ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২০ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

হিটস্ট্রোকে ৪ মৃত্যু

জনকণ্ঠ রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০০:১৮, ২১ এপ্রিল ২০২৪

হিটস্ট্রোকে ৪ মৃত্যু

তীব্র গরমে রাজধানীর সড়কগুলো ছিল অনেকটাই ফাঁকা

চলছে হিট অ্যালার্ট। তীব্র দাবদাহে পুড়ছে সারাদেশ। এল নিনো সক্রিয় থাকায় ও লু হাওয়ার প্রভাবে তাপমাত্রার পারদ ঊর্ধ্বমুখী। দেশের মধ্য ও পশ্চিমাঞ্চলে যেন আগুনের হল্কা বইছে। প্রতিদিনই ভাঙছে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড। দুর্বিষহ গরমে অসুস্থ হয়ে শনিবার চারজনের মৃত্যু হয়েছে। বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এমন পরিস্থিতিতে দুঃসংবাদ দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

বৃষ্টির সম্ভাবনা না থাকায় এপ্রিলে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠতে পারে ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। শনিবার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে যশোরে ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি। যা এ বছরের সর্বোচ্চ। চুয়াডাঙ্গার ঠাকুরপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কর্মচারী জাকির হোসেন (৩৫), পাবনায় সুকুমার দাস (৬০), গাজীপুরে মানসিক ভারসাম্যহীন সোহেল রানা (৩৬) এবং রাজধানীর ফকিরাপুলেও এক ভিক্ষুক হিটস্ট্রোকে মারা গেছেন।

গাজীপুর স্টাফ রিপোর্টার জানান, গাজীপুর মহানগরীর কোনাবাড়িতে হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মানসিক ভারসাম্যহীন এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। তিনি গাজীপুর সিটি করপোরেশনের এনায়েতপুর এলাকার আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে সোহেল রানা। পাবনার নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, শনিবার দুপুরে পাবনা শহরের রূপকথা রোডে একটি চায়ের দোকানে হিটস্ট্রোকে সুকুমার দাস নামে এক বৃদ্ধ মারা গেছেন। তিনি শহরের শালগাড়িয়া এলাকার জাকিরের মোড়ের বাসিন্দা ছিলেন।

চুয়াডাঙ্গার নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, একই উপজেলার ভারত সীমান্তবর্তী ঠাকুরপুর গ্রামের আমির হোসেনের ছেলে ও ঠাকুরপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দপ্তরি জাকির হোসেন শনিবার সকালে নিজের জমিতে কাজ করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ সময় তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়ার পথে তিনি মারা যান। 

আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক জনকণ্ঠকে বলেন, লু হাওয়া, এল নিনো ও অভ্যন্তরীণ তিন কারণে তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে। এর মধ্যে অন্যতম মেঘমালা সৃষ্টি না হওয়া, বাতাসের গতিবেগ কম ও উচ্চচাপ বলয়। আগামী কয়েকদিনে তাপমাত্রা ৪৩-৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠতে পারে বলে সতর্ক করেন তিনি।
অন্যদিকে চুয়াডাঙ্গায় ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রি, মোংলায় ৪১ দশমিক ৭, ঈশ্বরদীতে ৪১ দশমিক ৬ ও খুলনায় ৪১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। এ ছাড়া দেশের অন্যান্য স্থানেও মৃদু থেকে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। ঢাকায় ১৯৬৫ সালে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। এর আগে ১৯৬০ সালে ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ১৯৭৫ সালের ১৮ মে রাজশাহীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৪৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, এই রেকর্ড এখনো ভাঙেনি। তবে অনেকেই এবার সব রেকর্ড ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।
সহকারী আবহাওয়াবিদ কাজী জেবুন্নেছা জানান, দেশজুড়ে বয়ে  চলা তাপপ্রবাহ অব্যাহত রয়েছে। যা আরও বাড়তে পারে। চলতি মৌসুমে শনিবার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে।
দেশে তাপপ্রবাহ মে এবং জুন মাসে বাড়ে। কিন্তু এ বছর এপ্রিলের শুরু থেকেই তাপ বৃদ্ধির পারদ ঊর্ধ্বমুখী হয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় উচ্চ তাপমাত্রা অনুভূত হচ্ছে। ফলে একপ্রকার বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা। ঢাকাসহ সারাদেশে বয়ে যাচ্ছে তীব্র তাপপ্রবাহ। এমন আবহাওয়ায় শরীরের ত্বক পুড়ে যাওয়ার উপক্রম। শুকিয়ে যাচ্ছে ঠোঁট। রাজধানীতে সকাল থেকেই বাড়ছে রোদের তেজ।

