ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ১৯ আশ্বিন ১৪৩১

স্বজনদের আহাজারি থামছেই না

মিমি-সুইটির স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল

প্রকাশিত: ২২:৫২, ১৯ মার্চ ২০২৩

মিমি-সুইটির স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল

সুইটি আলম সুরভী ও আফসানা মিমি

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএইউ) কৃষি বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী আফসানা মিমি (২৫)। পড়াশোনা শেষ তাই ময়মনসিংহ যাচ্ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সার্টিফিকেট আনতে। তার ইচ্ছা ছিল বিসিএস ক্যাডার হয়ে পরিবারের হাল ধরবেন। কিন্তু একটি দুর্ঘটনা কেড়ে নিল মিমির প্রাণ। এদিকে মা ফিরে আসবে বলে পথ চেয়ে বসে আছে নিহত মিমির এক বছর বয়সী একমাত্র মেয়ে। 

আজ রবিবার ভোরে গোপালগঞ্জের পুলিশ লাইন থেকে বাকি আরও অনেকের সঙ্গে ঢাকায় যাওয়ার জন্য ইমাদ পরিবহনের একটি বাসে ওঠেন আফসানা মিমি। পথিমধ্যে মাদারীপুরের শিবচরের কুতুবপুর এলাকায় বাসটি পৌঁছালে ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নিচে পড়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলে নিহত হন মিমি। তিনি গোপালগঞ্জ শহরের ব্যাংকপাড়া এলাকার হিরাবাড়ি রোডের মৃত আবু হেনা মোস্তফা নীল সর্দারের মেয়ে।

মিমির বাবা একজন সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। ছোট থাকতেই বাবাকে হারান মিমি। দুই বোনের মধ্যে তিনি বড়। ছোটবেলা থেকে অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন মিমি। তিন বছর আগে বিয়ে হয় তার। এক বছর বয়সী একটা মেয়ে রয়েছে তার। মায়ের কাছে মেয়েকে রেখে যাচ্ছিলেন সার্টিফিকেট আনতে। মিমির এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছে না তার পরিবারের কেউ। 

সার্টিফিকেট আনাই যেন কাল হলো এসব কথা বলে চিৎকার করে আর্তনাদ করছেন আফসানার মা কানিজ ফাতেমা। তার আহাজারিতে আশপাশের লোক জড়ো হয়ে তাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু কোনো ভাবেই তাকে শান্ত করা যাচ্ছে না। শোকে কাতর হয়ে পড়েছে প্রতিবেশীরাও। 

শুধু মিমি’র পরিবারই নয়; তার মতো মেয়েকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী সুইটিকে (২১) নিয়ে। সুইটি গোপালগঞ্জ শহরের পাচুরিয়া এলাকার মাসুদ মিয়ার (৬০) মেয়ে। রবিবার ভোরে গোপালগঞ্জ থেকে বাসে ওঠেন বাবা-মেয়ে। পথিমধ্যে ইমাদ পরিবহনের একটি বাস দুর্ঘটনায় মারা যান সুইটিও। আহত হন তার বাবা মাসুদ মিয়া। তাকে উদ্ধার করে শিবচরের পাঁচ্চর এলাকার ইসলামিয়া হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ভর্তি করা হয়। নিজে বেঁচে থাকলেও চোখের সামনে মেয়েকে হারিয়ে নির্বাক হয়ে পড়েছেন মাসুদ মিয়া। 

জানা গেছে, সুইটি ঢাবির ইংরেজি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি ঢাকার মিরপুরে একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন। মাসুদ মিয়া মেয়েকে সেখানে পৌঁছে দিতে যাচ্ছিলেন। এদিকে মেয়ের মৃত্যুর কথা শুনে মাসুদ মিয়ার গোপালগঞ্জের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। একমাত্র মেয়ের মৃত্যুর খবর মেনে নিতে পারছেন না সুইটির মা। বার বার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন তিনি। 

