ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১০ মে ২০২৫, ২৭ বৈশাখ ১৪৩২

ভালো নেই মৃৎশিল্পীরা

নীতিশ চন্দ্র বিশ্বাস, গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ০১:৩৩, ৪ আগস্ট ২০২৩

ভালো নেই মৃৎশিল্পীরা

ভালো নেই গোপালগঞ্জের মৃৎ শিল্পীরা

ভালো নেই গোপালগঞ্জের মৃৎ শিল্পীরা। মৃৎ শিল্পের এই অনন্য শিল্পীরা জীবিকা নির্বাহ করছেন কোনো রকমে। আর্থিক স্বচ্ছলতা না থাকায় সন্তানদেরকেও শিক্ষাদিক্ষার দিকে নিতে তারা আগ্রহ দেখান না। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এ শিল্পটাকে তারা বংশীয় পেশা হিসেবে বেছে নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে চলেছেন। কিন্তু মাটির পরিবর্তে প্লাস্টিকের তৈরি সরঞ্জামে বাজার ছেয়ে যাওয়ায় তাদের এ পেশা ধরে রাখাও কঠিন হয়ে পড়েছে। 
গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া উপজেলার হিরণ গ্রামে বসত করছেন প্রায় একশ’ কুমার-পরিবার। ‘কুমার বাড়ি’ বা ‘পাল বাড়ি’ জিজ্ঞেস করলেই মানুষ সহজেই চিনিয়ে দেয় তাদের বাড়িগুলো। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তারা এ পেশাটাকে ধরে রেখেছেন। মাটি দিয়ে তারা তৈরি করতেন যে কোনো ধরনের খেলনা, থালা-বাটি, হাড়ি, মাটি ও মাটির ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রকারের নিত্য ব্যবহার্য সরঞ্জাম। কিন্তু বাজারের রঙিন প্লাস্টিকের দাপটে এখন মাটির তৈরি এসব জিনিসের চাহিদা কমে গেছে বলে মন্তব্য তাদের। 
কোটালীপাড়ার ওই কুমাররা বেশিরভাগই এখন কাজ করেন সিজনাল। বিভিন্ন পূজার সময়ে মূর্তি ও প্রতীমা গড়ার কাজ করেন। কিছু কুমার পরিবার রয়েছে, যারা নিয়মিতভাবে পূজার ঘট, সড়া, দধির হাড়ি, দধির কাপ, নোচনা ইত্যাদি তৈরি করেন। এরপর হাটে-হাটে গিয়ে সেগুলো বিক্রি করেন। গোপালগঞ্জ শহরসহ জেলার বিভিন্ন স্থান থেকেও কিছু ব্যবসায়ী তাদের কাছ থেকে এসব কিনে নিয়ে যান। এসবের মধ্যেই যা আয় হয়, তাই দিয়েই তাদের সংসার চলে। 
হিরণ গ্রামের ওই কুমার পাড়ায় (পাল পাড়া) সরেজমিন গেলে কথা হয় ৬৫ বছর বয়সের কুমার (মৃৎশিল্পী) মরণ পালের সঙ্গে। তিনি জানান, তিনি লেখাপড়া করেননি। বাবার হাত ধরেই এ মৃৎশিল্পকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন এবং এখনো নিয়োজিত আছেন। তার ঠাকুর-দাদাও একজন ‘কুমার’ ছিলেন। তার সঙ্গে একই পেশায় নিয়োজিত তার বড় ছেলে হরিচাঁদ পাল (২৮)। এটাই তাদের একমাত্র পেশা। অন্য কোনো আয়ের উৎসও নেই। তার আরও দু’টি ছেলে কলেজ-লেভেলে পড়াশুনা করছে। আর্থিক স্বচ্ছলতা না থাকায় বড় ছেলেকে পড়াতে পারেননি, তার এসএসসি হয়নি। তাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি পূজার ঘট, সড়া, ধূপতি, দধির হাড়ি ও কাপসহ নানা মাটির সরঞ্জাম তৈরি করছেন। বিক্রি করছেন, আর যা আয় হচ্ছে তাই দিয়েই সংসার চালাচ্ছেন। কোনো সঞ্চয় হয় না। জরুরি প্রয়োজন হলে তাকে ধার করতে হয়।

