
ছবি: জনকণ্ঠ
মুন্সীগঞ্জ বিক্রমপুর, ঐতিহ্যের ভাণ্ডার. যেখানে কৃষক শুধু ফসল নয়, জন্ম দেন ইতিহাসের। এই জনপদের মাটি শুধু উর্বর নয়, কৃষিপণ্য উৎপাদনে এক সময় জাতীয় অর্থনীতিরও অবলম্বন ছিল। মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলা তারই একটি প্রাণকেন্দ্র, যেখানে আলু চাষ শুধু কৃষি নয়—এলাকার অর্থনৈতিক এক নির্ভরযোগ্য খাত। কিন্তু চলতি মৌসুমে সেই কৃষিই যেন কৃষকের বুকের ভার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ বছর শ্রীনগরের ২ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছে। উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য অনুযায়ী, লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল প্রায় ৫৮ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন উৎপাদনের। চাষাবাদের মৌসুমে খরচ বেড়ে যাওয়ায় কৃষকদের ব্যয়ও ছিল অতীতের তুলনায় অনেক বেশি। প্রতি কানি (১৪০ শতাংশ) জমিতে আলু উৎপাদনে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৩ লাখ টাকা। গড়ে প্রতি কানি জমিতে পাওয়া গেছে ৩০০ মণ আলু। এর অর্থ, প্রতি মণে (৪০ কেজি) আলুর উৎপাদন ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা।
মাঠে উৎপাদনের পর অনেক কৃষক শুরুতে আলু বিক্রি করলেও দিন যত গেছে, পাইকারি বাজারে দাম তত কমেছে। বর্তমানে হিমাগারে সংরক্ষিত আলুর কেজি বিক্রি হচ্ছে মাত্র ১১ টাকায়। অথচ প্রতি কেজির উৎপাদন খরচই ২০-২২ টাকা। এই দামে বিক্রি করতে গিয়ে প্রতি বস্তায় (৫০ কেজি) কৃষককে ৬০০-৭০০ টাকা পর্যন্ত লোকসান গুনতে হচ্ছে।
স্থানীয় আল-আমিন কোল্ড স্টোরে গিয়ে দেখা গেল, কৃষকরা নিজেরাই আর হিমাগারে যাচ্ছেন না। আলু বিক্রির জন্য তারা হিমাগার দলিল (স্টোর রসিদ) তুলে দিচ্ছেন পাইকারদের হাতে। এক বিক্রেতা জানান, এখন তো আলু বিক্রি করে হিমাগারের ভাড়া তুলতেই কষ্ট হচ্ছে। লাভ তো দূরের কথা, মূলধনটাই হারিয়ে যাচ্ছে।
শ্রীনগরের পাইকার মো. আরিফ বলেন, “আলুর বস্তা প্রতি আড়তে পাঠিয়ে ১০০ টাকা লাভ হচ্ছে। তবে এটা খুবই কম। আর কৃষকের তো পুরোই লোকসান।” উত্তরবঙ্গ থেকে আলু এনে হিমাগারে রেখেছিলেন মনির হোসেন নামের আরেক পাইকার। বললেন, “১২০০ টাকা দরে ৩,৫০০ বস্তা আলু এনেছি। এখন বিক্রি করতে পারছি ৫০০-৫৫০ টাকায়। লোকসান হিসাব করতেই ভয় লাগছে।”
অন্যদিকে হিমাগার কর্তৃপক্ষও নিজস্ব সংকটের কথা বলছে। আল-আমিন কোল্ড স্টোরের ম্যানেজার মো. শরীফ মোল্লা জানান, “প্রতি কেজি আলুর ভাড়া ধরা হয় ৬ টাকা। তবে এখন বাজার দর এত কম যে কৃষকরা নিজেরাই বিক্রি করতে চাইছে না। আমাদের হিমাগারে ৮২ হাজার বস্তা আলু রাখা হয়েছে। কিন্তু বিক্রি অস্বাভাবিকভাবে কম।”
শ্রীনগরে মোট তিনটি হিমাগারে সর্বোচ্চ ধারণক্ষমতা ১৪ হাজার মেট্রিক টন। অথচ উৎপাদন হয়েছে তার চার গুণেরও বেশি। ফলে হিমাগারে জায়গার সংকটও তৈরি হয়েছে। অনেক কৃষক বাধ্য হয়ে ঘরের কোণায় বা খোলা আকাশের নিচে আলু স্তূপ করে রেখেছেন।
কৃষক মো. আবেদীন বলেন, “আমার প্রতি কেজি আলুর খরচ পড়েছে ২২ টাকা। এখন বিক্রি করতে হচ্ছে ১১ টাকায়। হিমাগার ভাড়া, বস্তা খরচ, পরিবহন—সব কিছু ধরলে প্রতি বস্তায় ৬০০-৭০০ টাকা ঘাটতি হচ্ছে।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মৌসুমের শুরুতে অতিরিক্ত দামে বীজ ও সারের মূল্য ছিল অস্বাভাবিক। তার সঙ্গে শ্রমিক মজুরি এবং জমি ভাড়াও বেড়েছে। কিন্তু উৎপাদনের সময় আলুর বাজারে সরকারি বা বেসরকারি কোনো রকমের মজুতনীতি বা দামের নিশ্চয়তা ছিল না। ফলে বাজার দরের ওপর ভর করে পুরো ব্যবস্থাটি ধসে পড়ে।
স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তা মোহসিনা জাহান তোরণ স্বীকার করেছেন, “আলুর উৎপাদন ভালো হয়েছে। তবে বাজারে দাম কম থাকায় কৃষকরা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত। আমরা কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছি যাতে তারা পাইকারদের ওপর পুরোপুরি নির্ভর না করে বিক্রির ক্ষেত্রে কিছু বিকল্প ভাবেন।”
এক সময় মুন্সীগঞ্জ ছিল দেশের অন্যতম আলু উৎপাদনকারী এলাকা। এখানকার আলু যেত রাজধানীসহ দেশের নানা প্রান্তে। এমনকি একসময় কিছু কিছু অঞ্চলে রপ্তানির কথাও উঠেছিল। কিন্তু এবার চিত্র সম্পূর্ণ উল্টো। হিমাগারের আলুর স্তূপ যেন প্রশ্ন তোলে—এই কৃষিনির্ভর অর্থনীতির ভবিষ্যৎ কি অন্ধকারে?
মুমু ২