ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৭ জুন ২০২৪, ৪ আষাঢ় ১৪৩১

তেওতা জমিদারবাড়ি

প্রমীলার জন্মভিটা আজ মুখর হবে কবিপ্রেমী মানুষের পদচারণায়

শহিদুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২৩:৫৯, ২৪ মে ২০২৪

প্রমীলার জন্মভিটা আজ  মুখর হবে কবিপ্রেমী  মানুষের পদচারণায়

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতি বিজড়িত তেওতা জমিদারবাড়ি

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম পত্নী প্রমীলার জন্মভিটা মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয়ের তেওতা। নজরুলপ্রেমী স্থানীয় একাধিক সংগঠনের দাবির মুখে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় আজ মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসন দিনব্যাপী নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। এতে মানিকগঞ্জ- আসনের সংসদ সদস্য সালাউদ্দিন মাহমুদ জাহিদ জেলা প্রশাসক রেহেনা আক্তার পৃথক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। কবির জন্মবার্ষিকী পালনে জমিদারবাড়ির আঙিনা মুখরিত হয়ে উঠবে কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী কবিপ্রেমীদের পদচারণায় এমনটাই জানিয়েছেন স্থানীয়রা। 

জানা যায়, তেওতা জমিদারবাড়ির পাশেই জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের পত্নী প্রমীলার জন্মভিটা। তেওতার জমিদার কিরণ শংকর রায় চৌধুরীর আমন্ত্রণে দুবার অন্য কারণে কবি নজরুল একাধিকবার বেড়াতে এসেছেন এই তেওতায়। বিপ্লবী চেতনার অধিকারী কিরণ শংকর রায় চৌধুরী রাজনৈতিক কারণে বলিষ্ঠ লেখনীর দ্বারা পরিচিত হয়ে ওঠা কবি নজরুলকে খুব স্নে ভালোবাসতেন। কবিপত্নী প্রমীলার পিতা বসন্ত কুমার সেনগুপ্ত ত্রিপুরা রাজ্যের জমিদারের অধীনে চাকরি করতেন। পিতার অকাল মৃত্যুতে মাতা বিধবা গিরিবালাকে সঙ্গে নিয়ে কুমিল্লার কান্দিরপাড় বড় কাকা জগৎ কুমার সেনগুপ্তর বাড়িতে আশ্রয় নেন প্রমীলা। তাঁর কনিষ্ঠ কাকা  ঈন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত কুমিল্লা কোর্ট ইনস্পেক্টর পদে চাকরি করতেন। ঈন্দ্র কুমারের পুত্র বিরেন্দ্র কুমার সেনগুপ্তের সঙ্গে কবি নজরুলের ঘনিষ্ঠতা বন্ধুত্ব ছিল। সে সূত্রে নজরুলের সঙ্গে প্রমীলার পরিচয়।

