ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১২ মে ২০২৫, ২৮ বৈশাখ ১৪৩২

ঢাকা-ভাঙ্গা রুটে চলল পরীক্ষামূলক

স্বপ্নের পদ্মা সেতু পার হলো ট্রেন

ইবরাহীম মাহমুদ আকাশ

প্রকাশিত: ২৩:২৬, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩

স্বপ্নের পদ্মা সেতু পার হলো ট্রেন

পদ্মা সেতু দিয়ে ঢাকা-ভাঙ্গা রুটে পরীক্ষামূলক ট্রেন চলেছে বৃহস্পতিবার

স্বপ্নের পদ্মা সেতু দিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো চলল ট্রেন। মাত্র আট মিনিটে সেতু পার হলো ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা বিশেষ ট্রেনটি। ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা রুটে পরীক্ষামূলক ট্রেন চালানোর জন্য বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা ৮ মিনিটে রাজধানীর কমলাপুর স্টেশন থেকে ছেড়ে যায় ট্রেনটি। প্রায় দুই ঘণ্টা পরে ট্রেনটি ফরিদপুরের ভাঙ্গা জংশনে পৌঁছায়। ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত পরীক্ষামূলক এই ট্রেনে সরকারের মন্ত্রী পরিষদের সদস্য, স্থানীয় সংসদ সদস্য,  বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার কর্মকর্তা এবং আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দসহ পাঁচ শতাধিক মানুষ ভ্রমণ করেন। 
এই ভ্রমণের নেতৃত্ব দেন রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন। অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম, আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য শাজাহান খান, জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী, সাবেক রেলমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য মুজিবুল হক, রেল মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ফজলে করিম চৌধুরী, সংসদ সদস্য সাগুফতা ইয়াছমীন এমিলি, সাইফুজ্জামান শেখর, শফিকুল ইসলাম শিমুল, রেলওয়ে সচিব ড. হুমায়ুন কবির ও রেওয়ের মহাপরিচালক কামরুল আহসান ও পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের পরিচালক মো. আফজাল হোসনেসহ রেলওয়ে ও বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাগণ। ট্রেনযাত্রা শুরুর আগে কমলাপুর স্টেশনে রেলমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘পরীক্ষামূলকভাবে এই ট্রেন চলাচলের মধ্য দিয়ে দক্ষিণবঙ্গের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের সূচনা হবে।’ 
ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু দিয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ৮২ কিলোমিটার রেলপথ অতিক্রম করে ট্রেনটি। ঢাকা থেকে বের হওয়ার পর ট্রেনটি গেন্ডারিয়া স্টেশন, জুরাইন রেলক্রসিং ও নারায়ণগঞ্জের পাগলা পর্যন্ত সমতল লাইন দিয়ে চলাচল করে। এর পর পাগলা থেকে কেরানীগঞ্জের নিমতলী প্রায় ১৯ কিলোমিটার পথ উড়াল রেলপথ অতিক্রম করে। ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত ঘণ্টায় প্রায় ৬০ কিলোমিটার গতিতে চলাচল করেছে ট্রেনটি। এ সময় রেলপথের দুই পাশে স্থানীয় মানুষ ও উৎসুক জনতা হাত নেড়ে আনন্দ প্রকাশ করতে দেখা গেছে।
পরীক্ষামূলক ট্রেনের লোকোমাস্টারের দায়িত্বে ছিলেন মো. এনামুল হক। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ‘ঢাকা-ভাঙ্গা পর্যন্ত সার্বিকভাবে ট্রেন চলাচলের জন্য প্রস্তুত রয়েছে রেলপথ। পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে ট্রেন চলাচল করা ছিল স্বপ্নের মতো। এ খর¯্রােতা নদীর ওপর  ট্রেন চলবে এটা কল্পনারও ঊর্ধ্বে ছিল। আজ সে স্বপ্ন বাস্তব হলো।’ ঢাকা-ভাঙ্গা পর্যন্ত পরীক্ষামুলক ট্রেনটি ৬০ কিলোমিটার গতিতে চলাচল করেছে বলে জানান তিনি।  বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা ২৬ মিনিট ট্রেনটি এ সেতুতে ওঠে, পার হয় ১১টা ৩৪ মিনিটে। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার সেতু পার হতে মাত্র আট মিনিট সময় লাগে। 