নিহত সুইটির মামা নুরু মিয়া বলেন, আমার দুলাভাই এসেনশিয়াল ড্রাগসে নিরাপত্তারক্ষীর চাকরি করেন। আমাদের একটাই ভাগ্নি। সুইটি তার বাবার সঙ্গে ঢাকায় যাচ্ছিল। দশটার দিকে আমাদের কাছে ফোন আসে আমার ভাগ্নি আর বেঁচে নেই। দুলাভাইয়ের সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে। 

ভয়াবহ এই দুর্ঘটনায় রবিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন অন্তত ২৫ জন। আহতদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা গুরুতর বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। 

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, রবিবার ভোরে  খুলনা থেকে ঢাকার গুলিস্তানের উদ্দেশে ইমাদ পরিবহনের ২০৩ নম্বর কোচটি ছেড়ে আসে। ভোর ৪ টা ৫৫ মিনিটে চার যাত্রী নিয়ে কোচটি সোনাডাঙ্গা উপজেলায় যায়। সেখান থেকে আরও পাঁচ যাত্রী নিয়ে ৫টার দিকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। পরবর্তীতে সকালে ৮টার দিকে মাদারীপুর শিবচরের কুতুবপুর এলাকায় দুর্ঘটনার শিকার হয় পরিবহনটি। 

গুরুতর আহতরা জানান, সকালে মৃদু বাতাস বইছিল। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিও হচ্ছিল। ফাঁকা রাস্তায় দ্রæতগতিতে চলছিল বাসটি। শিবচর কুতুবপুর এলাকায় আসতেই হঠাৎ বাসটির চাকা ফেটে যায়। চাকা ফেটে যাওয়ার শব্দও সবাই শুনতে পান। প্রথমে বাসটি ঝাকুনি খায়। এরপর ডানে-বামে হালকা বাঁক নেয়। তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকা লোকজন চমকে উঠেন। ডান-বামে বাঁক নেওয়ার সময় চালক বাসটি কন্ট্রোল করার চেষ্টা করেন। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে বাসটি মহাসড়কের রেলিং ভেঙে নিচে খাদে পড়ে যায়। যাত্রীরা কয়েক হাত উপরের দিক উঠে যান এবং বাসের ছাদের সঙ্গে ধাক্কা খায়। এতে কারো মাথা ফেটে যায়, কারো মুখমন্ডল থেতলে যায়। চিৎকার-চেচামেছিতে এক ভয়ংকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। 

আহতদের মধ্যে সাতজনকে ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি করা হয়। সেখানে কথা হয় তরিকুল ইসলামের সঙ্গে। গোপালগঞ্জে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন তিনি। দুই বছর আগে মারা যান তারিকুলের মেয়ে তাহমিনা তমা। গত বছর ক্যানসার আক্রান্ত হয়ে মারা যান স্ত্রী জাহানারা। স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে গড়ে ওঠা সুখের সংসার মাত্র দুই বছরের মধ্যে যেন শূন্য হতে চলছে। তারিকুলের আপনজন বলতে বেঁচে থাকা একমাত্র ছেলেও এ দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে ঢাকা মেডিক্যালে চিকিৎসাধীন। একমাত্র ছেলে বদরুদ্দোজাকে (৩০) হারানোর আশঙ্কায় বারবার বিলাপ করছেন তিনি।

তারিকুল ইসলাম বলেন, আমার মেয়ে বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছে। গত বছর আমার স্ত্রীও ক্যানসার আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। পরিবার বলতে আমার একমাত্র ছেলেটাই এখন রয়েছে। আমার একমাত্র ছেলেটাও অ্যাকসিডেন্ট করলো! ভাগ্যে থাকলে কিছু করার নেই। এখন তো দোয়া করা ছাড়া কিছু করতে পারবো না।

তিনি বলেন, আমার ছেলে ঢাকায় বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। সাপ্তাহিক ছুটিতে বাড়ি গিয়েছিল। ভোরে বাসে ওঠে ঢাকায় আসার জন্য। সকালে আমি ফোন পাই ছেলে নাকি অ্যাকসিডেন্ট করেছে। এরপর তাকে ঢাকায় আনা হয়। খবর শুনে আমিও গোপালগঞ্জ থেকে ঢাকায় এসেছি। বদরুদ্দোজার দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ঢাকা মেডিক্যালেল এসেছেন নিকটাত্মীয়রাও। জরুরি বিভাগে বদরুদ্দোজার চিকিৎসা চলছে বলে জানান তারা। 