শিবালয়ের তেওতা এলাকায় বেড়াতে এসে কবি গান, কবিতা, ছড়াসহ বহু সাহিত্য রচনা করেন। নজরুলের লেখাছোট হিটলারকবিতায় পুত্র সব্যসাচি (ডাকনাম সানি) পুত্র অনিরুদ্ধের (নিনি) জবানিতে তেওতায়ওদের মামার বাড়িএমনটাই উল্লেখ করেছেন। ছাড়া তিনি অনেক কালজয়ী কবিতা, জনপ্রিয় গান, ছড়া, হামদ-নাত সাহিত্য রচনা করেছেন তেওতায় বসে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তেওতা জমিদার পরিবারের সূচনা ছিল খুবই নাটকীয়। জমিদার রায়েরা জাতিতে জয়দাশ বংশীয় বৈদ্য। তাদের আগের পদবি ছিল দাশগুপ্ত। দাশগুপ্ত পরিবারের এক ছেলে পঞ্চানন। তাঁর বাবার নাম আনন্দীরাম দাশগুপ্ত। খুব কম বয়সেই পঞ্চানন পিতৃহীন হন। অল্প বয়সেই পঞ্চানন দিনাজপুরে এক তামাক ব্যবসায়ীর আড়তে কাজ নেন। বয়স কম হলেও পঞ্চানন ছিলেন অত্যন্ত বিষয়বুদ্ধি সম্পন্ন সৎ কর্মঠ। একবার বাজারে তামাকের দাম পড়ে যায়। পঞ্চানন নিজের আংটি বন্ধক রেখে বেশ কিছু তামাক ক্রয় করেন। কিছুদিন পর তামাকের দাম আবার বেড়ে যায়। চরা দামে বেচে বেশ লাভ হয় পঞ্চাননের। লাভের টাকা আড়তের মালিকের হাতে তুলে দেন পঞ্চানন। মালিক তাকে প্রশ্ন করলে তিনি নিজের আংটি বন্ধক রেখে তামাক ক্রয় করেছিলেন বলে জানান। পঞ্চাননের সততায় খুশি হয়ে মালিক লাভের পুরো অর্থ পঞ্চাননের কাছেই গচ্ছিত রাখেন। সে থেকেই পঞ্চাননের উত্থান শুরু। পঞ্চানন ধীরে-ধীরে নিজের অধ্যাবসায় বুদ্ধি বলে প্রচুর ধন-সম্পদ অর্জন দিনাজপুরেই ৮টি জমিদারি মহল ক্রয় করেন। এরপর থেকে তাকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। প্রচুর অর্থ-সম্পদের মালিক হয়ে ১৮৯৮ সালে নিজ গ্রাম তেওতায় ফিরেন পঞ্চানন। গায়ে ফিরে এখানেও জমিদারি ক্রয় করেন তিনি। একে একে অন্যান্য স্থানেও জমিদারি ক্রয় করতে থাকেন। পঞ্চাননের জন্মসাল নিয়ে বিভ্রান্ত থাকলেও ১৮৪০ থেকে ৪৩ সালের মধ্যে তার জন্ম বলে বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশ পেয়েছে। তিনি প্রায় ৯০ বছর বয়সে গত হওয়ার আগে ১৯৩০ সালে মুর্শিদাবাদের নায়েব তাঁকেচৌধুরীখেতাবে ভূষিত করেন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের আগেই তেওতা জমিদার বাড়ির উল্লেখযোগ্য সদস্যরা ভারতের কলকাতায় পাড়ি জমান। বর্তমানে বাড়িটি শুধুই স্মৃতি।

২০০৮ সালে নজরুল-প্রমীলার স্মৃতি বিজড়িত তেওতা জমিদার বাড়ি ঘিরে স্থানীয় নজরুল ভক্তরা সাংগঠনিক তৎপরতা শুরু করে।নজরুল-প্রমীলা ইনস্টিটিউটনামে প্রথম সংগঠনের জন্ম হয়। ছাড়া তেওতা নজরুল-প্রমীলা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, শিবালয় নজরুল-প্রমীলা সাহিত্য পরিষদ, তেওতা জমিদার বাড়ি কেন্দ্রীয় পাঠাগার, নজরুল পরিষদ কেন্দ্রীয় নামে বিভিন্ন সংগঠন তেওতায় নানা কর্মসূচি পালন করে আসছে। এরমধ্যে কবি পরিবারের সদস্য, নাতি-নাতনি, পুত্রবধূসহ ভারতের বিভিন্ন কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীরা তেওতায় আসেন। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নজরুল ইনস্টিটিউট তেওতা রাজবাড়ী প্রাঙ্গণে জাতীয় নজরুল সম্মেলনের আয়োজন করে। এতে সংস্কৃতিমন্ত্রী, সচিব, নজরুল ইনস্টিটিউট মহাপরিচালক, নজরুল গবেষক, শিল্পি-সাহিত্যিকসহ হাজারো দর্শক-শ্রোতা উপস্থিত হন। সম্মেলন ঘিরে গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ তেওতা জমিদার বাড়ির প্রায় ১০ একর জায়গায় নজরুল চর্চা কেন্দ্র, স্মৃতি জাদুঘর, রেস্ট হাউস নির্মাণের প্রয়োজনীতা অনুভব প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করায় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর জমিদার বাড়ির দখল বুঝে নিয়ে সংস্কার কাজ শুরু করলেও কিছুদিন পর তা থমকে যায়। বর্তমানে জমিদারবাড়িটি তাঁর নিজস্ব শ্রী হারাতে বসেছে। স্থানীয় একাধিক নজরুল সংগঠক ভক্তরা নজরুলের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি রক্ষণা-বেক্ষণের জন্য সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন।

×