
ছবি : জনকন্ঠ
কুয়াকাটা সৈকতে সাগরের পানির লেভেল ঘেষে নির্মাণাধীন আরসিসি রাস্তাটি জলোচ্ছ্বাসের তান্ডবে লন্ডভন্ড হওয়ার খবরটি এখন এই জনপদে আলোচিত রয়েছে। ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবিসহ এই খবরটি ভাইরাল হয়ে আছে । চায়ের দোকান থেকে শুরু করে সর্বত্র বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে। সবাই জানতে চায় এটির পূর্ণাঙ্গ খবর। এমনকি কুয়াকাটায় যাওয়া পর্যটক দর্শনার্থীরা বিধ্বস্ত দশার রাস্তাটির ছবি তুলছেন। ভোলেন না সেলফি পর্যন্ত তুলতে। বৃহস্পতিবার দুপুরে অস্বাভাবিক জোয়ারে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস তান্ডবে নির্মানাধীন রাস্তাটি ধসে বিধ্বস্ত হয়। ভেসে যায় ফুটপাতসহ মূল সিসি রাস্তার অর্ধেকটা।
রাস্তাটি ধসে পড়ার দিবাগত রাতেই এ ঘটনায় পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠণ করেন কুয়াকাটা বীচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সদস্য সচিব ও কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. রবিউল ইসলাম। যেখানে কুয়াকাটা পৌরসভার প্রশাসক ও সহকারী কমিশনার ( ভূমি) মো. ইয়াসীন সাদেককে প্রধান করা হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড কলাপাড়ার নির্বাহী প্রকৌশলী, কলাপাড়া জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী, এলজিইডির উপজেলা প্রকৌশলী ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাকে সদস্য করা হয়েছে। এ কমিটিকে সাত দিনের মধ্যে একটি মতামত দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। উপজেলা প্রশাসন থেকে জানানো হয়েছে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ পদক্ষেপ নেওয়া হবে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
কুয়াকাটা পৌরসভা সূত্রে জানা গেছে, কুয়াকাটার অপসারিত মেয়র আনোয়ার হাওলাদার এই কাজটি তার নিজস্ব লোকজন দিয়ে শুরু করেন। কথিত আছে টেন্ডারের আগেই কাজ শুরু করা হয়। নথিপত্রের তথ্যমতে ‘ গুরুত্বপূর্ণ নগর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের (দ্বিতীয় ফেজ) আওতায় চার কোটি ৮৫ লাখ টাকা ব্যয় ‘ সাগরপারের সি কুইন থেকে ঝাউবাগান পর্যন্ত ১৩০০ মিটার আরসিসি রাস্তা নির্মাণ’ নামে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। যার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ছিল তিনটি। মেসার্স আবরার এন্টাপ্রাইজ (৪৫০ মিটার), এসএম ট্রেডার্স (৪৫০ মিটার) ও মোল্লা ট্রেডিং (৪০০ মিটার)। তিনটি প্যাকেজে কাজটি করার জন্য ২০২৪ সালের ২৪ মার্চ কার্যাদেশ দেওয়া হয়। এ কাজটি শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২৫ সালের ২৩ মার্চ। কিন্তু কাজের অগ্রগতি কম থাকায় সময়সীমা আরও ৭২ দিন বাড়ানো হয়েছে। বিধ্বস্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত রাস্তাটির নির্মাণ কাজের অগ্রগতি ছিল ৫০ ভাগ।
সূত্রমতে, সৈকতঘেঁষে ১৩০০ মিটার রাস্তা আরসিসি করার কথা। সাইডে কার্ভস্টোন, সেগমেন্ট টালি দিয়ে ফুটপাত করার কথা রয়েছে। এ কাজটির জন্য এ পর্যন্ত ঠিকাদারকে প্রায় এক কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, ঠিকাদার তিনজনই অনেকটা ডামি হিসেবে ছিল। মূলত পৌরসভার তৎকালীন মেয়র আনোয়ার হাওলাদারের ঘনিষ্ঠ তিন সহযোগী কুয়াকাটা পৌর শ্রমিক লীগ সদস্যসচিব ছগির মোল্লার মেসার্স মোল্লা ট্রেডার্স, পৌর শ্রমিক লীগ যুগ্ম আহ্বায়ক বেলাল হোসেনের মেসার্স আবরার ট্রেডার্স ও পৌর ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও কনটেন্ট ক্রিয়েটর অভিনেতা সাদ্দাম মাল এর এস এম ট্রেডার্স এ কাজ কাগজে কলমে করছেন।
তদন্ত কমিটি গঠনের চিঠিতে ইউএনও স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন, সমুদ্র সৈকত সংলগ্ন নির্মানাধীন রাস্তাটি খুবই দৃষ্টিকটুভাবে ভেঙে পড়েছে। রাস্তাটির নির্মাণ কাজ খুবই নিম্নমানের। নিম্নমানের লোকাল বালি আর পাতলা সিসি ঢালাইয়ের মাধ্যমে রাস্তাটির কাজ সম্পন্ন করার চেষ্টা করা হয়েছে। নির্মাণের প্রাক্কলনে কোন ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি মর্মে প্রতীয়মান হয়েছে। স্থানীয়ভাবে জনগণ, গণমাধ্যম তথা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হলেও উক্ত প্রকল্প কমিটি ও তৎকালীন পৌর কর্তৃপক্ষ কোন কর্ণপাত করেনি।
তবে অপসারিত মেয়র আনোয়ার হাওলাদার জানান, ওই প্রকল্পটি যথাযথ প্রক্রিয়ায় টেন্ডার দিয়ে কাজ শুরু করা হয়েছে। কেবল সিসি কাজ চলমান রয়েছে। এরপর আরসিসির কাজ হওয়ার কথা। ঢেউয়ের ঝাপটা ঠেকাতে গাইডওয়াল করার ডিজাইন রয়েছে।
পৌরসভার প্রশাসক জানান, রাস্তাটির ক্ষতিগ্রস্ত অংশ ঠিকাদার দিয়ে মেরামত করা হবে। এছাড়া সাগরের ঢেউয়ের প্রটেকশনের জন্য রিটেইনিং ওয়াল, জিও ব্যাগ, বøক প্রটেকশনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রবিউল ইসলাম জানান, দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ইতোমধ্যে চিঠি প্রস্তুত করা হয়েছে। ঠিকাদারদের বকেয়া বিল, জামানত বাজেয়াপ্ত করে ক্ষতিপুরণ আদায় করা হবে।
তবে সাধারণ মানুষ এই কাজের তদারকিতে থাকা প্রকৌশলীদের বিরুদ্ধে যথাযথ বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জোরালো দাবি করেছেন। স্থানীয়রা জানান, আদৌ সাগরের জোয়ারের লেভেল ঘেঁষা ওই বরাবর এই রাস্তা নির্মাণের সিদ্ধান্ত কতটুকু বাস্তবসম্মত। প্রকল্প প্রণয়নের সময় আদৌ কোন ধরনের সমীক্ষা চালানো হয়েছে কিনা। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোন মতামত নেওয়া হয়েছে কিনা এমন সব প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।
আঁখি