
ছবি: সংগৃহীত
বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়কের পাশে জলিলের টং হোটেল যা সাধারণত জলিল হোটেল নামে পরিচিত। কাঠের পাটাতনের ওপর টিনসেড নির্মিত ঘরে সাদামাটা পরিবেশে পেটপুরে মজাদার খাবার গ্রহণের এক সেরা ঠিকানা জলিল হোটেল। দীর্ঘ ৪২ বছর ধরে হোটেলটির খাবারের মান, সুনাম ও ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন হোটেল মালিক আবদুল জলিল।
শুধু পটুয়াখালীই নয়, বরং ৬৪ জেলার ভোজনরসিক মানুষই এখানকার ক্রেতা। ঢাকা থেকে কুয়াকাটা যাওয়া-আসার পথে খুব কম মানুষই রয়েছেন যারা একবার হলেও এখানকার খাবারের স্বাদ নেননি। আর স্থানীয়রা তো নিয়মিত ক্রেতা।
দুপুরের সময় ক্রেতাদের সবচেয়ে বেশি ভিড় লক্ষ করা যায় এখানে। সরেজমিনে দেখা যায়, প্রবেশ পথের পাশেই ক্রেতার সামনে মাটির চুলোয় কাঠ দিয়ে রান্না হচ্ছে মুখরোচক সব খাবার। অন্যদিকে চেয়ার-টেবিল পাতানো টিনসেড ঘরটিতে বসে আনন্দিত মনে খাওয়া দাওয়া করছেন ক্রেতারা। অনেকেই জায়গা না পেয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন পরবর্তী ধাপে বসার জন্য।
এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে খাবার নিয়ে ছোটাছুটিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কর্মচারীরা। কর্মচারীদের দিকনির্দেশনাসহ আগত কাস্টমারদের হাসিমুখে স্বাগতম জানাচ্ছেন সাদামাটা পোশাকে থাকা হোটেল মালিক আবদুল জলিল। রুচিসম্মত খাবারের জন্য প্রায় তিনযুগেরও বেশি সময় ধরে চলমান পটুয়াখালীর হেতালিয়া বাধঘাটে অবস্থিত এ খাবারের হোটেলটির নাম এখন সবার মুখে।
মাদারবুনিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা আয়শা সিদ্দিকা বলেন, ‘আমার দাদা ছিলেন এই হোটেলের কাস্টমার, পরবর্তীতে প্রতি সপ্তাহে একবার বাবাও খেতে আসতেন এখানে। তারা ভোজনরসিক হওয়ায় প্রতি শুক্রবার শুধুমাত্র এখানে খাবার গ্রহণের উদ্দেশ্যেই বাড়ি থেকে আসতেন। দাদা চলে গেছেন না ফেরার দেশে, বাবাও অসুস্থ। তবে এখন মাঝেমধ্যেই আমরা এখানে চলে আসি খাবার খেতে। এখানকার খাবার খুবই ভালো, বিশেষ করে এখানকার চিংড়ি মাছটি আমার খুব প্রিয়। এমন চিংড়ির স্বাদ আর কোথাও নাই।’
এখানে খেতে আসা দেলোয়ার হোসেন এর সাথে কথা হয় বেশ কিছুক্ষণ। তিনি বলেন, ‘মাটির চুলোয় রান্না করায় এ হোটেলের খাবারগুলো খুবই ভালো লাগে। বিশেষ করে এখানকার ডাইল খাসি (ডাল ও খাসির মাংসের সমন্বয়ে রান্না করা বিশেষ খাবার) খেতে খুবই ভালো লাগে।’
আবহমান কাল ধরে চলে আসা বাঙালির অন্যতম চেনা খাবার দুধ-কলাও পাওয়া যায় এখানে। মাছ, মাংস দিয়ে খাওয়া শেষ করে তাইতো একগ্লাস খাঁটি দুধ ও কলাও খান ভোজনরসিক ক্রেতারা। এখানে ভাত খাওয়ার জন্য পাওয়া যায় চিংড়ি ভুনা, ডাল খাসি, মুরগির মাংস, দুধ-কলাসহ নানা ধরনের আইটেম।
