![চট্টগ্রামে একের পর এক শিশু অপহরণ ধর্ষণ ও হত্যা চট্টগ্রামে একের পর এক শিশু অপহরণ ধর্ষণ ও হত্যা](https://www.dailyjanakantha.com/media/imgAll/2023January/3-2303301729.jpg)
চট্টগ্রামে বর্বরতার শিকার তিন শিশু। বাঁ থেকে- আয়নী, আয়াত ও বর্ষা
বিরিয়ানি, চিপস কিংবা কোনো কিছুর প্রলোভন দেখিয়ে কন্যা শিশুদের প্রতি যৌন হয়রানিসহ নানা ধরনের বর্বরতা বাড়ছে চট্টগ্রামে। সম্প্রতি চট্টগ্রামে একের পর এক শিশু ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় আতঙ্কিত অভিভাবকরা। ইপিজেডে শিশু আয়াতকে হত্যার পর ছয় টুকরো করা এবং জামালখানে প্রথম শ্রেণির ছাত্রী বর্ষাকে ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যার ঘটনার রেশ না কাটতেই পাহাড়তলীতে চতুর্থ শ্রেণির আবিদা সুলতানা আয়নী হত্যাকা-ের ঘটনা জনমনে রেখাপাত করেছে। বিড়াল ছানা দেওয়ার কথা বলে শিশুটিকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিল রুবেল নামে এক সবজি বিক্রেতা।
থানা পুলিশের নির্লিপ্ততায় এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে, বলছেন বিশিষ্টজনেরা। আর সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, এক ধরনের বিকারগ্রস্ত মানসিকতার বলি হচ্ছে কন্যা শিশুরা। এছাড়া মূল্যবোধের অবক্ষয় ও সামাজিক সচেতনতার অভাবে বাড়ছে এমন নৃশংস ঘটনা। এসব প্রতিরোধে পাড়াভিত্তিক সচেতন কমিটি ও সাংস্কৃতিক কর্মকা- বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
চট্টগ্রামে পাহাড়তলীর নিখোঁজ আবিদার বস্তবন্দি লাশ উদ্ধারের পর আতঙ্কিত নগরবাসী।
আয়াত হত্যাকা-ের ভয়াবহতা না কাটতেই এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলেও পাহাড়তলী থানা পুলিশের নির্লিপ্ততাকে দুষছেন অনেকে। শিশু আবিদার পরিবার চিনত পাষ- রুবেলকে। বিড়াল ছানা ভালবাসতো আবিদা, সেই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়েই রুবেল যৌন নির্যাতনের জন্য ফাঁদ পাতে। বিড়াল ছানা দেওয়ার কথা বলে গত ২১ মার্চ একটি ফাঁকা ভবনে নিয়ে গিয়ে তাকে যৌন নির্যাতন ও হত্যা করে। যেখান থেকে লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, সেখান থেকে দুই কিলোমিটার দূরে শিশুটির পোশাক ফেলে রাখা হয়, যাতে ক্লু না পায় কেউ।
সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, অনলাইন নির্ভরতার কারণে অনেকেই নিজের মস্তিষ্কজাত বুদ্ধি বিবেচনা ও নৈতিকতাকে ভুলতে বসেছে। অনেকে অপরাধ সংঘটনের জন্য শিশুদের বেছে নেয়, আবার হীনইচ্ছা চরিতার্থে শিশুদের টার্গেট করা হয়। পরিবারের বড় সদস্যদের বিষয়ে কোনো প্রতিশোধ থাকলে তা শিশুদেরকে বলি পাঠা বানায়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য সমাজবিজ্ঞানী ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, মানুষের দুর্বল জায়গায় আঘাত করার জন্য অনেক সময় শিশুদের ওপর নির্যাতন করে থাকে। এটি যেমন মানসিক বিকারগ্রস্ততা, তেমনি নৈতিক অবক্ষয়। এসব কারণে শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতন বেড়েছে। এক্ষেত্রে পুলিশি নির্লিপ্ততার সুযোগ নেয় অপরাধীরা। পরিবারের নজরদারি, সামাজিক শৃঙ্খলা ও অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের মাধ্যমে এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনা যায়।