বৃহস্পতিবার দুপুর সোয়া ১২টায় ট্রেন ভাঙ্গা জংশনে পৌঁছায়। এ সময় স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও রেলওয়ে কর্মকর্তারা মন্ত্রীসহ সবাইকে স্বাগত জানায়। বেলুন উড়িয়ে উৎসব উদযাপন করা হয়। পরে ফরিদপুরের ভাঙ্গা জংশনে এক সংবাদ সম্মেলনে রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, ‘দীর্ঘ প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু এক বছর আগে প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করেন। প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারের দশটি প্রকল্পের দুটি হলো পদ্মা রেল সংযোগ ও চট্টগ্রাম দোহাজারী কক্সবাজার সম্প্রসারিত রেল সংযোগ প্রকল্প। এই দুটি প্রকল্প উদ্বোধনের জন্য প্রস্তুত। আগামী ১০ অক্টোবর পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের ঢাকা-ভাঙ্গা অংশটি উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রাথমিকভাবে রাজধানী ঢাকার কমলাপুর থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ভাঙ্গা পর্যন্ত ৮২ কিলোমিটার চলাচলের জন্য উন্মুক্ত হবে। যশোর পর্র্যন্ত মোট ১৬৯ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে। ২০২৪ সালের জুনে পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।’
রেলমন্ত্রী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর ২০১১ সালে রেল মন্ত্রণালয় গঠন করে রেলের উন্নয়নে কাজ করে চলেছেন। রেল নিয়ে আমাদের যে পরিকল্পনা মোটা দাগে, আমরা সমগ্র জেলায় রেল সংযোগ পৌঁছে দেব।  ভাঙ্গা স্টেশন অত্যন্ত আধুনিক এবং আইকনিক বিল্ডিং দিয়ে তৈরি হবে।’
এই রেলপথটি চালু হলে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষ সুবিধা পাবে উল্লেখ করে রেলমন্ত্রী বলেন, ‘খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এ রুটে বাণিজ্যিকভাবে ট্রেন চলাচল করবে। আর আগামী বছরের জুন মাসেই যশোর পর্যন্ত এই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। এর মাধ্যমে মোংলা পোর্টকে পরিপূর্ণভাবে ব্যবহারের জন্য রেলপথকে কাজে লাগিয়ে খরচ ও সময় কমবে। এর মাধ্যমে এ রেল যোগাযোগ অর্থনৈতিকভাবে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখবে। খুলনায় যেসব ট্রেন চলছে সেগুলোকে এই রেল যোগাযোগের সঙ্গে যুক্ত করা হলে মোংলা পোর্টকে পরিপূর্ণভাবে ব্যবহার করা যাবে। দক্ষিণাঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য সেটি আরও বেশি প্রসারিত হবে। এই রেলপথকে কাজে লাগিয়ে ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগের সময় ও খরচ কমবে।’ ঢাকা থেকে খুলনার যে দূরত্ব তা অর্ধেকে নেমে আসবে বলে জানান তিনি।
মো. নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, রেলপথটি পুরোপুরি চালু হলে যাতায়াত, মালামাল পরিবহনে অনেক সুবিধা পাবে মানুষ। এতে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবেন এই অঞ্চলের মানুষ। কলকাতার সঙ্গে যারা ব্যবসা বাণিজ্য করে তাদের আর বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে মালামাল পরিবহন করতে হবে না। ঢাকা যশোর রেলপথ পুরোপুরি চালু হলে ঢাকা থেকে সরাসরি এই পথ ব্যবহার করা যাবে।’ ঢাকা থেকে যশোর ১৭২ কিলোমিটারের রেল লাইনের মধ্যে আজ ঢাকা থেকে ভাঙ্গা আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রায়াল রান করলাম। এটা প্রস্তুত হয়েছে সেটা দেখলাম। আমাদের সঙ্গে যাত্রী হয়ে সাংবাদিকরা এসেছেন। এ সময় রেলের ডিজি, সেনাবাহিনী সংশ্লিষ্টদের যারা এই প্রকল্পের জন্য নিরলস কাজ করেছেন সবাইকে ধন্যবাদ জানান তিনি। পরে একই ট্রেনে করে আবার ঢাকার কমলাপুরে ফিরে আসেন রেলমন্ত্রীসহ অন্যরা।

