ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বকাপে এখনও ‘ছড়িয়ে-ছিটিয়ে’ বাংলাদেশ!

প্রকাশিত: ০৬:০০, ১ এপ্রিল ২০১৬

বিশ্বকাপে এখনও ‘ছড়িয়ে-ছিটিয়ে’ বাংলাদেশ!

মিথুন আশরাফ, মুম্বাই থেকে ॥ আর মাত্র তিনদিন বাকি। রবিবারই শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচ শেষে পর্দা নামবে টি২০ বিশ্বকাপের ষষ্ঠ আসরের। বাংলাদেশের বিশ্বকাপ শেষ হয়ে গেছে আরও ৫ দিন আগেই। অথচ এখনও বিশ্বকাপে ‘ছড়িয়ে-ছিটিয়ে’ আছে বাংলাদেশ! সাফল্যেই বেশি আছে। তবে আছে ব্যর্থতাতেও। অনেক ভোগান্তির পর, অনেক চেষ্টার পর মুম্বাইয়ে বাংলাদেশের ১০ সাংবাদিক যে স্থানে হোটেলে উঠেছেন, সেই মোহাম্মদপুর আলী রোডে পাওয়া যায় না, এমন কিছু নেই। কী চাই। সব ধরনের খাবার থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় যা দরকার, তাই আছে। ১ কিলোমিটারের কম দূরত্ব রোডের। রোডের দুই সারিতে সবকিছুর পসরা সাজিয়ে রাখা হয়েছে। সবচেয়ে মজার বিষয়, এখানে কোন ফলই কেটে খেতে হয় না। আগে থেকেই কেটে প্রস্তুত রাখা হয়। শুধু কিনে টপাটপ খেয়ে ফেলতে হয়। সেই মোহাম্মদপুর রোডে প্রতি ঘরে ঘরে মুসলমানদের বসবাস। বাংলাদেশ দল বলতে অনেকে অজ্ঞানও! অনেকের আবার আফসোসও, ‘ইস, যদি বাংলাদেশ ১ রানে জিতত।’ ট্রাভেল এজেন্সির মালিক সালমান নামের লোকটি যেমন বাংলাদেশ থেকে বিশ্বকাপ কাভার করতে আসার কথা শুনতেই বলে ফেললেন, ‘বাংলাদেশ সেদিন ভারতের বিপক্ষে কী খেলাটাই না খেলল! আফসোস শেষে গিয়ে ১ রানের জন্য হেরে গেল। এরপরও দুর্দান্ত খেলেছে বাংলাদেশ।’ ভারত জয় পাওয়ায় তারা খুশি। তবে ২৩ মার্চ ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশ যেভাবে খেলেছে, তাতে প্রশংসাই মিলছে মাশরাফিদের। সেদিনই বাংলাদেশের বিশ্বকাপ শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু ২৬ মার্চ নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ থাকায় পরের দিন দেশে ফিরেন বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটাররা। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ পর্বেরও ইতি ঘটে। তবে এখনও বিশ্বকাপের সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে আছেন মাশরাফিরা। ব্যাটিং-বোলিংয়ের সাফল্যের সঙ্গে দলীয় সাফল্য-ব্যর্থতাতেও আছে বাংলাদেশ। সবচেয়ে বড় বিষয়, এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি রান বাংলাদেশ ওপেনার তামিম ইকবালের। যেহেতু টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কার হিসেব করা হয় সেমিফাইনাল পর্যন্ত পারফর্মন্সের ওপর ভিত্তি করে, সেখানে ব্যাটিংয়ে রান হিসেব করে যদি পুরস্কার দেয়া হয়, তাহলে ৬ ম্যাচে ৭৩.৭৫ গড়ে ২৯৫ রান করা তামিম তা পেতেই পারেন। যদিও তামিমের বাছাইপর্বের তিন ম্যাচের নৈপুণ্য এখানে যোগ করা আছে। কিন্তু বিশ্বকাপের পার্ট হচ্ছে প্রথম পর্ব বা বাছাইপর্ব। যদি সব ম্যাচ মিলিয়ে রানের হিসেব করা হয় এবং সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের কোন পুরস্কার দেয়া হয়, তাহলে তামিমের ভা-ারেই পুরস্কারটি জমা হবে। বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল পর্যন্ত ইংল্যান্ডের জো রুট ৫ ম্যাচে ৪৮.৭৫ গড়ে ১৯৫ ও সেমিফাইনালের আগ পর্যন্ত ভারতের বিরাট কোহলি ৪ ম্যাচে ৯২.০০ গড়ে ১৮৪ রান করেছেন। রুট আর তামিমকে টপকে গেলেও লাভ হবে না। সেমিফাইনাল যে খেলা হয়ে গেছে। তবে কোহলির সেই সুযোগ আছে। যদি ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেমিফাইনালে ১১২ রান করেন কোহলি। তাছাড়া তামিমের রানের ধারে কাছে যাওয়ার মতো কেউ নেই। শুধু সবচেয়ে বেশি রান সংগ্রাহকের তালিকায় সবার ওপরে যে আছেন তামিম এমন নয়, এক ম্যাচে সর্বোচ্চ রানটিও তামিমেরই। বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত দুটি শতক হয়েছে। একটি করেছেন তামিম। আরেকটি করেছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটিং দানব ক্রিস গেইল। