
ছবিঃ সংগৃহীত
বাহের দ্যাশ খ্যাত উত্তরাঞ্চলের রংপুর বিভাগের আট জেলা পঞ্চগড়,ঠাকুরগাঁও,দিনাজপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট,রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা। এবারের পবিত্র ঈদুল আজহার পশু কোরবানীর সংখ্যা গড়ে ১৬ লাখে দাঁড়াবে। সরকার নির্ধারিত চাপড়ার মূল্য নিয়ে ব্যবসায়ীরা একমত হতে পারেননি।
ফলে বিগত কয়েক বছরের ন্যায় এবারও পশুর চাপড়ার সঠিক মূল্য থেকে বঞ্চিত করা হবে কোরবানীদাতাদের। ঈদুল আজহা শুধু আনন্দের নয়, এটি আত্মত্যাগ ও আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের এক মহা উপল্য। প্রতিটি সামর্থ্যবান মুসলমান নর-নারীর ওপর কোরবানি ওয়াজিব। যারা ১০ জিলহজের ফজর থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত নিসাব পরিমাণ সম্পদ অর্থাৎ সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ অথবা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মালিক থাকবেন তাদের অবশ্যই কোরবানি করতে হবে। এই ইবাদতে রয়েছে গরিব-দুস্থ মানুষের অধিকার তাদের জন্য বরাদ্দ কোরবানির গোশত এবং অবহেলিত একটি অংশ: পশুর বিক্রিত চামড়ার অর্থ। যা চামড়ার টাকার হকদার অসহায় গরীব দুঃখি মানুষজন। বিগত বছরের ন্যায় এবারও বলা হচ্ছে উত্তরাঞ্চলে প্রায় এক হাজার চামড়া ব্যবসায়ী টাকার অভাবে এবার চামড়া ক্রয় করতে পারবেন কি না সন্দিহান হয়ে পড়েছেন।
মৌসুমী চামড়া ক্রয়কারীরাও বুঝতে পারছেন না তারা চামড়া ক্রয় করে কার কাছে বেঁচবেন। অনেকে এ জন্য ট্যানাড়ি মালিকদের দোষারোপ করছেন। রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের প্রতি বছর কোরবানির সময় প্রতিটি জেলায় দুই থেকে আড়াই লাখ পিচ চামড়ার আমদানি হয়। সেই হিসাবে প্রতি বছর কোরবানির সময় ১৬ লাখ পিচ গরুর চামড়া আমদানি হয়।
ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা গত কয়েক বছরের মতো এবারও সেই লক্ষ্য হোচট খেতে পারে। রংপুর বিভাগীয় শহরে কয়েক বছর আগেও শতাধিকের বেশিও ওপর চামড়ার গুদাম ছিল। বর্তমানে তা নেমে এসেছে ৩-৪টিতে। এই অবস্থা নীলফামারীর সৈয়দপুরে। বিশেষ করে চার জেলা পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর ও নীলফামারী জেলার আট লাখ চাপড়া সৈয়দপুরে নিয়ে আসা হয়। মৌসুমী ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ওই জেলাগুলো থেকে চামড়া ক্রয় করে সৈয়দপুরের বড় মাহাজনের কাছে বিক্রি করেন। আর বড় মহাজনদের যোগসুত্র ট্যানারী মালিকদের সাথে। ফলে বড় মহাজনরা যে ভাবে চামড়ার মূল্য নির্ধারন করে দেয় ঠিক সে ভাবেই ক্ষুত্র মৌসুমী ব্যবসায়ীরা চামড়া ক্রয় করে থাকে।
এবার সরকারী ভাবে চামড়ার মূল্য নির্ধারন করা হয়েছে গরুর লবণযুক্ত কাঁচা চামড়ার দাম ৬০ থেকে ৬৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। আর খাসির লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট চামড়ার দাম ২২ থেকে ২৭ টাকা এবং বকরির চামড়া ২০ থেকে ২২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া ঢাকায় গরুর চামড়া প্রতি পিস ১ হাজার ৩৫০ টাকার নিচে কেনা যাবে না এবং ঢাকার বাইরের চামড়া ১হাজার ১৫০ টাকার নিচে কেনা যাবে না। পাশাপাশি সরকার জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে ঈদের পর অন্তত ১৫ দিন পর্যন্ত কাঁচা চামড়া স্থানীয় ব্যবস্থাপনায় সংরণের জন্য জেলা প্রশাসকদের নির্দেশনা দিয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে চামড়া সংরণ, হাট-বাজার ব্যবস্থাপনাসহ তিন মাসের জন্য কাঁচা চামড়া এবং ওয়েট ব্লু চামড়া রপ্তানির শর্ত শিথিল করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এছাড়া ঢাকায় ১০ দিনের আগে কাঁচা চামড়া প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না।