ফরিদপুর সংবাদদাতা জানান, দীর্ঘদিন গোপালগঞ্জ জেলার পরিবার পরিকল্পনা অফিসের উপ-পরিচালক ছিলেন অনাদি রঞ্জন মজুমদার। এর আগে ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসাবে কর্মরত ছিলেন তিনি। রবিবারের দুর্ঘটনায় তিনিও মারা যান। তার এমন মৃত্যুতে পরিবার  ও সহকর্মীদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। 

দুপুরে শিবচর থানা পুলিশের কাছ থেকে তার মরদেহ গ্রহণের পর প্রথমে নেয়া হয় তার সাবেক কার্যালয় ভাঙ্গা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে। এরপর নেয়া হয় গ্রামের বাড়ি বাগেরহাটের মোল্যারহাটে। এসময় কান্নায় ভেঙে পড়েন পরিবার ও প্রতিবেশীরা। 

ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, মাদারীপুরে দুর্ঘটনার পর গুরুতর আহত অবস্থায় ১০ জনকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসলে কর্তব্যরত চিকিৎসক দুজনকে মৃত ঘোষণা করেন। নিহতরা হলেন- শেখ আকব্বর আলী (৬৫) ও মিনহাজ বিশ্বাস (৩২)। আহতরা হলেন- ইমামুল হোসাইন সাগর (৩৫), আব্দুল হামিম (৫৫), অমিত (২৮), শেখ ফয়সাল আহমেদ (৪০), মো বদরুদ্দোজা (৩০),পঙ্কজ দাস (৫০), ঝুমা আক্তার (৩৪), ও বুলবুল (৫০)।

নিহত আকবর আলীর ভাতিজা জাহিদুল ইসলাম বলেন, আমাদের বাড়ি বাগেরহাট থানার রামপাল এলাকায়। আমার চাচা চোখের ডাক্তার দেখানোর জন্য ঢাকায় আসছিলেন। পথিমধ্যে ইমাদ পরিবহনের বাসটি শিবচর এলাকায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে যায়। এতে আমার চাচা গুরুতর আহত হন। আমার চাচাকে ঢাকা মেডিক্যালে আনার পরে মারা যান।

নিহত মিনহাজ বিশ্বাসের চাচাতো ভাই সাব্বির বলেন, আমার চাচাতো ভাই ইমাদ পরিবহনের দুর্ঘটনাকবলিত বাসের সুপারভাইজার ছিলেন। পরে আহত অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে আসলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। খবর পেয়ে আমরা এসে তার মরদেহ শনাক্ত করি। তার বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলার সদর থানার পুরান মানিকদা এলাকায়। 

আহত ঝুমা আক্তারের চাচাতো ভাই মানিক বলেন, আমার বোনের স্বামী আমিনুল শেখ সৌদি প্রবাসী। ঝুমার তিন মেয়ে। তিন মেয়েকে নিয়ে ঝুমাও তার স্বামীর কাছে সৌদি যাওয়ার কথা ছিল। তাই তারা আগেই ভিসার আবেদন করেছেন, ভিসা পেয়েছেনও। আগামী শুক্রবার সৌদি যাওয়ার কথা। তাই এজেন্সির কাছ থেকে টিকিট ও অন্যান্য কাগজপত্র নিতে দেবর সজীব শেখকে নিয়ে ঢাকায় আসছিলেন ঝুমা। পথিমধ্যে দুঘটনায় সজীব শেখ (২২) ঘটনাস্থলেই মারা গেছে। আর ঝুমার মাথা ফেটে গেছে, কোমরের পাজর ভেঙে গেছে, হাত-পা কেটে গেছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। ঝুমার এমন খবরে রবিবার সন্ধ্যায় সৌদি থেকে ঢাকায় ফিরেছেন তার স্বামী।

এমএইচ

×