হোটেলটির রয়েছে একটি বিশেষ রীতি, ভাতের জন্য মাত্র ২০ টাকা পরিশোধ করে তরকারির সাথে আনলিমিটেড ভাত খাওয়া যাবে এখানে। তাইতো, ক্রেতার সম্মুখে বড় গামলায় ভাত পরিবেশন করেন তারা। ক্রেতা তার প্রয়োজন মতো সেখান থেকে নিয়ে খান।
এছাড়াও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে হোটেলটির। পুরো রমজান মাস বন্ধ রাখা হয় প্রতিষ্ঠানটি। তখন কাস্টমারদের জন্য হোটেল বন্ধের বিজ্ঞপ্তি টাঙিয়ে দেওয়া হয় মুল ফটকের সামনে।
স্থানীয় বাজার থেকে সংগ্রহ করা নদী ও সাগরের তাজা মাছ, মাটির চুলোয় গ্রামের ঘরোয়া স্টাইলে রান্না ও কম মসলার ব্যবহারই মূলত এখানকার খাবারের এনে দিয়েছে অনন্য স্বাদ যা কুড়িয়েছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা। জানা যায়, প্রতিদিন গড়ে প্রায় চার শতাধিক মানুষ খাওয়া-দাওয়া করেন এখানে।
হোটেলটিতে বর্তমানে কাজ করছেন ৭ জন কর্মচারী। যারা প্রতিনিয়ত হিমশিম খাচ্ছেন ক্রেতাদের খাবার পরিবেশন করতে। হোটেল কর্মচারী আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘দুপুর হলেই বেড়ে যায় আমাদের ব্যস্ততা, কাস্টমারদের খাবার পৌঁছে দেই এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে। মনে হয় যেন শ্বাস করারও সময় পাই না। তবে কাস্টমারদের এমন সেবা দিতে পেরে আমরা অনেক খুশি। এখানে দীর্ঘ বছর ধরে কাজ করি। আমাদের মালিক নিজ পরিবারের সদস্যের মত ভালোবাসেন, প্রতি মাসের বেতন-ভাতা যথাসময়েই দিয়ে দেন।’
বর্তমানে বাবার এ হোটেল ব্যবসার সাথে হাল ধরেছেন আব্দুল জলিলের পূত্র রবিউল ইসলাম শাকুর। কাস্টমারদের কাছ থেকে বিল গ্রহণ তথা ক্যাশ সামলানোর দায়িত্ব পালন করেন তিনি। বর্তমানে স্নাতক শ্রেণিতে পড়ছেন পটুয়াখালী সরকারি কলেজে।
রবিউল বলেন, ‘বাবার সাথে ব্যবসায় সহযোগিতা করছি আমি। কাস্টমারদের এমন ভিড় খুবই ভালো লাগে। মূলত, আমাদের খাবারের প্রতি মানুষের আস্থা রয়েছে তাই তারা এখানে আসেন, আমাদের ব্যবসার মূলধন এটাই, বিশ্বস্ততা। এখানে যারা আসেন, তারা এ বিশ্বস্ততা থেকেই আসেন। আর এখানে আমরা তুলনামূলক কম দামে সবকিছু বিক্রি করি। যাতে সকল শ্রেণির ক্রেতাই এখানে খেতে পারেন। এজন্যই ক্রেতারা আমাদের এতো ভালোবাসেন।’
পটুয়াখালী সদর উপজেলার মাদারবুনিয়া ইউনিয়নের ২ নং ওয়ার্ড বোতলবুনিয়া গ্রামের বাসিন্দা আবদুল জলিল(৭০)। চার মেয়ে ও এক ছেলে সন্তানের জনক তিনি। হালাল পথ ধরে ব্যবসা করে আসা জনাব জলিল বলেন, ‘জীবনে খুব কষ্ট করছি। দই-চিড়া-মুড়ির ভাসমান দোকান করছি। গ্রাম্য হাটে হাটে ঘুরে এসব বেচছি। এরপর ছোট্ট হোটেল করছি, তাও প্রায় ৪২ বছর। এখন আল্লাহর রহমতে ভালো আছি।’
সোহাইব মাকসুদ নুরনবী/রাকিব