দুপুর ১২টার দিক থেকে মাথার ওপর খাড়াখাড়ি যে তাপ দিচ্ছে সূর্য তাতে পথঘাট সব আগুনের মতো গরম হয়ে উঠছে। সন্ধ্যার পরও থাকছে এই প্রভাব। রিক্সা-মোটারসাইকেল আরোহীদের সে তাপ সরাসরি মুখে এসে লাগছে। অসহনীয় এ গরমের সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে খেটে খাওয়া মানুষের জীবনে। যাত্রী নিয়ে মগবাজার থেকে মালিবাগ রেলগেট হয়ে রামপুরা পর্যন্ত এসেছেন রিক্সাচালক আহমেদ মিয়া। সারা শরীর ভিজে গেছে। নিজের শরীর বয়ে নেওয়াই যেন কষ্টকর হয়ে পড়েছে। তিনি জানান, রোদে পুড়েও যাত্রী টানতে হচ্ছে। 
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের দারুস সালাম থানার টোলারবাগে বর্জ্য অপসরণকর্মীদেরও নাজুক অবস্থা দেখা গেছে। পিঠে রশি টেনে নিয়মিত বর্জ্যবোঝাই ভ্যান ঠেলে নেওয়া তার কাজ। তবে এই গরমে তার এই কাজে কষ্ট কয়েকগুণ বেড়েছে। তিনি জানান, বর্জ্য টেনে আনার সময় শরীরে আর কিছু থাকে না, ক্লান্ত হয়ে পথের পাশে বসে পড়তে হয়। 
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, অন্তত টানা ৫ দিন কোনো এলাকায় গড় তাপমাত্রার চেয়ে তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি অব্যাহত থাকলে ঐ ঘটনাকে দাবদাহ বলা হয়। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর ৩৬-৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে মৃদু দাবদাহ ৩৮-৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে মাঝারি দাবদাহ এবং ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রাকে তীব্র দাবদাহ হিসেবে বিবেচনা করে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, এল নিনোর কারণে মানবসৃষ্ট বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে পৃথিবীর নানা প্রান্তে তৈরি হতে পারে খাদ্য, পানি ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার ঝুঁকি। মূলত এটি হচ্ছে, প্রশান্ত মহাসাগরের নিরক্ষরেখার দক্ষিণের আবহাওয়ার এলোমেলো আচরণ। প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্য ও পূর্ব অংশে সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা যখন স্বাভাবিকের চেয়ে ছাড়িয়ে যায় তখন তাকে এল নিনো বলা হয়। এর ফলে উপকূলীয় এলাকায় স্বাভাবিক বায়ুপ্রবাহ হারিয়ে যায়। সাধারণত বাংলাদেশে লা নিনার প্রভাব থাকে।

