ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২০ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

দাদনের ফাঁদে জিম্মি ইটভাঁটি শ্রমিক

প্রকাশিত: ০১:১৩, ৩ মে ২০২৪

দাদনের ফাঁদে জিম্মি ইটভাঁটি শ্রমিক

ইট টানছে এক শ্রমিক

দেশ উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, গ্রামগঞ্জ পরিণত হচ্ছে শহরে, গড়ে উঠছে ছোট-বড় শিল্প কারখানা। যোগাযোগ ব্যবস্থাও হয়েছে আগের চেয়ে অনেক উন্নত, এখন দেশে কাঁচা রাস্তার সংখ্যা দেখা যায় অনেক কম! গ্রামগঞ্জে আগে চোখে পড়ত ছন কিংবা বাঁশের চাটাই সংযুক্ত দোকান ও ঘরবাড়ি। কালের বিবর্তনে এখন নেই বললেই চলে ছন বা বাঁশের চাটাইয়ের ব্যবহার। এই সবই হয়েছে ইট ব্যবহারের ফলে।

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ইটের চাহিদা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইটভাঁটির শ্রমিকরা অনেক পরিশ্রম করে, যেখানে একজন গার্মেন্টস্ শ্রমিকসহ যে কোনো কারখানার ৮ ঘণ্টা কাজ করে সেখানে এক ভাঁটির শ্রমিক প্রায় ১২ ঘণ্টাই কাজ করে। আবার ভাঁটির পোড়াই কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের তো আগুন দেওয়ায় পর থেকে শেষ পর্যন্ত এক টানা কাজ করতে হয়। কারণ ভাঁটির আগুন জ্বালানোর পর থেকে সিজন শেষ না হওয়া পর্যন্ত ভাঁটির আগুন নেভানো হয় না।
ধামরাই উপজেলা, ঢাকা জেলার পাঁচটি উপজেলার মধ্যে একটি। ইটভাঁটি মালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী ১৭৬টির মতো ইটভাঁটি রয়েছে, মোট শ্রমিক সংখ্যা ২৬ থেকে ২৭ হাজার।  সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় শ্রমিকদের কজ। সারা দিনের কর্মব্যস্ত সময়ে কেউ বা ইট তৈরির কাঁচামাল মাটি (ডল) মিক্সিং  মেশিনের কাজ করে, কেউ বা পটে ইট কাটা, ইট শুকানো-চেম্বারে ইট সাজানো, ইট পোড়াসহ নানা কাজে ব্যস্ত সময় পার করছে। গ্রাম থেকে অনেকেই সপরিবারে চলে আসেন ইটভাঁটিতে, কাজ চলে বিরতিহীনভাবে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত।
মিল শ্রমিকদের সর্দাররা কাজের অগ্রিম টাকা (দাদন) দিয়ে থাকেন, যে জন্য ইট ভাঁটির অনেক শ্রমিক মৌসুমের সময় সপরিবারে ভাঁটিতে চলে আসেন। অনেক শ্রমিকের পরিবারের লোকজন ইট ভাঁটিসহ গার্মেন্টসেও কাজ করেন।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, ইট তৈরির প্রধান কাঁচামাল হলো মাটি, যা কৃষি জমি থেকে সংগ্রহ করে থাকেন ভাঁটির মালিকরা। শ্রমিকরা ইট তৈরির জন্য প্রথমে জায়গা পরিষ্কার করে তা সমান করে। পরে ইট তৈরির কাঁচামাল মাটি প্রায় ১২ ঘণ্টা পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখে। পরে সেই ভিজা মাটি ইট  তৈরির উপযুক্ত করতে মেশিন দ্বারা ভাঙানো হয়। পরে শ্রমিকরা ভাঙানো মাটি পটে নিয়ে ইট তৈরি করে। আবার শ্রমিকরা ইট তৈরি করে শুকানোর জন্য সাজিয়ে রাখে।

সেগুলো শুকাতে সময় লাগবে প্রায় ৩ থেকে ৪ দিন। শুকানোর পরে পোড়ানোর জন্য ভাঁটির চেম্বারে ইট সাজানো হয়। কাঁচা ইট পুড়ে পাকা হতে সময় লাগে ১৫-২০ দিন। ইটভাঁটিতে দেখা যায়, তিন ধরনের শ্রমিক, এদের পরিশ্রম ও পারিশ্রমিক বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। যেমন মিল পার্টি, লোড-আনলোড লেভার- মিস্ত্রি, পোড়ানোর জুগাইলা ও মিস্ত্রি।
শ্রমিকদের সারাবছর চলে দাদনের টাকায় সংসার। দাদনের টাকা পরিশোধ করতে অনেকেই স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সারাদিন কাজ করে। সারাদিনে প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার কাঁচা ইট বানিয়ে পায় ১৩ থেকে ১৪শ’ টাকা। আবার মিস্ত্রির সঙ্গে একজন জুগাইলা থাকলে প্রায় ৬ হাজার কাঁচা ইট কাটতে পারে। দাদনের টাকার জন্য ইটভাঁটি ছেড়ে যেতে পারেন না শ্রমিকরা। কারণ বর্ষা মৌসুমে ভাঁটি বন্ধ থাকলেও যে দাদনের টাকায় টিকে ছিল তাদের পরিবার।