মৌসুমী চামড়া ব্যবসায়ীরা বলছেন উত্তরাঞ্চলের শহর বা গ্রামে গঞ্জে চামড়া বর্গফিট হিসাবে কেনাবেঁচা হয়না। পিচ হিসাবে ক্রয় করা হয়। সে ক্ষেত্রে গরুর (সাইজ অনুযায়ী) কাঁচা চামড়ার মূল্য ৩০০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে সীমাবন্ধ রাখতে বলেছেন বড়মহাজনরা। চামড়া কিনে লবণ দিয়ে রাখার পর সেই চামড়া বড় মহাজনদের নিকট বিক্রির রেট রাখা হয়েছে সাইজ অনুযায়ী ৫০০ টাকা থেকে ৭০০ টাকা। এরমধ্যে পরিবহ খরচও যাবে মৌসুমী ব্যবসায়ীর পকেট থেকে।
সরকারের বেধে দেওয়া দামে চামড়া কেনা-বেচা সম্ভব নয় বলে দাবি স্থানীয় ব্যবসায়ীদের। রংপুর জেলা চামড়া ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি মো. আফজাল হোসেন জনকন্ঠের প্রতিবেদককে বলেন, চামড়া কিনে কোথায় বিক্রি করা হবে, এ নিয়েই ব্যবসায়ীরা বেশি চিন্তিত। এখন চামড়ার দাম নেই। তার মধ্যে আর্থিকভাবে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত। দেশের প্রায় দুই শতাধিত ট্যানারির মধ্যে এখন হাতে গোনা কয়েকটি ট্যানারি চালু রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে কেউ চামড়া কিনে নতুন করে লোকসানের বোঝা ভারী করতে চাইছেন না। তারপরও অনেকেই চামড়া কিনবেন।
সেক্ষেত্রে সরকারের বেধে দেওয়া দামের চেয়ে কম-বেশি হতে পারে। তিনি বলেন, চামড়া সংরক্ষণে ব্যবহৃত লবণের দাম বেড়েছে। সরকার লবণ ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভাঙতে পারেনি। একদিকে লবণ সিন্ডিকেট অন্যদিকে চামড়ার ন্যায্য দাম না পাওয়ার শঙ্কা, এক-দুই সিন্ডিকেটের কারণে প্রান্তিক পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা হাতগুটিয়ে নিচ্ছেন।
ভালো দাম না পাওয়ার কারণ প্রসঙ্গে আফজাল হোসেন জনকন্ঠের প্রতিবেদককে বলেন, চামড়ার সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থা গড়ে না উঠায় বর্তমানে চামড়া ব্যবসায়ীরা ভালো দাম পাচ্ছেন না। এমনিতে দীর্ঘদিন থেকে ট্যানারি মালিকদের কাছে এখানকার ব্যবসায়ীদের লাখ লাখ টাকা বকেয়া পড়ে আছে। ব্যবসায়ীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ পেশা পরিবর্তন করেছে অথবা পুঁজি হারিয়ে পথে বসেছে। তাই চামড়া শিল্পে ব্যাংক ঋণ চালু করাসহ সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান তিনি।
নীলফামারীর মৌসুমী চামড়া ব্যবসায়ী রোস্তম আলী(৬৫) জনকন্ঠের প্রতিবেদককে জানালেন, আমাদের সাথে কোন ট্যানারী মালিকদের যোগাযোগ নেই। আমরা সৈয়দপুর পর্যন্ত যেতে পারি। এদিককার মৌসুমি ব্যবসায়ীরা পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও ,দিনাজপুর ও নীলফামারীর চামড়া সৈয়দপুরে এনে সৈয়দপুর মহাজনদের নিকট বিক্রি করেন। তিনি বলেন, মহাজন ও ট্যানারী মালিকদের সিন্ডিকেটে আমরা মৌসুমী চামড়া ব্যবসায়ীরাও ধরাশায়ী।ওরা তাদের হিসাব ঠিক করে অমৌসুমী ব্যবসায়ীদের ব্যবহার করেন। তারা দাম নির্ধারন করে দেয় বলেই আমরা কোরবানীর চামড়া বেশী দামে ক্রয় করতে পারিনা।
এ ব্যাপারে অন্যান্য জেলার মৌসুমী চামড়া ব্যবসায়ীদের মতামত জানতে চাইলে তাদের কথার সাথে নীলফামারীর মৌসুমী চামড়া ব্যবসায়ী রোস্তম আলীর কথার হুবাহু মিলে যায়।