যেটি এল নিনোর বিপরীত চিত্র। অর্থাৎ পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলীয় প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা যখন স্বাভাবিকের চেয়ে কম থাকে, তখন তাকে লা নিনা বলা হয়। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে কয়েকটি এল নিনোর আবির্ভাব ঘটেছে বিশ্বে। এর মধ্যে ২০১৬ সালে এল নিনো সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছিল। ওই বছর তাপমাত্রা বৃদ্ধির রেকর্ড অতিক্রম করে।
তাপমাত্রা এমন অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা জানান, বায়ুম-লে গ্রিনহাউস গ্যাসের স্তর ঘন হচ্ছে এবং স্থল ও সমুদ্র উভয় ক্ষেত্রেই তাপমাত্রা বাড়ছে। যেহেতু আমরা এল নিনো পর্যায়ে প্রবেশ করছি, শুষ্ক আবহাওয়া আরও কয়েক বছর অব্যাহত থাকবে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরে সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে, রংপুর, রাজশাহী, ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। দেশের ওপর দিয়ে চলমান তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে এবং তাপমাত্রা আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। এ ছাড়া জলীয়বাষ্পের আধিক্যের কারণে বৃদ্ধি পেতে পারে অস্বস্তি। এই তাপপ্রবাহ সহসাই কমছে না। আরও কয়েকদিন তাপমাত্রা এমন উষ্ণ থাকবে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

দুই সপ্তাহ ধরে চলা এই তাপপ্রবাহ শীঘ্রই কমছে না। আরও কয়েকদিন এমন উষ্ণ থাকবে। এদিকে চলমান তাপপ্রবাহের মধ্যে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা বিবেচনায় সব স্কুল-কলেজ ৭ দিনের ছুটি ঘোষণা দিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর। আগামী ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়েছে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা যা বলছেন ॥ এমন তীব্র গরমে অসুস্থ হওয়া স্বাভাবিক, তবে কিছু নিয়ম মেনে চললে এ গরমেও নিরাপদ থাকা যায়, ভালো থাকা যায়। বাইরে বের হলে বা রোদে গেলে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। প্রচুর পানি, লেবুর শরবত, স্যালাইন ও তরল খাবার খেতে হবে। তেল-মসলাজাতীয় খাবার এড়িয়ে চলতে হবে।
ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ জনকণ্ঠকে বলেন, যারা দীর্ঘক্ষণ বাইরে কাজ করে তাদের হিটস্ট্রোকের আশঙ্কা থাকে।

তাই রোদে কাজ থাকলে প্রতি দুই ঘণ্টা পর পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবে। কৃষক ও রিক্সাচালকদের মতো যারা রোদে পুড়ে ঘাম ঝরানো পরিশ্রম করেন তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। পাশাপাশি ডায়াবেটিস ও কিডনি বিকলসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত, বয়স্ক ও শিশুরাও ঝুঁকিতে রয়েছে। এই গরমে ডিহাইড্রেশন অর্থাৎ শরীরে পানিশূন্যতা বা স্বল্পতা দেখা দিতে পারে। অনেকের রক্তচাপ ও প্র¯্রাব কমে যেতে পারে।

গরমে শরীরের তাপমাত্রা ১০৫ ডিগ্রির উপরে উঠলে হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়া ও পালস (নাড়ির স্পন্দন) কমে যেতে পারে। এ সময় ঘরের বাইরে যতটা কম যাওয়া যায়, ততই ভালো। যারা প্রয়োজনে বাইরে যাচ্ছেন তারা পানির সঙ্গে একটু লবণ মিশিয়ে স্যালাইনের মতো করে খেতে পারেন। এতে ঘামের সঙ্গে শরীর থেকে বের হওয়া লবণের ঘাটতি পূরণ হবে। এ ছাড়া ঢিলেঢালা সুতি কাপড় পরতে হবে।

বিশিষ্ট চিকিৎসাবিজ্ঞানী, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব হেলথ সায়েন্সেসের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী বলেন, ঝড়, বন্যার মতো হিট অ্যালার্টকে আমরা এখনো তেমনভাবে দুর্যোগ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারিনি। হিট অ্যালার্ট যে স্বাস্থ্যের জন্য বড় দুর্যোগ, তা আমাদের উপলব্ধি করার সময় এসেছে। শুধু হিট অ্যালার্ট ঘোষণা করেই দায়িত্ব শেষ করলে হবে না, তীব্র গরমকে দুর্যোগ হিসেবে চিহ্নিত করে শ্রমজীবী মানুষের পাশে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় কার্যকর স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশল অবলম্বনের আহ্বানও জানান এ চিকিৎসাবিজ্ঞানী।

×