লোড-আনলোড লেবারের রয়েছে দৈনিক মজুরি, পোড়াই-কয়লা লেবার ও মিস্ত্রির রয়েছে আলাদা আলাদা মজুরি। পোড়াই কাজের জন্য থাকে ১২-১৪ জন শ্রমিক। এদের মধ্যে রয়েছে ৪ জন পোড়াই মিস্ত্রি। প্রায় প্রতিটা ঘরেই আছে দুই-চারজন শিশুসন্তান। এরা একটু বড় হলেই শুরু করে ইটভাঁটির শ্রমিকের কাজ, আবার কেউ কেউ গ্রামে থেকে পড়াশোনাও করেন। পুরুষ শ্রমিকের পাশাপাশি ভাঁটিতে কাজ করেন নারী শ্রমিকরাও। তারা ভাগাভাগি করে কাজ করে যান দিনের পর দিন।

ধামরাই উপজেলার জয়পুরা এলাকার ইটভাঁটি শ্রমিক সাতক্ষীরা জেলার মো. রিপন হোসেন বলেন, কার্তিক মাস থেকে ৭  বৈশাখ পর্যন্ত ইটভাঁটিতে কাজ থাকে। এর পর গ্রামের বাড়ি গিয়ে আমরা কেউ ভ্যান-রিক্সা চালাই, কেউ কৃষি কাজসহ নানা কাজ করে সংসার চালাতে হয়। আবার কেউ বা মৌসুমে কাজের জন্য সর্দারের কাছ থেকে দাদনের টাকা দিয়ে সংসার চালায়। সে দাদনের টাকা আবার ইটভাঁটিতে এসে কাজ করে শোধ করে দিতে হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ইটভাঁটির মালিক বলেন, কয়লার দাম বাড়তির কারণে ইটের দাম বেড়ে যাচ্ছে। এখন প্রায় প্রতি টন কয়লা ১৮-১৯ হাজার টাকায় কিনতে হয়। ইটভাঁটিতে শ্রমিকদের বেতন-বোনাস-ছুটির বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, প্রতিটা সেকশনেই সর্দার আছে আমরা মিল পার্টি, লোড-আনলোড, পোড়াই মিস্ত্রি এদের সর্দারের সঙ্গে কথা বলি এগুলা তাদের বিষয়।
    মো. সোহেল রানা, ধামরাই, ঢাকা

রশি টেনেই পার করছেন জীবন-সংসার 

দুপুর ১২টা মাথার ওপর সূর্য! উত্তপ্ত রোদের মধ্যে ফেরি থেকে ছুড়ে দেওয়া প্লাস্টিকের মোটা রশি টেনে তা বাঁধা হচ্ছে পন্টুনের মটে। রশি বাঁধা শেষে পন্টুনের গায়ে ধীরে-ধীরে ভিড়ছে শাহ পরান নামক রো-রো ফেরি। পরে পন্টুনের পকেটে ফেরির র‌্যাম নামিয়ে দিতেই লোডকৃত ফেরি থেকে বিভিন্ন যানবাহন সিরিয়াল মোতাবেক নেমে রওয়ানা হচ্ছে নিজ-নিজ গোন্তব্যে। আনলোড শেষে ঘাটে পারের জন্য অপেক্ষমাণ যানবাহনগুলো পুনরায় ফেরিতে লোড হচ্ছে।

ধারণ ক্ষমতানুযায়ী লোডকৃত ফেরিকে পন্টুন ছাড়তে খুলে দেওয়া হচ্ছে মটে বাঁধা মোটা রশি। এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলো করছেন পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ও আরিচা-কাজিরহাট নৌরুটের ফেরি পন্টুনের দায়িত্বে থাকা খালাসিরা। রোদ, ঝড়-বৃষ্টি আর আঁধার রাতে ফেরি-পন্টুনের মোটা রশি বাঁধা ও টেনেই পাড় হচ্ছে এদের জীবন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশের ব্যস্ততম নৌপথ পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ও আরিচা-কাজিরহাট রুটে চলাচলকৃত ফেরির জন্য উভয় ঘাট প্রান্তে রয়েছে বিভিন্ন আকারের ১৬টি পন্টুন। যারমধ্যে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া প্রান্তে ৫টি। রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া প্রান্তে ৭টি, পাবনার কাজিরহাট ও শিবালয়ের আরিচা প্রান্তে রয়েছে আরও দুটি করে পন্টুন। এর মধ্যে পাটুরিয়া ও দৌলতদিয়ায় ছোট-বড় ফেরির জন্য তিন পকেটের তিনটি করে এবং আরিচা-কাজিরহাট রুটে অনুরূপ দুটি করে পন্টুন সচল রয়েছে।

পন্টুনগুলো দেখভালের জন্য একেকটি পন্টুনে রয়েছে রয়েছেন ৫ জন করে স্টাফ। যার মধ্যে একজন সারেং, তিনজন খালাসি (লস্কর) ও এক জন পরিছন্ন কর্মী। এদের মধ্যে মূলত খালাসিরই সব চাইতে বেশি স্পর্শকাতর ও ব্যস্ত সময় পার করেন। জনকণ্ঠের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় পাটুরিয়ার ব্যস্ততম ৩নং ফেরি ঘাট পন্টুনের খালাসি (লস্কর) রিপন হোসেনের। তিনি এ পন্টুনে অস্থায়ী হিসেবে কাজ করছেন। স্থায়ীভাবে নিয়োগকৃত তিন জনের একজন রয়েছেন ঈদের ছুটিতে। আর বাকি দুজনই পন্টুন ছাড়া। এদের অবর্তমানে কাজ সারছেন রিপন হোসেন।

তিনি বলেন, প্রত্যহ ৮ ঘণ্টা পর-পর আমাদের একেক জনের ডিউটি। এ সময়ে এ রুটের একেকটি পন্টুনে ২০ থেকে ২৫টি ফেরি স্বাভাবিক লোড-আনলোড হয়। ফেরিগুলো পন্টুনে ভিড়ার আগে ফেরি থেকে ছুড়ে দেওয়া হয় প্লাস্টিকের মোটা রশি। যা পন্টুনের গায়ে বিশেষভাবে তৈরি মটের সঙ্গে বাঁধার পর ফেরি নিরাপদে ঘাটে ভিড়ে। আবার ফেরি ছাড়ার সময় তা খুলে দিতে হয়। পন্টুনে ভিড়া ফেরিতে যানবাহন লোড-আনলোডকালীন চালকরা আমাদের বকশিশ হিসেবে যে অর্থ দেওয়া তা দিয়েই চলে আমাদের সংসার। নিয়োগকৃতরা নানাভাবে সরকারি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করলেও আমরা এ থেকে বঞ্চিত। 
পাটুরিয়া ৪নং ঘাটের পন্টুনে নিয়োগকৃত খালাসি মেহেদী জানান, রোদ, বৃষ্টি-ঝড় ও আঁধার রাতে আমাদের নিয়মিত পন্টুনে থাকতে হয়। কখন কোন ঘাটে কোন ফেরি ভিড়ে সেদিকে বিশেষ সতর্ক দৃষ্টিসহ নিজ-নিজ দায়িত্ব পালন করতে হয়। কোনোভাবেই পন্টুন ছেড়ে বাইরে থাকার সুযোগ নেই।
বিআইডব্লিউটিসি’র পাটুরিয়া ফেরি সেক্টর মেরিন বিভাগের এজিএম আহম্মদ আলী জনকণ্ঠকে জানান, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া বহরের ফেরিতে যানবাহন লোড-আনলোডের জন্য সংস্থার নিজস্ব তিন পকেটযুক্ত মোট ৭টি পন্টুন সচল রয়েছে।

এতে একাধারে তিনটি করে ফেরি লোড-আনলোড করতে পারে। উভয় ঘাটের বাকি পন্টুনগুলো অপর সংস্থা বিআইডব্লিউটিএ’র। আমাদের সংস্থার প্রত্যেকটি পন্টুনে স্থায়ীভাবে নিয়োগকৃত একজন সারেং, তিন জন খালাসি (লস্কর) ও একজন করে পরিচ্ছন্ন কর্মী নিজ-নিজ দায়িত্ব পালন করছেন। তবে, এ সকল কাজে অংশ নেওয়া অস্থায়ীদের বিষয়ে তিনি তেমন কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। 
    শহিদুল ইসলাম, শিবালয় মানিকগঞ্জ।

×