সারাদেশে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, প্রকাশক, লেখক, ব্লগার, যাজক, বিদেশী নাগরিক, ভিন্ন ধর্মাবলম্বীসহ মুক্তমনা মানুষ একের পর এক খুন হচ্ছেন। এদের প্রায় সবাইকে জঙ্গীরা হত্যা করেছে বলে প্রশাসন প্রাথমিকভাবে স্বীকার করেছে। শনিবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে তাঁর বাসা থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে রাস্তার ওপর কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। নিহত অধ্যাপক সিদ্দিকী একজন সংস্কৃতিপ্রেমী ছিলেন এবং শিক্ষকতার পাশাপাশি একাধিক স্থানে সঙ্গীত বিদ্যালয় চালাতেন। তিনি রাজশাহীতে একটি সাংস্কৃতিক জোট গড়ে তুলেছিলেন এবং নিজের এলাকায় একটি সঙ্গীত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি ‘সুন্দরম’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। এতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়টি নতুন করে ভাবার সুযোগ করে দিয়েছে।
গত দশ বছরে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ শিক্ষক খুন হলেন। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সহ-সভাপতি ড. ইউনুস জেএমবি ক্যাডারদের হাতে খুন হন ২০০৪ সালে; এরপর শিবির ক্যাডারদের হাতে খুন হন ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ড. তাহের আহমেদ এবং প্রায় দুই বছর আগে খুন করা হয় সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সফিউল ইসলামকে। এবার নিহত হলেন রেজাউল করিম। এরা সবাই মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী ছিলেন। তাদের সকলের মৃত্যুতে কোন না কোনভাবে মৌলবাদের যোগসূত্র রয়েছে। এরা প্রত্যেকেই সাধারণভাবে মুক্তমনা বুদ্ধিজীবী হিসেবেই টার্গেটে পরিণত হয়েছেন। ড. ইউনুসকে হত্যার দায় স্বীকার করেছিল জেএমবি। সফিউল ইসলামের হত্যাকাণ্ডের পর ‘আনসার উল বাংলাদেশ-২’ নামের একটি সংগঠন ফেসবুকে নিহত শিক্ষককে মুরতাদ আখ্যা দিয়ে উল্লাস প্রকাশ করেছিল। সর্বশেষ হত্যাকাণ্ডটি দায় স্বীকার করেছে কথিত আইএস। তার মানে বাংলাদেশে আইএসের অবস্থান একবারে কথার কথা নয়। রাজশাহী অঞ্চলটিতে অনেক আগে থেকেই বাংলাভাইসহ বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের প্রভাব ছিল। এখনও নানা সময়ে এদের উপস্থিতির খবর জানা যায়। এ কারণেই হয়তো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমনা শিক্ষকরা একের পর এক এভাবে খুন হচ্ছেন।
বিভিন্ন সময়ে প্রশাসনের কাছে শুনতে হয়েছে দেশে আইএস নেই কিংবা জঙ্গীদের নির্মূল করা হয়েছে, তারা কখনো দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু তারা যে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি তা একের পর এক হত্যাকা- এবং তার স্বীকারোক্তিই তার প্রমাণ রাখে। শুধু জঙ্গীদের হামলা বা হত্যাকাণ্ডই নয়, সাধারণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও অবনতি হচ্ছে দেখা যায়, এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, গত সাড়ে তিন মাসে সারাদেশে খুন হয়েছেন প্রায় দেড় হাজার মানুষ। চলতি মাসের প্রথম ২০ দিনেই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন শতাধিক ব্যক্তি। বেড়েছে ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, ধর্ষণসহ অন্যান্য অপরাধও। দুইদিন আগেও রাজশাহীতেই বিশ্ববিদ্যালয় দুই ছাত্রছাত্রী একটি আবাসিক হোটেলে খুন হন। এসব ঘটনায় সাধারণ মানুষ ক্রমেই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। জঙ্গীরাও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এই দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে।
রাজশাহী অঞ্চলে মৌলবাদের এত বিস্তার কেন এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমনা শিক্ষকরা কেন বার বার টার্গেটে হচ্ছেন তা খতিয়ে দেখা জরুরী। রেজাউল করিম সিদ্দিকীর হত্যাকাণ্ডটির মোটিভ বের করতে হবে অতি সতর্কতার সঙ্গে। শনাক্ত করতে হবে হত্যাকারীদের। যে কোন অপরাধ কমাতে হলে সংশ্লিষ্ট অপরাধ তদন্ত করে অভিযুক্তকে দ্রুত বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো জরুরী। শাস্তি না হলে অপরাধীরা আরও বেপরোয়া হয়। এতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাক এটা কারোরই কাম্য নয়। সবাই মনে করে সব হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার দ্রুততম সময়ে নিশ্চিত করা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে সর্বাত্মক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরী।
শীর্ষ সংবাদ: