ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০২ জুলাই ২০২৫, ১৮ আষাঢ় ১৪৩২

শতাধিক বাড়িঘর বিলীন, হুমকিতে কমিউনিটি ক্লিনিক-আশ্রয়ণ প্রকল্প

জামালপুরে যমুনার তীব্র ভাঙন

​​​​​​​নিজস্ব সংবাদদাতা, জামালপুর

প্রকাশিত: ২৩:৩৬, ১১ অক্টোবর ২০২৪

জামালপুরে যমুনার তীব্র ভাঙন

মাদারগঞ্জ উপজেলায় যমুনার ভাঙন

যমুনা নদীর অব্যাহত ভাঙনে জামালপুরের মাদারগঞ্জ উপজেলায় নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে দুই শতাধিক ঘরবাড়ি সাড়ে ৬০০ বিঘা ফসলি জমি। চলতি বর্ষা মৌসুমে উপজেলার চরপাকেরদহ ইউনিয়নের পাকরুল এলাকায় এসব বসতবাড়ি ফসলি জমি নদীতে বিলীন হয়।

এছাড়াও ভাঙনের হুমকির মুখে রয়েছে কমিউনিটি ক্লিনিক, পাকা মসজিদ, কবরস্থান, তিনটি আশ্রয়ণ প্রকল্পের শতাধিক ঘরসহ দুই শতাধিক বসতবাড়ি। যে কোনো সময় এগুলো নদীতে বিলীন হতে পারে। নদী ভাঙন রোধে জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড জিওব্যাগ ফেললেও কোনো কাজেই আসছে না।  কদিকে জিওব্যাগ দিয়ে ভাঙন প্রতিরোধের চেষ্টা করলে অন্যদিকে আবার ভাঙন শুরু হয়। ফলে দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে নদীপাড়ের মানুষের।

স্থানীয়দের অভিযোগ, কয়েক বছর ধরে নদী ভাঙন রোধে স্থায়ীভাবে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। যার ফলে গোটা এলাকা নদীগর্ভে চলে গেছে। আবার সাময়িক নদীভাঙন রোধে যে প্রকল্প দেওয়া হয়েছিল তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হয়নি। নদীতে নামমাত্র জিওব্যাগ ফেলে আওয়ামী লীগের কয়েক নেতা   প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ওইসব প্রকল্পের টাকা নয়ছয় করেন। যমুনার ভাঙন রোধে দ্রুত স্থায়ী কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।

জানা গেছে, বৃহস্পতিবার থেকে যমুনা নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় আবারও তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙনের আশঙ্কায় নদী তীরবর্তী পরিবারগুলো বসতঘর অন্য জায়গায় সরিয়ে নিয়েছেন। কয়েক বছরে পাকরুল এলাকার অধিকাংশ বসতভিটা ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রায় দুই শতাধিক বসতবাড়ি সাড়ে ছয়শবিঘা ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। মারাত্মক ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে হিদাগাড়ী কমিউনিটি ক্লিনিক, আশ্রয়ণ প্রকল্পের শতাধিক ঘরসহ কবরস্থান পাকা মসজিদ। যা নদী থেকে মাত্র ১০০ গজ দূরে।

যমুনার ভাঙনকবলিত পাকরুল এলাকার বৃদ্ধ সিদ্দিক শেখ বলেন, এক সময় আমাদের আবাদি জমি, বসতভিটা, ফলের বাগান ছোট সাজানো সংসার ছিল। কিন্তু এখন কিছুই নেই। সব কেড়ে নিয়েছে যমুনা নদী। সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে আশ্রয় নিয়েছেন জামাতার বাড়িতে। সেই বাড়িও এখন ভাঙনের মুখে পড়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা নূর মোহাম্মদ বলেন, এক বছরে নদী ভাঙনে প্রায় শতাধিক বসতভিটা ফসলি জমি নদীতে বিলীন হয়েছে। আরও শতাধিক বসতভিটা, কমিউনিটি ক্লিনিক, আশ্রয়ণ প্রকল্পের শতাধিক ঘরসহ কবরস্থান পাকা মসজিদ ভাঙনের মুখে পড়েছে। গত কয়েকদিনে অনেকে বসতভিটা ফসলি জমি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। এছাড়া গত কয়েক বছরে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে প্রাইমারি স্কুল, মাদ্রাসা, মসজিদ, কবরস্থানবৈদ্যুতিক খুঁটিসহ মানুষের বিভিন্ন স্থাপনা।

চরপাকেরদহ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বদরুল আলম সরদার বলেন, বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই পাকরুল এলাকায় ভাঙন চলছে। ইতোমধ্যে দুই শতাধিক বসতবাড়ি কৃষিজমি নদীতে বিলীন হয়েছে। ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে কমিউনিটি ক্লিনিক, পাকা মসজিদ, আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরসহ  দুই শতাধিক বসতবাড়ি।

জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, মাদারগঞ্জের পাকরুল এলাকায় যমুনা নদীর বাম তীরে ভাঙন শুরু হয়েছে। সেখানে জরুরিভিত্তিতে জিওব্যাগ ডাম্পিং করা হচ্ছে। পাশাপাশি সেখানে ১৫শমিটার অংশে নদীর তীর সংরক্ষণের কাজ বাস্তবায়নের জন্য একটি প্রকল্প দাখিল করা হয়েছে, যা পরিকল্পনা কমিশনে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

ইসলামপুর

নিজস্ব সংবাদদাতা ইসলামপুর, জামালপুর থেকে জানান, চলমান ভাঙনে যমুনার চরাঞ্চলে  বেলগাছা ইউনিয়নের সিন্দুরতলী, শিলদহ, পূর্ব মন্নিয়া, চর মন্নিয়া, গ্রামের ছয় শতাধিক সাপধরী ইউনিয়নের যমুনার শাখা নদী চেংগানিয়া, -লপাড়া, কাঁসারিডোবা, আকন্দপাড়া, প্রজাপতি, শিশুয়া, চরশিশুয়া   চেঙ্গানিয়া গ্রামের চার শতাধিক বসতভিটা বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলের শত শত একর ফসলি জমি বিলীন হয়ে কৃষককুল দিশেহারা হয়ে পড়েছে।

সাপধরী ইউনিয়নের যমুনার একটি শাখা নদীর তীব্র ভাঙনের মুখে কাঁসারিডোবা গ্রামের বাসিন্দা সাংবাদিক আজিজুর রহমান  চৌধুরী, বাদশা আলম, লাল মিয়া, কাইজার আলীজোনাব আলী, ডাবু  বেপারি, সাদু  বেপারি, তারাজলমোজাম্মেল, হযরত আলী, আনোয়ার -, নুর মোহাম্মদ, ফইজদ্দীন, নুরল ইসলাম গসাল, শিরিন -   মোজাম্মেল  সেকসহ চার শতাধিক পরিবার বসতভিটা অন্যত্র সরিয়েছেন। চলমান তীব্র ভাঙনে দিশাহারা নদীপাড়ের মানুষ। সাপধরী ইউপি  চেয়ারম্যান শাহ আলম - জানান- ইতোমধ্যে চার শতাধিক বাড়িঘর ফসলি জমি বিলীন হয়েছে। সকলেই মানবেতর জীবনযাপন করছে। বেলগাছা ইউপি  চেয়ারম্যান আব্দুল মালেক জানান, বছর মন্নিয়া, সিন্দুরতলী, শিলদহ গ্রামের ছয় শতাধিক বসতভিটা যমুনায় বিলীনসহ ভাঙন অব্যাহত রয়েছে।

রাজবাড়ীতে পদ্মার ভাঙন

নিজস্ব সংবাদদাতা, রাজবাড়ী থেকে জানান, চোখের পলকে মাঠ ভরা স্বপ্ন পদ্মার গর্ভে। অসহায় মানুষ কান্নাভেজা চোখে শুধু তাকিয়ে দেখছে। অনেকে চোখের পলকও দিতে পারেনি। সব হারিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে নীড়ের খোঁজে দ্বারে দ্বারে ঘুরছে। এমন চিত্র এখন  জেলার গোয়ালন্দ উপজেলার পদ্মা পাড়ের মানুষের।  বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত পদ্মা নদীর ভাঙন এলাকা ঘুরে দেখা জানা যায়, পদ্মা নদীর ভাঙন শুরু হয়েছে ২৮বছর যাবৎ। দীর্ঘ সময়ে একাধিকবার সরকার পরিবর্তন হয়েছে। নদী ভাঙন নিয়ে বিন্দুমাত্র কাজ হয়নি। তবে, আশ্বাসের ফুলঝুড়ি দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।  ২৮ বছরে জেলার গোয়ালন্দ-রাজবাড়ী সদর-কালুখালী পাংশা উপজেলার পদ্মা নদীর ভাঙনে অনেক মৌজা নদীগর্ভে চলে গেছে।  চলে গেছে গ্রামের পর গ্রাম, হাট-বাজার, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান, সরকারি- বেসরকারি অসংখ্য প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে গোয়ালন্দ এবং  সদর উপজেলার বেশি এলাকা নদীগর্ভে চলে যায়। এখন পদ্মা নদী ভাঙছে দৌলতদিয়া দেবগ্রাম এবং সদর উপজেলার কিছু অংশে। গত ১০ দিনের ভাঙনে অর্ধশতাধিক বাড়িভিটা ফসলি জমি চলে যায় নদীতে।

