
ছবি: জনকন্ঠ
গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর এবং কোম্পানিগঞ্জ উপজেলা নিয়ে গঠিত সিলেট ৪ আসন। এই তিন উপজেলার মধ্যে জনসংখ্যা ও আয়তনের দিক দিয়ে সর্বোচ্চ উপজেলা গোয়াইনঘাট। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য আর খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ এই উপজেলার জনগণ বরাবরই উন্নয়ন বঞ্চিত এবং অবহেলিত। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্থানীয় প্রার্থী না থাকায় এই লাঞ্ছনা আর বঞ্চনায় অতিষ্ট সাধারণ জনতা। তাদের দাবি স্থানীয় কাউকে সংসদ করা হয় না বলেই আমরা বার-বার উন্নয়ন বঞ্চিত এবং অবহেলিত। শিক্ষা, প্রযুক্তি,যাতায়াত ব্যবস্থা কোন ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি এই উপজেলায়।
দীর্ঘ ১০ বছর থেকে সালুটিকর-গোয়াইনঘাট রাস্তায় বেহাল দশা। উন্নয়নের নামে রাস্তায় হালকা গালা দিয়ে জনতাকে বুঝ দেওয়া হতো। জনগন এবং স্থানীয় জনতার ক্ষোভ এবং জোরালো দাবির প্রেক্ষিতে ২৪এর জানুয়ারিতে এই রাস্তার কাজ শুরু হলেও তা বন্ধ হয়ে আছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এবং প্রশাসনের গাফিলতির কারনে।
এদিকে,বরাবরের ন্যায় বন্যার পূর্বাভাসও দেখা যাচ্ছে । দুই লক্ষধিক মানুষের যাতায়াতের প্রধান এই সড়কের কাজের অগ্রগতি খুবই কম। মেয়াদ বাড়িয়েও নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ হচ্ছে না। যানজট,দুর্ভোগ, দুর্ঘটনা নিত্যদিনের রুটিন। শিক্ষার্থী, কর্মক্ষম মানুষেরা সময় মতো পৌঁছাতে পারছেনা তাদের নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে। পর্যটকরা আগ্রহ হারিয়েছে ভ্রমণে। গাড়ি চালকরা যেতে চান না। ফলে যাত্রীদের গুনতে হয় অধিক ভাড়া
বৃষ্টি হলে কাদা-পানিতে একাকার সড়কটি জলাশয় না রাস্তা তা বোঝা মুশকিল। ফলে প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা। কোনো কোনো জায়গায় হাঁটুসমান পানি থাকে। সেখানে ঝুঁকি নিয়ে চলছে যাত্রী ও পণ্যবাহী যানবাহন।
জানা গেছে, প্রায় ১০ কিলোমিটার আরসিসি ঢালাইয়ের মেয়াদ ৫ মাস বাড়িয়েও শেষ হয়নি এক তৃতীয়াংশ কাজ। যেটুকু কাজ হয়েছে তাতে অনিয়ম ও নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগও পাওয়া গেছে। কাজের শুরু থেকেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের উদাসীনতা এবং সঠিক সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় চরম দুর্ভোগে মানুষ।
উপজেলার,তোয়াকুল থেকে সালুটিকর পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কের কাজটি ২০২৪ সালের ৩০ জানুয়ারি শুরু হয়। প্রায় ২৯ কোটি টাকা ব্যয়ে সড়কটি আরসিসি ঢালাই কাজ শুরু হলেও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ও এলজিইডির যোগসাজশে শুরু থেকেই অনিয়ম ও নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করার অভিযোগ তুলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা।
