
মেধাবী জান্নাতী,নবম শ্রেণির ছাত্রী। স্বপ্ন দেখতো ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করার। কিন্তু শুধুমাত্র পারিবারিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে বাবা-মায়ের কাছেই হত্যার শিকার হলো। পৃথিবীর সব বাবা-মায়ের কাছে সন্তানরা সবচেয়ে নিরাপদ। তাহলে নিষ্পাপ জান্নাতীর ভাগ্যে এ কী ঘটলো! হত্যার ৭ দিন পার হলেও এখনও নির্বাক হয়ে আছে পুরো গ্রামের মানুষ আর আত্মীয়স্বজনরা। বাবা-মা সন্তানকে হত্যা করতে পারে তা মেনে নিতে পারছে না কেউ।
শুধু হোলখানা ইউনিয়নের দুর্গম কাগজিপাড়া গ্রামে নয়, সারা কুড়িগ্রামের সর্বত্রই একই আলোচনা। দেশের শান্তিপ্রিয় জেলা হিসেবে পরিচিত হিমালয়ের পাদদেশে ছোট্ট জেলা কুড়িগ্রাম। সেখানে এ ঘটনাটি চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার হোলখানা ইউনিয়নের কাগজিপাড়া গ্রামে ধরলা নদীর পারে স্কুলছাত্রী জান্নাতীর বাড়ি। তার বাবা জাহিদুল ইসলাম (৪৯), মা মোরশেদা বেগম (৩৫)। ছোটবেলা থেকেই শান্ত প্রকৃতির মেধাবী জান্নাতী। বাবা-মায়ের আদরের সন্তান। কিন্তু কিভাবে এমন নিষ্ঠুর আচরণ করলো বাবা-মা, কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না।
গত সোমবার দুপুরে হোলখানার কাগজিপাড়া গ্রামে সরেজমিন গিয়েছিলেন জনকণ্ঠের এই প্রতিবেদক। ধরলা নদী পার হয়ে বেশ কিছু পথ হেঁটে যেতে হয়। পুরো গ্রাম দিনের বেলাও সুনসান নীরবতা। জান্নাতীদের সাথে আরও তিনটি বাড়িতে কোনো মানুষ নেই। এই গ্রামের মানুষ ওই ঘটনায় সন্ধ্যার পর কেউ ঘর থেকে বের হয় না—অজানা এক আতঙ্কে। জান্নাতীর বাড়ির সাথে তিনটি বাড়িতেও নেই কোনো মানুষ। সবাই মামলার ভয়ে পালিয়েছে।
ইতিমধ্যে জান্নাতীর বাবা-মা ও চাচিকে পুলিশ গ্রেফতার করে জেলে প্রেরণ করেছে। তারা পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে, জমি সংক্রান্ত বিরোধের জেরে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতেই নিজের কিশোরী কন্যাকে হত্যা করেছে। এর পরিকল্পনা করেছিল প্রায় এক মাস আগেই।
মর্মান্তিক এই হত্যাকাণ্ডের জড়িত বাবা-মা এবং চাচিকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি গ্রামবাসীদের। প্রতিবেশী আশরাফুল ও আয়েশা বেগম জানান, তিন দশকের বেশি সময় ধরে বিরোধ চলা ৩২ বিঘা জমি দখলে নিতে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তারা। তারা আরও বলেন, শুধু জান্নাতীর বাবা-মা নয়, তাদের সাথে গ্রামের প্রভাবশালী মুজিবর গং ও পাটোয়ারীগং জড়িত আছে। তাদের পরিকল্পনায় এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হোক।
গ্রামবাসী হালিমা বেগম জানান, বাবা-মা হয়ে কিভাবে সন্তানকে হত্যা করতে পারে জানিনা। মায়ের আত্মা কিভাবে এটা মেনে নিয়েছে বুঝতে পারি না। আমি এই হত্যার কঠিন শাস্তি চাই।
জান্নাতীর সহপাঠী জানায়, সে আমার খুব কাছের সহপাঠী ছিল। আমরা সব সময় একসাথে স্কুলে ও প্রাইভেট পড়তে যেতাম। একসাথে লেখাপড়া করতাম। স্কুলে শিক্ষকদের কাছে সে কখনোই বেয়াদবি করেনি। আমি তার বাবা-মায়ের হত্যার বিচার চাই।
গ্রামবাসীরা জানায়, গত ১১ মে শনিবার রাতে বাড়ির পাশে একটি ভুট্টা ক্ষেতে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে। ঘটনার পর রাত তিনটার দিকে পুলিশ এসে পরের দিন সকালে লাশ নিয়ে যায়। ময়নাতদন্তের পর জান্নাতীকে দাফন করা হয়। পরে নিহত কিশোরীর চাচা খলিলুর রহমান ২৭ জনের নামে সদর থানায় মামলা দায়ের করে।
পুলিশ এ মামলার তদন্তের এক পর্যায়ে নিহত কিশোরীর চাচি শাহিনুর বেগম (৪৫), বাবা জাহিদুল ইসলাম (৪৫) ও মা মোরশেদা বেগম (৩৮) কে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়। পরে আদালতের মাধ্যমে রিমান্ড নেয়। সেখানে তার বাবা-মা ও চাচি মেয়েকে খুনের কথা স্বীকার করে। এ হত্যা অন্যকে ফাঁসানোর জন্য করেছে বলে তারা জানায়।
হোলখানা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রেজাউল করিম রেজা জানান, জান্নাতীর মৃত্যুর ঘটনাটি দুঃখজনক। আমি হত্যাকারীদের শাস্তি দাবি করছি। তিনি আরও বলেন, কয়েক দশক থেকে দুটো পরিবারের মাঝে জমিজমি নিয়ে বিরোধ চলে আসছে। আমরা কয়েকদফা মীমাংসার জন্য বসেছিলাম কিন্তু পারিনি আপস করতে।
কুড়িগ্রাম সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো: হাবিবুল্লাহ খান জানান, আসামি জান্নাতী হত্যা কান্ডের ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে। পূর্ব থেকে জায়গা-জমি সংক্রান্ত বাদী পক্ষের সাথে মুজিবর গং-এর বিবাদ চলমান। জান্নাতীকে হত্যা করেছে তার মা, বাবা ও চাচি। এ কথা তারা স্বীকার করেছে। আমরা অন্যান্য আসামিদের গ্রেফতারের জন্য প্রতিদিন বিভিন্ন জায়গায় চেষ্টা চালাচ্ছি।
আফরোজা