এলাকার আরেক কুমার (মৃৎশিল্পী) তুলশী পাল (৬২) বলেন, একসময় কুমাররা শক্ত লাঠি দ্বারা হাতে ঘুরানো চাকার ওপর মাটির এসব জিনিস তৈরি করত। এখন আর সেই চাকা দেখা যায় না। এখন বেশিরভাগই মোটর-চালিত ঘূর্ণায়মান প্লেটের ওপর এসব কাজ করা হয়। তাই সেখানেও কিছু উৎপাদন-খরচ বেড়ে যায়। কিন্তু কিছুই করার নেই। স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে নিয়ে কোনো রকমে জীবিকা নির্বাহ করছেন। 
একই এলাকার কুমার (মৃৎশিল্পী) বিপুল পাল (২৫) জনকণ্ঠকে জানান, তারা তিন ভাই। তিনি সবার ছোট। তারা তিন ভাই-ই তাদের বাবার হাত ধরে এ পেশায় এসেছেন। প্রত্যেকেরই স্ত্রী-সন্তান নিয়ে পৃথক সংসার। তিনি বলেন, আগেকার সেই মাটির ব্যাংক, বিভিন্ন ধরনের পুতুল-খেলনা, থালা-বাটি, বিভিন্ন প্রকার হাড়ি, মাটি- এগুলো সবই এখন চলে গেছে রঙিন প্লাস্টিকের মধ্যে। তাই মাটির তৈরি সরঞ্জামের দিকে মানুষের আকর্ষণ কম। উন্নত শহরগুলোতে এসব সরঞ্জামের কদর কিছুটা বাড়লেও আমাদের এলাকায় সে অবস্থাটা নেই। ১ জোড়া পূজার ঘট বিক্রি করে পাওয়া যায় ১৫ টাকা, ১ জোড়া সরা বা ঢাকনা ১৫ টাকা, ১ পিস নোচনা ৫ টাকা, ১ পিস কাপ বিক্রি করে পাওয়া যায় ৪ টাকা। তারপরও এই মাটি নিয়েই পড়ে থাকি নিত্যবেলা। রাত পোহালে এই মাটি ছেনেই চারটে ভাতের ব্যবস্থা হয়। 
কোটালীপাড়ার হিরণ গ্রামে প্রায় একশ কুমার-পরিবার রয়েছে। এসব পরিবারগুলো যার যার নিজের সর্বস্ব দিয়ে এ পেশাটাকে ধরে রেখেছে বহুকাল থেকে। কখনো দেখিনি বা শুনিনি যে, আমাদের উন্নয়নের জন্য সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। 
এ বিষয়ে আলাপকালে গোপালগঞ্জ বিসিকের এজিএম রাসেল জানিয়েছেন, জেলায় মৃৎশিল্পীদের নিয়ে সে ধরনের কোনো কার্যক্রম নেই। তবে, বিসিকের পক্ষ থেকে বছরে তিনবার শিল্প উদ্যোক্তা ও উন্নয়ন বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়ে থাকে। আপাতত: মৃৎশিল্পীরা এ প্রশিক্ষণ নিয়ে তাদের এ পেশা ও ব্যবসাকে আরও উন্নত ও ত্বরান্বিত করতে পারেন। শীঘ্রই বিসিকের পক্ষ থেকে কোটালীপাড়ার ওই কুমার-পরিবারগুলো ঘুরে দেখে তাদের সার্বিক অবস্থা ও চাহিদা অনুযায়ী কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করা গেলে তা অবশ্যই করা হবে। 

নীতিশ চন্দ্র বিশ্বাস, গোপালগঞ্জ

×