গোয়াইনঘাট উপজেলা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘস্থায়িত্বের জন্য ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে গোয়াইনঘাট-সালুটিকর সড়কে দুই ভাগে ১০ কিলোমিটার সড়কের আরসিসি ঢালাই কাজের উদ্যোগ নেয় এলজিইডি। ২৮ কোটি ৯৯ লাখ ৮ হাজার ৩২৭ টাকা চুক্তিমূল্যে (দুই ভাগে) এ কাজ পায় ডিসিএল অ্যান্ড এমডিএইচ (জেবি) নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। মূলত কাজটি পান দেলওয়ার হোসেন নামে বরিশালের এক ঠিকাদার। তবে কাজটি বাস্তবায়ন করছেন সুনামগঞ্জের ফয়সল নামে একজন ঠিকাদার। ২০২৪ সালের ৩০ জানুয়ারি কাজ শুরু করে শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২৫ সালের ২ জানুয়ারি। কিন্তু নির্ধারিত সময় পার হওয়ার পরও কাজ শেষ করতে পারেনি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। যে কারণে সময় আরও ৫ মাস বাড়ানো হয়। বাড়ানো সময় অনুযায়ী চলতি মাসের ১০ মে কাজ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু বাড়তি সময় শেষ হয়ে গেলেও এতদিনে ৩০ শতাংশ কাজও শেষ করতে পারেনি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান।
তবে প্রকৌশলী হাসিব আহামেদ দাবি করেন, এ পর্যন্ত ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ কাজ সমাপ্ত হয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, তোয়াকুল এলাকা থেকে সড়কের দুই পাশে মাঝে মধ্যে ঢালাই কাজ হয়েছে। ওপর পাশগুলোতে খানাখন্দ যেন মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। সম্পন্ন হওয়া কাজের বিভিন্ন স্থানে ভেঙে গেছে, অনেক জায়গায় ধরেছে ফাটল। সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। পরবর্তী কাজের জন্য ঠিকাদারের কোনো মালপত্রও সেখানে নেই। নেই কাজের সাইনবোর্ডও। সড়কের কাজে কোনো শ্রমিককেও পাওয়া যায়নি।
এসময় কথা হয় এলাকাবাসীর সঙ্গে। তারা জানান, সড়কের ঢালাই কাজের শুরু থেকেই এলজিইডি কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে অনিয়ম ও নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করে আসছেন ঠিকাদার। এ নিয়ে বারবার এলাকাবাসী প্রতিবাদ জানান। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের চিত্র তুলে ধরেন স্থানীয়রা। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। ঠিকাদার কিছুদিন ইচ্ছামতো কাজ করে পরে সড়কের কাজ বন্ধ রেখে চলে গেছেন। এ অবস্থায় ভাঙা সড়কে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা, লেগে থাকছে যানজট। ফলে ভোগান্তিতে পড়েছে স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাসহ জনসাধারণ।
বিছনাকান্দি পর্যটন স্পটে ঘুরতে আসা শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, আমরা কয়েকজন বন্ধু বিছনাকান্দি পর্যটন স্পটে যাওয়ার জন্য বের হয়েছিলাম। এখানে রাস্তায় যে ভোগান্তির শিকার হয়েছি, তা বলে বোঝানো যাবে না। রাস্তায় যে গর্ত, উপর থেকে দেখে বোঝা যাবে না এর গভীরতা কতটুকু। গাড়ি কতটুকু কাৎ হবে তা আন্দাজ করার উপায় নেই।
স্থানীয় ব্যবসায়ী বিলাল উদ্দিন বলেন, প্রায় ৫ বছর ধরে এ সড়কে চলছে দুর্ভোগ। গত দুই বছর আগে কাজ শুরু হলেও কিছুদিন কাজ করে বন্ধ করে দেয়। মাঝে মধ্যে আবার কাজ শুরু করে। গত ঈদুল ফিতরের আগে থেকে একেবারেই কাজ বন্ধ। সিলেট শহর থেকে দোকানের মালামাল আনতে গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত ভাড়া। আর ভোগান্তি তো আছেই।
সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক শরিফ বলেন, সড়কের কাজ শুরু করে আবার তা বন্ধ করায় সড়কটি বেহাল হয়ে পড়েছে। যার কারণে আধা ঘণ্টার গন্তব্যে পৌঁছাতে দুই ঘণ্টারও বেশি সময় লাগে। সড়কের এক অংশ ঢালাই, আরেক অংশ গর্ত করে রাখা এবং রডগুলো খাড়া করে রাখার কারণে আমাদের গাড়ির প্রচুর ক্ষতি হয়। আমরা অসহায় হয়ে পড়েছি। এই কষ্টের কথা বলার কোনো জায়গা নেই।
