ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৫ মে ২০২৪, ১০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

মাগুরা-১

চায়ের দোকান থেকে গণপরিবহন সর্বত্র সাকিব

আসিফ হাসান কাজল, মাগুরা থেকে ফিরে

প্রকাশিত: ২৩:৪৪, ২১ ডিসেম্বর ২০২৩

চায়ের দোকান থেকে গণপরিবহন সর্বত্র সাকিব

সাকিব আল হাসান

নৌকার মনোনয়ন ও ক্রিকেটে জনপ্রিয়তা দুই মিলিয়ে ক্রিকেট অলরাউন্ডারের মাগুরায় আবির্ভাব অন্য রকম বার্তা দিচ্ছে। ক্রিকেট জনপ্রিয়তার সঙ্গে রাজনৈতিক সংশ্লেষ আলোড়ন তুলেছে  মাগুরার মানুষের মধ্যে। চায়ের দোকান থেকে গণপরিবহন সব জায়গায় আলোচনায় কেন্দ্রে সাকিব। এতে স্থানীয় রাজনীতিতে নতুন এক মেরুকরণ হতে চলেছে বলে ধারণা করছেন মাগুরা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। দলীয় নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের সমর্থন এবং জোড়ালো প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় মাগুরা-১ আসনে সাকিব আল হাসানের জয় প্রায় সুনিশ্চিত। 
প্রধানমন্ত্রীর সাবেক বিশেষ সহকারী ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে সংসদ সদস্য হওয়ায় মাগুরার স্থানীয় রাজনীতিতে সাইফুজ্জামান শিখরের একচ্ছত্র প্রভাব রয়েছে। কিন্তু এই আসনে নৌকার প্রার্থীর পরিবর্তন  সেই প্রেক্ষাপট বদলে দিয়েছে। 
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পংকজ কু-ু মনে করেন, রাজনৈতিক মেরুকরণ বদলে গেছে, তা এখনই বলা যাবে না। এটা ভবিষ্যৎ ও সময় নির্ধারণ করবে। তিনি বলেন, দলের নেতা-কর্মীরা সব সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুগত। তার প্রমাণ কিন্তু দেখা গেছে, এই আসনে একজনও আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র-বিদ্রোহী প্রার্থী  নেই। সাইফুজ্জামান শিখর যে দলকে সুসংগঠিত করেছেন এটিও তার বড় উদাহরণ।
ক্রিকেট বিশ্বে সাকিব আল হাসান এক নম্বর অলরাউন্ডার হলেও রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা তার শূন্য। যা সাকিবও স্বীকার করেন বলে জানিয়েছেন এই সাধারণ সম্পাদক। তিনি বলেন, এই বিষয়ে সাকিব আমাদের কাছে সহযোগিতা চেয়েছেন এবং জেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তা অব্যাহত রয়েছে। 
মাগুরা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, আদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগ। এখানে ব্যক্তির মূল্যায়ন মুখ্য নয়। সাকিবের রাজনৈতিক আবির্ভাব কিভাবে দেখছেন নেতাকর্মীরা এ প্রশ্নে তিনি বলেন, অনেক দেশেই সেলিব্রিটি নির্বাচনে অংশ নেয়। দলীয়ভাবে তাদের মূল্যায়ন করার উদাহরণ রয়েছে। দলের সভাপতি শেখ হাসিনা সেভাবেই মূল্যায়ন করেছেন। আওয়ামী লীগ গণভিত্তিক রাজনৈতিক দল। দলের সিদ্ধান্তকে তাই সবাই সাধুবাদ জানিয়েছেন।
জেলার রাজনীতিতে অনেক ব্যক্তি দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থেকেছেন। একটা সময় সাইফুজ্জামান শিখরের পিতা আছাদুজ্জামান ৪ বার সংসদ সদস্য ছিলেন। সংসদ সদস্য হিসেবে সোহরাব হোসেন, আতর আলী ও ডা. এম এস আকবর এই আসনে জনপ্রতিনিধিত্ব করেছেন। স্থানীয় বড় অংশের ধারণা, সাকিব এখন জেলা আওয়ামী লীগ পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন।
এদিকে সাকিবের নৌকার মনোনয়ন নিশ্চিত হওয়ার পর তার বাড়িতে দলের অঙ্গসংগঠনের নেতা, কর্মীদের আনাগোনা বেড়েছে। জেলার সাহাপাড়ায় তার বাড়ির  ভেতর টাঙানো হয়েছে শামিয়ানা। বাইরে রঙিন ব্যানার ও সাদাকালো পোস্টার। সাকিবকে ঘিরে উৎসুক তৎপরতা থামছেই না। সব সময় যেন মানব বলয়ের মধ্যে রয়েছেন তিনি। সাকিবকে এক ঝলক দেখতে দূর-দুরান্ত থেকে ছুটে আসছেন সাধারণ মানুষ। অনেকে সেলফির আবদার তুলছেন। সাকিব তাদের আবদারও মেটাচ্ছেন। 
জনকণ্ঠের সঙ্গে কথা হয় ইছাখাদা এলাকার বাসিন্দা আফসার আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, রাজনীতির সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। সাকিবকে শুধু টিভিতেই দেখে এসেছি। এ কারণে তার বাসায় ছুটে এসেছি। 
অন্যদিকে নির্বাচনী আসন ঘিরে সাকিবের ছুটে চলাও অব্যাহত। নির্বাচনী প্রচারের প্রথম দিনেই নিজের স্কুল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে ছুটে গেছেন। ওই দিন নতুন কারিকুলামের প্রশিক্ষণ চলায় সব শিক্ষকের কাছেও ভোট চেয়েছেন। এ সময় শিক্ষরাও তাকে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ^াস দেন। সন্ধ্যার পর মাগুরা শহরের ছোট-বড় সব ধরনের মার্কেটে সাকিবকে জনসংযোগ করতে দেখা গেছে। তাকে দেখে অনেক ক্রেতা-বিক্রেতা ছবি তোলার সুযোগ হাতছাড়া করেননি।
