ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৬ জুন ২০২৫, ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

পদমদীতে লুকিয়ে আছে বাংলা সাহিত্যের এক বিস্ময়!

মনজু শেখ, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, রাজবাড়ী

প্রকাশিত: ০০:৫৩, ৪ জুন ২০২৫

পদমদীতে লুকিয়ে আছে বাংলা সাহিত্যের এক বিস্ময়!

ছবি: জনকণ্ঠ

বাংলা সাহিত্যের আকাশে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, উনিশ শতকের শ্রেষ্ঠ মুসলিম সাহিত্যিক হিসেবে খ্যাত মীর মশাররফ হোসেন শুধু একজন লেখক ছিলেন না। তিনি ছিলেন এক অনন্য চিন্তাবিদ, সমাজসচেতন শিল্পী এবং সাহিত্য আন্দোলনের পথিকৃত। তাঁর সৃষ্টি, জীবন, সংগ্রাম এবং অসামান্য প্রতিভার গল্প যেন এক মহাকাব্যের মতো বিস্তৃত।

মীর মশাররফ হোসেন জন্মগ্রহণ করেন ১৮৪৭ সালের ১৩ই নভেম্বর কুষ্টিয়া জেলার লাহিনীপাড়া গ্রামে, এক সম্ভ্রান্ত ও ধনাঢ্য ভূস্বামী পরিবারে। তাঁর পিতা ছিলেন মীর মোয়াজ্জেম হোসেন এবং মাতা দৌলতন নেছা। তাঁর পূর্বপুরুষ বাগদাদ থেকে এসে ভারতীয় উপমহাদেশে স্থায়ী হয়েছিলেন এবং মোগল সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। এই বংশের শেকড় রাজবাড়ী জেলার পদমদী গ্রামে প্রোথিত, যা পরবর্তীকালে মীর সাহেবের সাহিত্যজীবনের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়।

শৈশবে মীর মশাররফ হোসেনের শিক্ষাজীবন শুরু হয় গৃহশিক্ষার মাধ্যমে, এরপর গ্রামের পাঠশালা, কুষ্টিয়া হাই স্কুল, পদমদী স্কুল এবং কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে। এক সময় কলকাতায় পড়াশোনার সুবাদে তিনি সাহিত্যিক পরিবেশে প্রবেশ করেন। কিন্তু ব্যক্তিজীবনে এক বেদনাদায়ক অধ্যায় শুরু হয়, যখন প্রেমিকা লতিফন্নেসার আত্মহত্যা তাঁর জীবনে গভীর দাগ কেটে যায়। তিনি বিবাহ করেন আজিজন্নেসাকে, কিন্তু সেই বিবাহ সুখকর না হওয়ায় পরে কুলসুম বিবিকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন, যাঁর গর্ভে তাঁর ১১টি সন্তান জন্ম নেয়।

মীর মশাররফ হোসেন বাংলা সাহিত্যে মুসলিম সমাজের প্রথম সফল রচয়িতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। তাঁর লেখা ‘বিষাদসিন্ধু’ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক উপন্যাস। কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনার ভিত্তিতে রচিত এই গ্রন্থটি আজও মুসলিম ঘরে ঘরে শ্রদ্ধার সাথে পঠিত হয়।

তিনি শুধু উপন্যাস নয়, নাটক, কবিতা, প্রহসন, প্রবন্ধ, আত্মজীবনী ও ধর্মীয় সাহিত্যসহ প্রায় ৫০টিরও বেশি গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাগুলোর মধ্যে রয়েছে

জমিদার দর্পণ (নাটক), রত্নবতী, এর উপায় কী, গাজী মিয়ার বস্তানী, উদাসীন পথিকের মনের কথা, মৌলুদ শরীফ, মুসলমানের বাঙ্গালা শিক্ষা, আমার জীবনী, বিবি কুলসুম। তাঁর গদ্য ভাষা ছিল স্বচ্ছ, প্রাঞ্জল ও বিশুদ্ধ বাংলা, যা তৎকালীন মুসলমান সাহিত্যিকদের জন্য এক বিপ্লবী দৃষ্টান্ত ছিল।

মীর মশাররফ হোসেনের সাহিত্যচর্চা শুরু হয়েছিল সাংবাদিকতা দিয়ে। তিনি কাঙাল হরিনাথের ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ এবং ঈশ্বর গুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’-এ লেখালেখি করতেন। নিজেও প্রকাশ করেছিলেন পত্রিকা ‘আজিজন নেহার’ ও ‘হিতকরী’। সংগীতেও ছিল তাঁর অসাধারণ দক্ষতা—তিনি রচনা করেন বাউল গান ও রাগনির ওপর সংগীত, যা ‘সংগীত লহরী’ নামক গ্রন্থে স্থান পায়।

১৯১১ সালের ১৯ ডিসেম্বর রাজবাড়ীর পদমদী গ্রামে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কুলসুম বিবির পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়। পরবর্তীকালে, তাঁর স্মৃতিকে সম্মান জানাতে পদমদীতে নির্মিত হয় ‘মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতিকেন্দ্র’।

মীর মশাররফ হোসেন ছিলেন এক বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী একাধারে সাহিত্যিক, সমাজসচেতন চিন্তাবিদ ও সংস্কৃতিবান পুরুষ। ‘বিষাদসিন্ধু’ তাঁকে অমর করে রেখেছে, তবে তাঁর সমগ্র সাহিত্যকর্মই আজও বাংলা সাহিত্যের এক বিশাল ও মূল্যবান ঐতিহ্য। বাংলা ভাষা ও মুসলিম সাহিত্যজগতে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় এবং প্রেরণাদায়ক। তিনি আজও আমাদের হৃদয়ে এক অম্লান, অমর প্রতীক।

শহীদ

×