৭৫ বয়সী এক বয়স্ক বৃদ্ধ বলেন, কৃষকের ঘরে জন্মে, কৃষিকাজ করে সংসার চালাতে হয়। কৃষিকাজ করলেও অনেক সুখি ছিলাম। কিন্ত জীবনের শেষ সময়ে এসে নদী ভাঙনের কারণে গৃহহীন হয়ে গেলাম। জানি না এই জীবনে আর নিজের বাড়িতে ঘুমাতে পারব কি না।

 দৌলতদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের  চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান বলেন, দৌলতদিয়া দেবগ্রাম ইউনিয়নে প্রতিবছর নদী ভাঙন দেখা দেয়। তবে আজ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনো উন্নয়নের কাজ করেনি। তবে আশ্বাস দিয়েছে।  দেবগ্রাম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাফিজুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘ ২৮ বছরে নদী ভাঙনের কারণে দেবগ্রাম ইউনিয়নের সিংহভাগ নদীগর্ভে চলে গেছে। এখনো যাচ্ছে। তবে আজ পর্যন্ত নদী ভাঙনরোধ করতে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী অফিসার জ্যোতি বিকাশ চন্দ্র জানান, কয়েক দিন যাবৎ উপজেলার দৌলতদিয়া এবং দেবগ্রাম ইউনিয়নের কিছু অংশ নদী ভাঙনের কবলে পড়েছে। আমরা ভাঙনরোধ করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি।

শিবগঞ্জে ১৩ কিমি এলাকাজুড়ে ভাঙন

নিজস্ব সংবাদদাতা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ  থেকে জানান, শিবগঞ্জে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে নদীভাঙন। ইতোমধ্যে বিলীন হয়েছে রাস্তা-ঘাট, ফসলি জমি আর বসতবাড়ি। ভিটামাটি হারিয়ে দিশাহারা অনেক পরিবার। ভাঙা-গড়ার এমন খেলায় গ্রামীণ অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ভাঙনকবলিত এলাকার মানুষের দাবি- টেকসই বাঁধ নির্মাণ। তবে ভাঙন রোধে নানা পরিকল্পনা কার্যক্রম চলমান রয়েছে, বলছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

জানা গেছে, শিবগঞ্জ উপজেলার পাকা, দুর্লভপুর মনাকষা ইউনিয়নের প্রায় ১৩ কিলোমিটার এলাকায় নদীভাঙন চলছে। এতে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে, দুর্লভপুর ইউনিয়নের রামনাথপুর, মনোহরপুর, -িতপাড়া, আইয়ুব বিশ্বাসের গ্রাম, দোভাগী ঝাইলপাড়া, পাকা ইউনিয়নের চর-কানছিঁড়া জাইঠপাড়া, লক্ষ্মীপুর পাকার ঘাট এবং মনাকষা ইউনিয়নের তারাপুর ঠুঁঠাপাড়ার মতো জনবহুল সব গ্রাম।

দোভাগী ঝালপাড়া গ্রামের মাহবুব আলম বলেন, ২৭ বছর আগে পদ্মা নদীতে  বাড়ি হারিয়ে এই গ্রামে বাড়ি করেছিলাম। এখন এখানে থাকাও সম্ভব হবে না। স্থানীয় ইউপি সদস্য সাইদুর রহমান বলেন, গত দিন থেকে এই এলাকায় ভাঙন শুরু হয়েছে। প্রায় ৩৩০ মিটার জিও ব্যাগ জিওটিউব পানিতে তলিয়ে গেছে। ২০০ মিটার ফসলি জমি নদীতে তলিয়ে গেছে। সরিয়ে নেওয়া হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বসতবাড়ি। ভাঙন আতঙ্কে পদ্মাপাড়ের মানুষ নির্ঘুম রাত পার করছে। মানুষের এই দুর্ভোগ লাঘবে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের দাবি করেন তিনি।  প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানান পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী এসএম আহসান হাবীব। তিনি বলেন, নতুন করে নদীভাঙনের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছি।

 

 

×