ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২২ জুলাই ২০২৫, ৭ শ্রাবণ ১৪৩২

ইতালির স্বপ্ন দেখিয়ে লিবিয়ায় পাঠিয়ে নির্যাতন, সাতক্ষীরায় তিন পরিবারে চলছে আহাজারি

এবিএম কাইয়ুম রাজ, সাতক্ষীরা

প্রকাশিত: ১৩:৩৬, ২২ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ১৩:৩৭, ২২ জুলাই ২০২৫

ইতালির স্বপ্ন দেখিয়ে লিবিয়ায় পাঠিয়ে নির্যাতন, সাতক্ষীরায় তিন পরিবারে চলছে আহাজারি

ছবি: সংগৃহীত।

ইতালিতে উন্নত জীবনের আশ্বাস দিয়ে লিবিয়ায় পাঠানো হয়েছে সাতক্ষীরার তিন যুবককে। সেখানে গিয়ে মানবপাচারকারী ও দালাল চক্রের হাতে তারা বন্দী হয়ে পড়েছেন। অমানবিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন প্রতিদিন। নির্যাতনের ছবি ও ভিডিও পাঠিয়ে পরিবারগুলোর কাছে দাবি করা হচ্ছে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ। অর্থ দিতে না পারায় নির্যাতনের মাত্রা বাড়ছে।

বন্দি যুবকরা হলেন শ্যামনগরের কৈখালী ইউনিয়নের রেজোয়ান ও আবু শহিদ গাজী এবং বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের রমজান। উন্নত জীবনের আশায় ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে একসাথে ফ্লাইটে পাঁচটি দেশ ঘুরে তারা লিবিয়ায় পৌঁছান।

পরিবারের সদস্যরা জানান, ছেলেরা ফোন করে জানায়, তারা না খেয়ে অমানবিক নির্যাতনের মধ্যে দিন পার করছেন। হাত-পা বেঁধে মারধর করা হচ্ছে, তুলে ফেলা হচ্ছে হাতের নখ, পাঠানো হচ্ছে সেই ভিডিও। এমনকি কান্নার শব্দও রেকর্ড করে পাঠানো হচ্ছে।

ভুক্তভোগীদের পরিবারগুলো দালালদের হাতে জনপ্রতি ১৮ থেকে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত দিয়েছে বলে জানায়। জমি বিক্রি, ধারদেনা করে এই টাকা জোগাড় করলেও এখন নিঃস্ব হয়ে পড়েছে পরিবারগুলো।

এ ঘটনায় শ্যামনগর উপজেলার দাতিনাখালী গ্রামের মুকুল সানাসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে মানবপাচার আইনে মামলা হয়েছে। মামলার তদন্ত করছে সাতক্ষীরা পিবিআই। পিবিআই সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং প্রধান অভিযুক্ত মুকুল সানার বিরুদ্ধে তথ্য পাঠানো হয়েছে ইমিগ্রেশনে।

লিবিয়া থেকে পাঠানো নির্যাতনের ভিডিও হাতে পেয়েছে জাগো নিউজ। সেখানে দেখা যায়, আবু শহিদ গাজীর হাত-পা বেঁধে পেটানো হচ্ছে।

আবু শহিদ গাজীর ভাই শহিদুল ইসলাম বলেন, "গত ফেব্রুয়ারি থেকে নির্যাতন শুরু হয়। তাদের কান্নার শব্দ শুনে রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। দালালদের একজন, মুকুল সানা দুবাই থেকে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে। তার স্ত্রী ও শ্যালকসহ ছয়-সাতজনের একটি চক্র স্থানীয়ভাবে কাজ করে।"

তিনি আরও জানান, প্রথমে ১৭ লাখ টাকা দাবি করা হয়। প্রাণ বাঁচাতে দুই লাখ টাকা দিয়ে শুরু করেন। এরপর একে একে আরও টাকা দিতে বাধ্য হন। এখন পর্যন্ত প্রায় ২০ লাখ টাকা দিয়েছেন।

ভুক্তভোগী রেজোয়ানের ভাই আব্দুল্লাহ বলেন, "আমরা অসুস্থ হয়ে গেছি। টাকা নেই। ভাইকে ফেরত চাই। মুকুল সানাসহ দালালদের বিচার চাই।"

অভিযোগ অনুযায়ী, মুকুল সানার সঙ্গে তার দুলাভাই রেজাউল, স্ত্রী মোমেনা, শ্যালক শাহিনুরসহ পুরো চক্রটি দীর্ঘদিন ধরেই এই পাচার চক্রে জড়িত।

এই বিষয়ে পিবিআই সাতক্ষীরা জেলার পুলিশ পরিদর্শক অনিমেশ কুমার মন্ডল বলেন, "ঘটনার তদন্ত চলছে। অভিযুক্তদের বিষয়ে তথ্য মন্ত্রণালয় ও ইমিগ্রেশনে পাঠানো হয়েছে।"

অভিযোগপত্রে থাকা বেশ কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। দুবাইয়ে অবস্থানরত মুকুল সানা ইমোতে ফোন কেটে দেন এবং বার্তাতেও কোনো উত্তর দেননি।

জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের প্রথম তিন মাসে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে পৌঁছেছে ২,৬৭০ বাংলাদেশি। ২০২৫ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতেই ইতালিতে পৌঁছেছে আরও ২,৫৮৯ জন বাংলাদেশি।

অভিবাসন বিশ্লেষকরা বলছেন, সচেতনতার অভাব, উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও দালালদের প্রলোভনের কারণেই এ ধরনের ঘটনা বাড়ছে। পাশাপাশি নিরাপদ ও বৈধ অভিবাসনের পথ সুরক্ষিত না হলে এমন চিত্র আরও ভয়াবহ হতে পারে।

অভিবাসন ও শরণার্থী বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলেন, "মানবপাচার আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। দালালদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি দক্ষ শ্রমিক গড়ে তুলতে হবে এবং বৈধ অভিবাসনের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।"

মিরাজ খান

×