছিল। ফলে ব্যাংকের সকল তথ্যই সুইফট সার্ভার থেকে প্রবেশগম্য ছিল। সেই সুবাদে এ কথা বলা যায় যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক তথ্য পাকিস্তান সরিয়ে নিয়েছে। এক সময়ে মিডিয়ায় খবর ছিল যে, কিছু তথ্য মিসরে গেছে। তবে মিসরে কাদের কাছে এই তথ্য গেছে সেটি কেউ বলেনি। আমার ধারণা তথ্যগুলো পাকিস্তানেই পাচার হয়েছে। আমার নিজের কাছে মনে হচ্ছে যে, বাংলাদেশ সরকার রিজার্ভ চুরির ঘটনাটির সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পৃক্ততাকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেনি। তথ্য চুরির বিষয়টি তো মাথাতেই নেই। এর ফলে বাংলাদেশের ভেতরের কারা কিভাবে এই ঘটনাটির সঙ্গে যুক্ত ছিল সেটি চিহ্নিত করা যেমন সহজ হতো তেমনি ভবিষ্যতের জন্যও ব্যাপক সাবধানতা অবলম্বন করা যেত। আমি এটিও প্রত্যাশা করব যে, সরকার পাকিস্তানীদের ছোট করে দেখবে না এবং তারা ৪৭ সাল থেকে বাঙালীদের বিরুদ্ধে যা যা করেছে তাকে মাথায় রেখেই সিদ্ধান্ত নেবে। নিবন্ধটি শেষ করার আগে আমাদের ব্যাংকিং বা আর্থিক খাতের জন্য কিছু প্রস্তাবনা বিবেচনা করার জন্য অনুরোধ করছি। প্রথমত. যারা যেভাবেই যত টাকা ব্যয় করে বিদেশী সফটওয়্যার বা সেবা কিনে থাকুন না কেন নিজের দেশের মানুষকে যদি সম্পৃক্ত করতে না পারেন তবে এই খাতের নিরাপত্তা চিরকাল সোনার পাথরবাটি হয়ে থাকবে। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে নিজের ঘরে বিশ্বস্ত, সৎ, দেশপ্রেমিক ও দক্ষ মানুষ থাকতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিধিবদ্ধ ব্যাংক পর্যন্ত সকলের জন্যই এই বিষয়টি প্রণিধানযোগ্য। দ্বিতীয়ত. ডিজিটালে রূপান্তরের পাশাপাশি ডিজিটাল নিরাপত্তার প্রযুক্তি আহরণ করার জন্য উপযুক্ত প্রযুক্তির পেছনে বিনিয়োগ করুন। এই বিনিয়োগ নিজের মানুষ দিয়ে করতে পারলে ভাল। যদি না পারা যায় তবে অন্যদের প্রযুক্তি নিজেদের কাছে স্থানান্তর করার পথে হাঁটুন। তৃতীয়ত. দেশের আইনগত অবকাঠামো যেমনি দ্রুত গড়ে তোলার প্রয়োজন তেমনি যারা এসব ক্ষেত্রে তদন্ত বা বিচার করবেন তাদের সক্ষম করে তুলুন। চতুর্থত. ডিজিটাল প্রযুক্তি যারা ব্যবহার করেন তাদের সচেতন করে তুলতে হবে। নিজেদের ডিজিটাল ডিভাইস নিরাপদ রাখার পাশাপাশি নিজেদের ডিজিটাল নিরাপত্তার বিষয়গুলো নিরাপদ রাখতে হবে। পঞ্চমত. চিরশত্রু পাকিস্তান, তুরস্কের মতো তাদের সহযোগী দেশ ছাড়াও দেশের ভেতরে যারা বাংলাদেশবিরোধী তাদের বিষয়ে সম্পূর্ণ সচেতন না থাকলে আমাদের কেন্দ্রীয় বা স্থানীয় আর্থিক ব্যবস্থায় আক্রমণ হতেই পারে। দিন দিন যেহেতু প্রযুক্তি সাধারণ মানুষের হাতে যাচ্ছে সেহেতু এই নজরদারিতে জনগণের সম্পৃক্ততা খুবই প্রয়োজনীয়। (সমাপ্ত)
×