তবে, মাগুরা শহরের স্থানীয়দের একাংশের অভিযোগ, ক্রিকেটবিশ্বের বড় তারকা হবার পরও মাগুরা ও মাগুরার মানুষের প্রতি সাকিবের দৃশ্যমান কোনো বড় অবদান নেই। আগামীর সংসদ সদস্য হিসেবে সেখানে তিনি কি ভূমিকা রাখবেন, তা নিয়ে নানা জল্পনা রয়েছে। এর সঙ্গে তার পরিবারের প্রবাস জীবন ও আন্তর্জাতিক তারকা হওয়ায় গণমানুষের অভিযোগ-অনুযোগ শুনতে পারবেন বা সময় হবে কি না, তা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন।
যদিও সাকিব জানিয়েছেন, মাগুরা থেকে আমি এত কিছু পেয়েছি আর তো পাওয়ার কিছু নেই। এখন মাগুরার মানুষকে যদি আমি কিছু দিতে পারি, সেটাই আমার বেশি ভালো লাগবে। নৌকা প্রতীকে ভোট দিয়ে আমাকে নির্বাচিত করে সবাই যদি সুযোগ করে দেন, তাহলে আমি মাগুরার উন্নয়নের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। 
মাগুরা পৌরসভা, সদর উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন ও শ্রীপুর উপজেলা নিয়ে জাতীয় সংসদের মাগুরা-১ আসন। ১৯৯৬ সালের পর থেকে বিগত সব নির্বাচনে এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে আসছেন।  
জেলার অন্তত ৫০ ভোটারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, টিভিতে দেখা সাকিব আর বাস্তবের সাকিবের মধ্যে বেশ পার্থক্য খুঁজে পাচ্ছেন তারা। চোখের সামনে আসতেই সাকিবের প্রতি মায়া বেড়ে যাচ্ছে। নির্বাচনী মাঠে নতুন হলেও হাট-বাজারে, চায়ের দোকানে ভোটারদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু এখন শুধুই সাকিব আল হাসান।
ভোটাররা জানান, সাকিব মাগুরার রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ায় নতুন করে এক ধরনের উন্মাদনা  তৈরি হয়েছে। নির্বাচনে যে ভোটার উপস্থিতি অনেক বেশি হবে তা নিয়ে আর কোনো সংশয় নেই। গ্রামে-গঞ্জে সব জায়গায় টক অব দ্য টাউন সাকিব। ভোট জয়ের পর সাকিবের কার্যক্রম কেমন হবে সেটিই দেখার অপেক্ষা। তবে জেলায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সাকিবের পদার্পণ কেমন হবে, তা নিয়েও আগ্রহের কমতি নেই  ভোটার থেকে স্থানীয় নেতাকর্মীদের।
মাগুরা জেলায় মোট আসন রয়েছে দুইটি। এর মধ্যে সদর উপজেলা ও শ্রীপুর নিয়ে মাগুরা-১ এবং মহম্মদপুর ও শালিখা নিয়ে মাগুরা-২ আসন। মাগুরা-১ আসনে সাকিব আল হাসান নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন। এর বাইরে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মো. সিরাজুস সায়েফিন পেয়েছেন লাঙ্গল প্রতীক, বাংলাদেশ কংগ্রেসের কাজী রেজাউল  হোসেন ডাব প্রতীক, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্টের (বিএনএফ) কে এম মোতাসিম বিল্লা পেয়েছেন টেলিভিশন প্রতীক ও তৃণমূল বিএনপির সনজয় কুমার রায় (রনি) পেয়েছেন সোনালী আঁশ প্রতীক। প্রসঙ্গত, মাগুরা-১ আসনে মোট ভোটার ৪ লাখ ৪৮৫ জন। এর মধ্যে পুরুষ ২ লাখ ৮৬২ জন ও নারী ভোটার ১ লাখ ৯৯ হাজার ৬২১ জন এবং তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার ২ জন।
ভোট উৎসবের শহর মাগুরা ॥ আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভোট উৎসবের শহরে পরিণত হয়েছে মাগুরা। শহরের মোড়ে  মোড়ে টানানো হয়েছে পোস্টার। চলছে মাইকিংয়ে প্রচার কাজ। দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে জনসংযোগে ব্যস্ত রয়েছেন সাকিব আল হাসান। মঙ্গলবার দুপুরে মাগুরা জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত মহান বিজয় দিবসের বিজয় শোভাযাত্রায় অংশ নেন তিনি। তার সঙ্গে যুক্ত হয় এই আসনের আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মী ও সমর্থক।
স্থানীয় নোমানী ময়দানে অনুষ্ঠিত সভায় মাগুরাবাসীকে মহান বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়ে সাকিব বলেন, আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আপনারা সকলে যার যার এলাকার কেন্দ্রে গিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দেবেন। নৌকা প্রতীককে বিজয়ী করে আনবেন। আমরা সবাই এক সঙ্গে কাজ করে মাগুরার দুই আসনই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উপহার দেব।

×