পুরো প্রকল্প শেষ হবে ২০২৪ সালে ॥ পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পটি তিনটি অংশে নির্মাণ করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত প্রকল্পের সার্ভিস অগ্রগতি ৮২ শতাংশ। এর মধ্যে ঢাকা-যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার মেইন লাইন, ঢাকা-গে-ারিয়া পর্যন্ত ৩ কিলোমিটার ডাবল লাইন, লুপ, সাইডিং ও ওয়াই-কানেকশসসহ মোট ২১৫ দশমিক ২২ কিলোমিটার ব্রড গেজ রেল লাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ঢাকা-মাওয়া পর্যন্ত কাজ শেষ হয়েছে ৮১ শতাংশ, মাওয়া-ভাঙ্গা পর্যন্ত কাজ শেষ হয়েছে ৯৭ শতাংশ ও ভাঙ্গা-যশোর পর্যন্ত কাজ শেষ হয়েছে ৭৮ শতাংশ। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পটি ২০১৬ সালের ডিপিপি অনুমোদনের সময় ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৪ হাজার ৯৮৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা।

মেয়াদ ধরা হয়েছিল ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। কিন্তু ২০১৯ সালের এপ্রিলে প্রকল্পের ব্যয় আরও ৪ হাজার ২৬৯ কোটি ২৭ লাখ টাকা বৃদ্ধি করে ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা।  এছাড়া ২০২৪ সালে জুনে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব অনুমোদন দেয় একনেক সভা। জিটুজি ভিত্তিতে প্রকল্পের অর্থায়নে করছে চায়না এক্সিম ব্যাংক। এর মধ্যে চীনের এক্সিম ব্যাংক ঋণ সহায়তা দেবে ২১ হাজার ৩৬ কোটি ৬৯ লাখ। বাকি ১৮ হাজার ২১০ কোটি ১১ টাকা ব্যয় হয়েছে সরকারি ফান্ড থেকে। ২০১৮ সালের এপ্রিলে চীনের সঙ্গে চূড়ান্ত ঋণ চুক্তি হয়। এর দুই বছর আগে কমার্শিয়াল চুক্তি হয়েছিল। প্রকল্পের নির্মাণকাজ করছে চায়না ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিআরইসি।
চারদিকে উচ্ছ্বাস ॥ মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল, মুন্সীগঞ্জ থেকে জানান, রাজধানীর থেকে পদ্মা সেতু অতিক্রম করে প্রথমবারের মতো ট্রেন ভাঙ্গায় পৌঁছলে চারদিকে উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়ে। এর পরই আতশবাজির ঝিলিক আর বেলুনের মাতামাতিতে বিশেষ পরিবেশ তৈরি করে। স্থানীয়দের আশা ট্রেন আরেক ধাপ ভাগ্য বদলে  দেবে দক্ষিণের মানুষের। পরীক্ষমূলক ট্রেনের অপেক্ষায় অসংখ্য মানুষ। দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটে বেলা সোয়া ১২টার দিকে। রাজধানী থেকে পদ্মা সেতু অতিক্রম করে ট্রেন তখন ভাঙ্গায়। তাই উচ্ছ্বসিত ফরিদপুরবাসী। ট্রেন থেকে রেলপথমন্ত্রীসহ অন্যান্য অতিথি ও যাত্রীদের বরণ করা হয়। এর পরই ভাঙ্গার আকাশে রংবেরঙের আতশবাজি আর অসংখ্য বেলুন।

শরতের নীল আকাশের মাঝে সাদা মেঘের ভেলার সঙ্গে সব একাকার।  পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত পরীক্ষামূলকভাবে ট্রেন চলাচল নিয়ে আগে থেকেই পদ্মার দুই পাড়ের মানুষের মধ্যে বিরাজ করে উৎসব আমেজ।  বৃহ¯পতিবার সকাল ১০টা ৭ মিনিটে ঢাকার কমলাপুর থেকে ট্রেন রওনা হয় ভাঙ্গা। আর ভাঙ্গায় ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট যাত্রা বিরতি করে আবার ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয় দুপুর ১টা ৩৫ মিনিটে।  ফেরার পথে পদ্মা সেতুর ১ নম্বর খুঁটির সামনে ট্রেন কয়েক মিনিট থামিয়ে রাখা হয় ছবি তোলার সুবিধার্থে। এরপর আবার রওনা হয়ে বিকেলে কমলাপুর পৌঁছায়।

×