সড়কের আরসিসি ঢালাই কাজ সঠিকভাবে তদারকি হয়নি অভিযোগ করে দুবাই প্রবাসী লোকমান আহমদ বলেন, সংশ্লিষ্টদের যথেষ্ট গাফলতির কারণে সড়কের এমন দশা হয়েছে। এতে জনগণের ভোগান্তি হচ্ছে। সেই সঙ্গে অর্থের অপচয় হচ্ছে। তাই সরকারের উচিত নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারে জড়িত সবাইকে জবাবদিহির মুখোমুখি করা।
তবে সড়কের কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার হয়েছে- এটা সঠিক না বলে দাবি করেছেন ঠিকাদার দেলোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, কাজ করতে গেলে ত্রুটি-বিচ্যুতি হতে পারে। এগুলো কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে সমাধান করব। কাজ সম্পন্ন হওয়া যেসব স্থান ভেঙে গিয়ে সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আবারও তা মেরামত করে দেওয়া হবে। বাড়ানো মেয়াদ গত ১০ মে শেষ হয়ে গেছে। ২০২৬ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত আবারও কাজের সময় বাড়িয়েছি। যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে কাজ বন্ধ ছিল। আবার কাজ শুরু করবো।
গোয়াইনঘাট উপজেলা প্রকৌশলী (এলজিইডি) হাসিব আহামেদ বলেন, আগামী দুই-চার দিনের মধ্যে আবারও কাজ শুরু করবে ঠিকাদার। তাদের বিল প্রক্রিয়াধীন ছিল। অলরেডি নতুনভাবে আরও দুই কোটি টাকার মতো বিল দেওয়া হয়েছে। এখন থেকে আবারও কাজ চালু হবে।
সড়কে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে কাজ হতেও পারে। এগুলো বেশ আগে করা, গত বছর বর্ষার সময়। আমি আসার আগে। তবে সবচেয়ে বড় কথা সে সময় বৃষ্টি ছিল। আমাদের নির্বাহী প্রকৌশলী স্যারও এগুলো সরেজমিনে দেখে গেছেন। যখন ওই পাশের কাজ করা হবে, তখন এটাও আবার করে দেওয়া হবে।
গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রতন কুমার অধিকারী বলেন, দ্রুত কাজ শেষ করার জন্য অনেক আগেই ঠিকাদারকে চিঠি লিখেছি। ওয়ার্ক অর্ডার শেষ হওয়ায় ঠিকাদারকে আবারও চিঠি দেওয়া হয়েছে। কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে ওই ঠিকাদারের বিরুদ্ধে পরবর্তীতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নতুনভাবে কী করা যায় তা নিয়ে সবার সাথে কথা বলতে হবে। এই মুহুর্তে এর বেশি আমার জানা নেই।
সড়কের কাজে অনিয়ম ও নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সে (ঠিকাদার) তো এখনো পুরো বিল নিতে পারেনি। খানাখন্দ, ভাঙাগুলো ঠিক করার কাজ না করলে তাকে বিল দেওয়া হবে না। কাজ ঠিকমতো করলেই কেবল তাকে বিল দেওয়া হবে।
সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী (এলজিইডি) কে এম ফারুক হোসেন বলেন, সরেজমিনে পরিদর্শন করেছি এবং সম্পন্ন হওয়া সড়কে কিছু কিছু জায়গায় ত্রুটি আমি নিজেই দেখেছি। ঠিকাদারকে অলরেডি চিঠি ইস্যু করেছি। কাজ সংশোধন না করলে তাকে চূড়ান্ত পেমেন্ট দেওয়া হবে না। রানিং কাজ আছে। ঠিক করে দেবে। আমি মুখে বলেছি, অফিসিয়ালি চিঠিও দিয়েছি। গত বছর বন্যার কারণে কাজে বিলম্ব হয়েছে। ঠিকাদার সময় বাড়ানোর আবেদন দিয়েছে। আবহাওয়াজনিত কারণে তাদের আরও সময় দেওয়া হচ্ছে।
মুমু