ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১২ মে ২০২৫, ২৯ বৈশাখ ১৪৩২

নদী পাড়ের মানুষের বর্ষার প্রস্তুতি

জেলেদের ভাসমান জীবন : পদ্মার বুকেই সংগ্রামের নৌকা

শফিকুল ইসলাম শামীম

প্রকাশিত: ২৩:৫৮, ১১ মে ২০২৫

জেলেদের ভাসমান জীবন : পদ্মার বুকেই সংগ্রামের নৌকা

বর্ষার আগ মুহূর্তে পদ্মা পাড়ে নৌকা তৈরিতে ব্যস্ত কারিগররা

পদ্মা নদী বরাবরের মতো এবারও জীবিকার প্রধান অবলম্বন হয়ে উঠেছে রাজবাড়ী জেলার হাজার হাজার জেলের জন্য। বর্ষা আসার আগমুহূর্তে পদ্মা নদীর পাড়ে এখন ব্যস্ততা তুঙ্গে। কেউ নতুন নৌকা তৈরি করছেন, কেউ বা পুরনো নৌকায় হাত দিচ্ছেন মেরামতের কাজ। ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাঠ, লোহার পেরেক, রঙ আর ইঞ্জিনের শব্দে মুখর পদ্মা নদীর পাড়ের চিত্র যেন এক জীবন্ত সংগ্রাম।
জেলার পদ্মা নদীর পাড়ে সরেজমিন ঘুরে এমনি চিত্র দেখা যায় ও সংশ্লিষ্ট জেলে ও জেলে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাজবাড়ী জেলার পদ্মা নদীর পাড় ঘেঁষে গড়ে ওঠা জেলে পল্লীর মানুষেরা যুগ যুগ ধরে নদীকে ঘিরেই বাঁচতে শিখেছেন। নদী কেড়ে নিয়েছে অনেকের বসতভিটা, আবার সেই নদীর বুকে জেগে ওঠা নতুন চরে অনেকেই গড়ে তুলেছেন নতুন জীবন। ভাঙা-গড়ার এই অনিশ্চয়তায়ও থেমে নেই জীবিকার তাগিদ।

পদ্মার বুকে মাছ ধরার জন্য বিভিন্ন ধরনের নৌকা ব্যবহৃত হয়। ছোট ট্রলার, কাঠের মাঝারি নৌকা, ইঞ্জিনচালিত বড় নৌকা, খেয়া নৌকা, মালপত্র আনা নেওয়া নৌকাসহ নানা রকম নৌকা এখন প্রস্তুত হচ্ছে। বন্যা মৌসুমে নদীতে চলাচল উপযোগী ও নিরাপদ নৌকা ছাড়া জীবনযাপন প্রায় অসম্ভব।
রাজবাড়ী জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায় জেলার ৫টি উপজেলায় ১৪ হাজার ২ শতাধিক নিবন্ধনকৃত জেলে রয়েছে। তবে বাস্তবে এই চিত্র কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে। অনেক জেলে নিবন্ধন হতে পারেনি। আবার অসংখ্য অপ্রাপ্ত জেলে রয়েছে। নদীর পারের বসতি জেলেরা দুঃখ করে বলেন, সরকারি সহায়তার অভাব, নদীভাঙনের ভয় ও বাজারে সরঞ্জামের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে চাপে পড়েছেন তারা।

তবুও দমে যান না পদ্মার এই সাহসী মানুষগুলো। নদীর ¯্রােত যেমন তাদের ঘর কেড়ে নেয়, তেমনি জীবিকা দান করে শক্ত হাতে। এই ভাসমান জীবনের বাস্তবতা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, কীভাবে প্রতিদিন নদীর সঙ্গে লড়েই বাঁচে একেকটি পরিবার।
জেলে মো. হারেজ সরদার বলেন, ‘এই নৌকাটা বানাতে খরচ পড়বে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। ইঞ্জিন লাগাতে আরও ৫০ হাজার। সব মিলিয়ে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা লাগবে। এর সঙ্গে আরও যোগ হবে জাল তৈরি। সেখানেও প্রায় ১৫-২০ হাজার টাকা প্রয়োজন। তিনি জানান একটি নৌকা নদীতে মাছ ধরতে গেলে নতুন প্রায় ২ লাখ টাকা ব্যয় হয়। এমন একটি নৌকায় মাছ ধরতে কমপক্ষে তিনজন জেলে প্রয়োজন হয়। একটি নতুন মাছ ধরার নৌকা তৈরি করলে ২-৩ বছর ব্যবহার করা যায়। তবে প্রতি বছর মেরামত করা প্রয়োজন। 
এ সময় আব্দুল হালিম নামের এক জেলে বলেন, বছরে অন্তত একবার নৌকা মেরামত বা পরিবর্তন করতে হয়। যারা নতুন নৌকা বানাতে পারেন না, তারা সামান্য খরচে পুরনো নৌকায় করে নেন রং-চং ও কাঠামো সংস্কার। তিনি বলেন, বড় একটি নৌকায় ১০-১২ জন জেলে মাছ শিকার করে। ছোট নৌকায় ২-৩ জন জেলেরা মাছ শিকার করে। নৌকাও বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। তবে কমপক্ষে একটি নৌকা নতুন তৈরি করতে লাখ টাকা প্রয়োজন হয়। 
জালাল নামের এক জেলে বলেন, এই মৌসুমে নৌকা তৈরির প্রতিটি পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মিস্ত্রি অর্থাৎ নির্মাণ শ্রমিক এর চাহিদা অনেক। যে কারণে এই মৌসুমে একজন নির্মাণ শ্রমিকের মজুরি কমপক্ষে ৮-৯ শত টাকা। সেটাও সময়মতো পাওয়া যায় না। এর মধ্যে আবার চাহিদামতো নির্মাণ শ্রমিক। কারণ’ অনেক নির্মাণ শ্রমিকের কাজ নিখুঁত। নিপুণ হাতে তৈরি হচ্ছে এসব নৌকা। আবার অনেকে কাজ করলেও চাহিদামতো বা পছন্দমতো নৌকা তৈরি করতে পারে না। 
তবে নির্মাণ শ্রমিক অর্থাৎ মিস্ত্রিরা বলেন, সারা বছরে তেমন কাজ-কর্ম থাকে না। এই মৌসুমে নৌকা তৈরি কাজ বেশি। কারণ পদ্মা নদীর পার ঘেঁষে প্রায় প্রতিটি বাড়িতে মাছ ধরা থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য নৌকা রয়েছে। তাই বর্ষার আসার পূর্বে অনেকে নতুন নৌকা, আবার কেউ পুরাতন নৌকা মেরামত করবে। এই নৌকা সারা বছর জেলেরা নিরাপদে মাছ শিকার করবে। অনেকে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করছে।

আরো পড়ুন  

×