উন্নত দেশে বিকারগ্রস্ত ব্যক্তিদের সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে কাউন্সেলিং ও চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। আমাদের দেশে এমন ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। না হয় এমন পৈশাচিক নৈরাজ্য ছড়িয়ে পড়বে। অনলাইনে পর্নোগ্রাফি সহজলভ্য হয়ে গেছে, যার প্রভাব পড়ছে সমাজে। আর এসবের টার্গেট হচ্ছে শিশুরা। পাড়া মহল্লায় সচেতনতা বাড়াতে সমাজের সকল পর্যায়ের ব্যক্তি নিয়ে কমিটি করে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম ও প্রচারণা চলাতে হবে।
জানা গেছে, আবিদার খোঁজ না পেয়ে বারবার পাহাড়তলী থানায় গিয়ে এবং পুলিশ সদস্যদের মামলা নিতে অনুরোধ করলেও তারা ছিলেন নির্লিপ্ত। উল্টো শিশু আবিদা সম্পর্কে পুলিশ সদস্যদের আচরণ ছিল নেতিবাচক। মুরগির ফার্ম এলাকার আলমতারা পুকুর পাড়া এলাকার ডোবা থেকে আবিদার লাশ উদ্ধারের এক সপ্তাহ আগে পাহাড়তলী থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন তার মা বিবি ফাতেমা। তাদের সন্দেহ রুবেলকে, এ বিষয়টি পুলিশকে জানালেও পুলিশের ছিল দায়সারা আচরণ, এমন অভিযোগ পরিবারের।
তারা জানিয়েছেন, আসামি রুবেলকে তখন থানায় ডেকে নিয়ে আবার ছেড়েও দেয়। আবিদার মা বারবার বলার পরও মামলা নেয়নি। পরে ফাতেমা আদালতের শরণাপন্ন হন। বিবি ফাতেমা গত বুধবার মেয়ের লাশ উদ্ধারের পর বারবার বিলাপ করে বলছিলেন, যদি থানা পুলিশ উদ্যোগী হত মেয়ে লাশ হত না, মেয়ে মরত না। এলাকাবাসীরা ক্ষোভ জানিয়েছে পুলিশি নির্লিপ্ত আচরণের।
প্রসঙ্গত এর আগে আয়াতের ঘটনাটিও ইপিজেড থানা পুলিশ পাত্তা দেয়নি।
পরে পিবিআই রহস্যের জট খুলে আয়াতের খ-িতাংশ উদ্ধার করে। চট্টগ্রামের বন্দর, ইপিজেড, পাহাড়তলী, হালিশহর থানা এলাকায় শিশু অপহরণ ও নিখোঁজের ঘটনা কোনোভাবে কমছে না। নগরীর জামালখান এলাকায় শিশু বর্ষা হত্যাকা-ের ক্লুলেস ঘটনাটি কোতোয়ালি থানা পুলিশের তৎপরতায় উদঘাটন হলেও ইপিজেড, পাহাড়তলী এলাকায় বিভিন্ন শিশু অপহরণ ও নিখোঁজের ঘটনাগুলো উদঘাটন করতে ব্যর্থ হচ্ছে সংশ্লিষ্ট থানাগুলো। আয়াত হত্যাকা-ের কোনো কুল কিনারা করতে পারেনি ইপিজেড থানা, আবিদা নিখোঁজ হলেও এ বিষয়টি সম্পর্কে কোনো ধারণাই পায়নি পাহাড়তলী থানা।
এদিকে গত ২ নভেম্বর চট্টগ্রামে আকবরশাহ থানার উত্তর কাট্টলীর কর্নেল হাট জোন্স রোডের কবরস্থানের পাশে পাঁচ বছরের কন্যা শিশুকে ধর্ষণ করে ৪৫ বছর বয়সী রিক্সাচালক আলমগীর খান। চিপসের প্রলোভন দেখিয়ে শিশুটির ওপর যৌন নির্যাতন করা হয়। আকবর শাহ থানা পুলিশের তৎপরতায় গ্রেপ্তার হয় আলমগীর। ২৫ নভেম্বর আয়াতের লাশের খ-াংশ উদ্ধার করে পিবিআই। ১৫ নভেম্বর শিশুটি নিখোঁজ হয়েছিল। আবির নামের এক প্রতিবেশীই তাকে মুক্তিপণ আদায় করতে অপহরণের পর হত্যা করে।
২৪ অক্টোবর জামালখানের বর্ষা নামের প্রথম শ্রেণির এক ছাত্রী নিখোঁজ হয়। তিনদিন পর নালা থেকে বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করা হয়। এক দোকান কর্মচারী ধর্ষণের পর তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করে। এরপর লাশ বস্তাবন্দি করে ফেলে দেয় নালায়। ২০২২ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর বন্দর থানার আবাসিক পোর্ট কলোনির একটি পরিত্যক্ত ভবন থেকে সাত বছর বয়সী শিশু সুরমার মরদেহ উদ্ধার হয়।
১৩ অক্টোবর বন্দর থানা পুলিশ সুরমা ধর্ষণ ও হত্যায় জড়িত রিক্সা চালক ওসমান হারুন মিন্টুকে গ্রেপ্তার করে। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে আসামি জানায়, চিৎকার-চেঁচামেচি করায় গলায় গামছা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা পরবর্তী লাশ ফেলে রেখে যায়। গত ১৩ মার্চ হালিশহরের থানা এলাকার এক ছাত্রীকে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনায় প্রতিবেশীকে গ্রেপ্তার করেছিল র্যাব।