সৈয়দপুরে বেশ কিছু মহাজন জনকন্ঠকে জানান, চামড়া শিল্পে সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা না থাকায় হাতে গোনা ট্যানারি মালিকদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন তারা। বর্তমানে পশুর চামড়া ন্যায্য দামে বিক্রি করতে না পেরে অনেকে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। ফলে আসন্ন ঈদ-উল-আজহার কোরবানির পশুর চামড়া কেনাকে সামনে রেখে তেমন কোনো কর্মচাঞ্চল্য নেই। একটি সময় পশুর চামড়ার দাম ছিল। ফলে চামড়াপট্টিগুলো ছিল সরগম। এখন চামড়ার ব্যবসা না থাকায় এখন কোরবানীর ঈদের দিন ছাড়া বোঝা যায় না চামড়াপট্টি বলে এলাকা রয়েছে। চামড়া ব্যবসাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল চামড়া ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি। এসব এখন শুধুই ইতিহাস। ঈদকে ঘিরে এখন আর চামড়া ব্যবসায়ীদের মধ্যে সাজ সাজ রব লক্ষ্য করা যায় না। এক প্রশ্নের জবাবে সৈয়দপুরের মহাজন একজন জানালেন, ট্যানারী মালিকরা যে দাম বেঁধে দেয় সেখান থেকে আমরা কিছুটা লাভ রেখে জেলায় জেলায় মৌসুমী ব্যবসায়ীদের রেট বলে দেয়া হয়। তিনি বলেন, আমরাও চাই সরকারি রেধে দেয়া মূল্যে চামড়া ক্রয় করবো। কিন্তু তা ট্যানারী মালিকদের কারনে হয়না।
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, ট্যানারি মালিকদের কাছ থেকে বকেয়া টাকা তুলতে ব্যর্থ হয়ে অনেকেই চামড়ার ব্যবসা ধরে রাখতে পারেননি। আবার অনেকে চামড়া ব্যবসায় ঋণ না পেয়ে পুঁজির অভাবে পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছেন। এখন যারা বাপদাদার এই ব্যবসা ধরে আছেন, তারা হাতে গোনা কয়েকজন। তাদের দাবি, এ শিল্পকে বাঁচাতে হলে সরকারিভাবে চামড়া কেনা-বেচায় নীতিমালা তৈরি, চামড়া শিল্পে ঋণের ব্যবস্থা করাসহ কাঁচা চামড়া সংরণে সরকারকে যুগোপযোগী সিদ্ধান্তগ্রহণ করতে হবে। অপর দিকে রংপুর, কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট এবং গাইবান্ধা এলাকার জন্য চামড়ার বড়হাট বসে গাইবান্ধার পলাশবাড়ী থানার কালিবাড়ী হাট। সপ্তাহে দুইদিন হাট বসে। তবে অনেক মৌসুমী চামড়া ব্যবসায়ীরা মহাজনদের ওভারটেক করে ওই হাটে গিয়ে চামড়া বিক্রি করেন। কিন্তু সেখানেও রয়েছে ট্যানারী মালিকদের সিন্ডিকেট। বেশ কয়েকজন চামড়া ব্যবসায়ী জনকন্ঠকে জানান, আগে হাটগুলোতে রিলায়েন্স, বিএলসি, আরকে লেদার, আজমেরি লেদার, পান্না লেদার, মুক্তা ও মুক্তি ট্যানারিসহ বিভিন্ন ট্যানারির প্রতিনিধিরা আসতেন। এখন তাদের সংখ্যা কমে গেছে। যারা হাটে আসেন তাদের মধ্যে সিন্ডিকেট রয়েছে। কোনো কারণে যদি একটি ট্যানারির প্রতিনিধি হাটে না আসে, তাহলে চামড়ার দাম বৃদ্ধির কোনো সুযোগ থাকে না। ট্যানারি মালিকদের নির্ধারিত দামে চামড়া বিক্রি করতে হয়। তখন বেশি দামে চামড়া কেনা থাকলেও কম দামে বিক্রি ছাড়া কোনো উপায় থাকে না।
চমড়া ব্যবসায়ী শামছুল হক জনকন্ঠকে বলেন, চামড়ার বাজারে ধস নেমেছে। ট্যানারি ছাড়া স্থানীয়ভাবে চামড়া সংরণে বিকল্প কোনো উপায় নেই। এখন আমদানিও কম। লবণের দাম তো বেড়েই চলেছে। এতো কিছুর মাঝেও ট্যানারি মালিকেরা সরকার থেকে ঋণ পাচ্ছে। কিন্তু আমাদের মতো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ঋণ সুবিধার বাইরে রয়েছে। আমাদের ঋণ দেওয়া হয় না। অথচ ট্যানারি মালিকেরা চামড়া ব্যবসার নামে ঋণ নিয়ে তা অন্যখাতে বিনিয়োগ করছে।
ইমরান