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অপরাজিত ১০০ রান করেছেন গেইল। বাছাইপর্বে ওমানের বিপক্ষে যে অপরাজিত ১০৩ রান করেছিলেন তামিম, সেই ইনিংসকে ছাপিয়ে যেতে পারেননি গেইল। ব্যাটিংয়ে তামিমের আরও দুটি অর্জন আছে। একটি হচ্ছে, বিশ্বকাপে চার ব্যাটসম্যান দুটি করে অর্ধশতক করতে পেরেছেন। তামিম তাদের মধ্যে একজন। আর টুর্নামেন্টে ভারত-ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচের আগ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ছক্কাও (১৪) হাঁকিয়েছেন তামিমই। শুধু তামিমের সাফল্যেই মোড়ানো নয় বাংলাদেশের বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপে যে এখনও ভাগ বসিয়ে আছে বাংলাদেশ, সেখানে অন্য ক্রিকেটারদেরও আছে ছাপ। বোলিংয়ে মুস্তাফিজুর রহমান তো ইতিহাসই গড়েছেন। টি২০ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম বোলার হিসেবে ৫ উইকেট নিয়েছেন। এ বিশ্বকাপে ৫ উইকেট শিকারি বোলার দুইজন। ৩ ম্যাচ খেলেই ৯ উইকেট নেয়া মুস্তাফিজ ও অস্ট্রেলিয়ার জেমস ফকনার (২৭ রানে ৫ উইকেট)। মুস্তাফিজ আছেন এক নম্বরে। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ২২ রানে ৫ উইকেট নেন মুস্তাফিজ। এখন পর্যন্ত সেরা পাঁচ উইকেট শিকারির তালিকায় আছেন ৭ ম্যাচে ১০ উইকেট নেয়া বাংলাদেশ অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। বিশ্বকাপে এক ম্যাচে ৪ উইকেট বা তারবেশি উইকেট নেয়াদের তালিকায় ৯ জন আছেন। এর মধ্যে মুস্তাফিজ ও সাকিব স্থান করে নিয়েছেন। ফিল্ডিংয়ে ক্যাচ ধরার দিক দিয়ে সেরা পাঁচে বাংলাদেশের দুইজন আছেন-মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ ও সাব্বির রহমান রুম্মন। যেখানে নিউজিল্যান্ডের মার্টিন গাপটিল ৬ ক্যাচ ধরেছেন। সেখানে মাহমুদুল্লাহ ও সাব্বির ৪ করে ক্যাচ ধরেছেন। জুটি গড়াতেও ঝলক দেখিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানরা। ধর্মশালায় ওমানের বিপক্ষে তামিম ও সাব্বির মিলে যে দ্বিতীয় উইকেটে ৯৭ রানের জুটি গড়েছেন, সেটি এখনও এ উইকেটের সেরা জুটি হয়ে আছে। রানের দিক দিয়ে এ জুটি আছে দ্বিতীয় স্থানে। বাছাইপর্বে জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে আফগানিস্তানের সামিউল্লাহ সেনওয়ারি ও মোহাম্মদ নবী যে পঞ্চম উইকেটে ৯৮ রানের জুটি গড়েছেন, সেটি এখনও সেরার স্থানেই আছে। এরপরই ১ রান কম করে তামিম ও সাব্বিরের জুটিটি আছে দ্বিতীয় স্থানে। এটা যেমন সাফল্য, আছে ব্যর্থতাও। যে ব্যর্থতাগুলো আসলে এবার বিশ্বকাপে বাংলাদেশকে নিয়ে যে এত প্রশংসা করা হয়েছে, তা কমিয়ে দিয়েছে। সেই ব্যর্থতা ব্যক্তিগতর চেয়ে দলীয় নৈপুণ্যেই বেশি ধরা দিয়েছে। বাছাইপর্ব দাপটেই অতিক্রম করে বাংলাদেশ। হল্যান্ডকে হারিয়ে দেয়। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটি বৃষ্টিতে হয়নি। এরপর ওমানকে উড়িয়ে দিয়ে ‘সুপার টেনে’ ওঠে বাংলাদেশ। কিন্তু পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচেই হতাশ করে। এরপর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে লড়াকু হার হয়। ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে গিয়ে মাত্র ১ রানের হার হয়ে যায়। সবাই বাংলাদেশ দলের এমন পারফর্মেন্সে হতাশ হয়। এরপরও সমর্থন দিয়ে যায়। ভাল যে খেলে মাশরাফিরা। কিন্তু নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে গিয়ে সব হারিয়ে বসে বাংলাদেশ। ৭০ রানে অলআউট হয়ে যায় বাংলাদেশ। টি২০ ক্রিকেটে নিজেদের ইতিহাসে সর্বনিম্নœ রানে অলআউট হয়ে যায়। শেষবেলায় এসে লজ্জা পায় মাশরাফিরা। লজ্জা দেয়ও। যা এ বিশ্বকাপে অলআউট হওয়া দলগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন রানও। এই ম্যাচেই যে ৭৫ রানে হারে বাংলাদেশ, তা আবার এ বিশ্বকাপে রানের দিক দিয়ে সবচেয়ে বড় হারও। বাংলাদেশ ব্যাটসম্যান মুশফিকুর রহীমের জন্য লজ্জা আছে। বিশ্বকাপে যে তিনজন সবচেয়ে বেশি দুইবার করে শূন্য রানে আউট হয়েছেন, তাদের মধ্যে আছেন মুশফিক। সাফল্য ও ব্যর্থতা সবক্ষেত্রেই এখনও বিশ্বকাপে ‘ছড়িয়ে-ছিটিয়ে’ আছে বাংলাদেশ। তবে দুই একটি ব্যর্থতা ছাড়া সাফল্যেই বেশি পাওয়া যাচ্ছে বাংলাদেশকে। আগে কোন তালিকাতেই বাংলাদেশ ক্রিকেটারদের নাম সেরা দশেও হয়ত মিলত না। এখন হয় প্রথম নয়ত সেরা পাঁচে আছে বাংলাদেশ ক্রিকেটারদের নাম, বাংলাদেশের নাম।
×