![অলস ভাসছে ৮ শতাধিক লাইটার অলস ভাসছে ৮ শতাধিক লাইটার](https://www.dailyjanakantha.com/media/imgAll/2023January/art-2-2303021904.jpg)
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব বাণিজ্যে টালমাটাল অবস্থা
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব বাণিজ্যে টালমাটাল অবস্থা। দেশে দেশে অর্থনৈতিক মন্দাভাব। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির পাশাপাশি বেড়েছে ডলারের দাম। মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের জন্য সরকার আমদানির ওপর কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। এর ফলে কমেছে আমদানি ও চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ আগমন। বিদেশ থেকে আসা আমদানি পণ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশের অভ্যন্তরীণ জলপথে জাহাজ চলাচল। পণ্য আমদানি কমে যাওয়ায় গভীর সংকটে পড়েছে লাইটার জাহাজগুলো। তাই অলস ভাসছে অন্তত আটশ’ লাইটার জাহাজ।
এতে করে জাহাজ মালিক এবং শ্রমিকদের এখন চরম দুর্দিন। জাহাজ পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো বন্দর কর্তৃপক্ষ ও উচ্চ পর্যায়ে বৈঠক করে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছে। কিন্তু বিষয়টি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হওয়ায় সকল পক্ষই রয়েছে ঘোর অনিশ্চয়তার মধ্যে।
চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা যায়, টার্মিনাল ও বার্থগুলোতে এখন আর আগের মতো জাহাজ নেই।
অপেক্ষমাণ জাহাজের সংখ্যাও গত কয়েক মাসের তুলনায় কম। এতেই পরিষ্কার যে, আমদানি কমেছে। ফলে বার্থগুলো আর আগের মতো কাজ পাচ্ছে না। এর সুরাহা কীভাবে হতে পারে সে বিষয়টিও এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। কারণ বিশ্ব বাণিজ্য স্বাভাবিক হওয়ার ওপরই নির্ভর করছে পরিস্থিতি আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়া-না যাওয়া।
বার্থ অপারেটর, শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর অ্যান্ড টার্মিনাল অপারেটর ওনার্স অ্যাসোসিয়েসনের সভাপতি ফজলে ইকরাম চৌধুরী জনকণ্ঠকে জানান, তাদের এখন বেশ দুর্দিন চলছে। বার্থে পর্যাপ্ত কাজ নেই। দুর্বিষহ জীবন কাটছে অপারেটদের পাশাপাশি শ্রমিকদের। তিনি বলেন, আমরা প্রতি মাসে ১৪ হাজার ৮০০ কন্টেনার হ্যান্ডলিং হবে হিসেব করে টেন্ডারে অংশগ্রহণ করেছিলাম। এখন হ্যান্ডলিং হচ্ছে ৫ হাজারের নিচে। শ্রমিকরা মজুরি পেয়ে থাকে কন্টেনার হ্যান্ডলিং অনুযায়ী।
যেহেতু হ্যান্ডলিং কম হচ্ছে সেহেতু তাদের আয়ও কমে গেছে। অনেকেরই কর্মহারা হবার উপক্রম। বিষয়টি বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করে জানানো হয়েছে। আমরা বলেছি, সব জাহাজ সিসিটি (চিটাগাং কন্টেনার টার্মিনাল) এবং এনসিটিতে (নিউমুরিং কন্টেনার টার্মিনাল) না দিয়ে জেনারেল কার্গো বার্থের (জিসিবি) ৬টি জেটিতেও যৌক্তিক হারে কিছু জাহাজ দিতে। বিসিবি এলাকায় কখনো বা এক থেকে দুটি জাহাজ বার্থ পাচ্ছে। এগুলো মোটেও পর্যাপ্ত নয়। বিষয়টি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক এ প্রসঙ্গে বলেন, আমদানির পণ্যবোঝাই জাহাজ কমেছে। বার্থ অপারেটর এবং শিপ হ্যান্ডলিং ও টার্মিনাল অপারেটরদের পক্ষ থেকে বিষয়টি বন্দর কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। সার্বিক দিক বিবেচনা করে পরিচালনা বোর্ড এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। প্রসঙ্গক্রমে তিনি জানান, জিসিবিতে গিয়ার্ড (ক্রেনযুক্ত) জাহাজ হ্যান্ডলিং হয়ে থাকে। সেখানে ইচ্ছে করলেই গিয়ারলেস (ক্রেনহীন) জাহাজ দেওয়া যাবে না। ক্ষতিগ্রস্তদের বিষয়টি বিবেচনার মত হলে নিয়মের মধ্যে যা কিছু করা সম্ভব তা বোর্ডই করবে। এ বিষয়ে আগাম কিছু বলা যাবে না।
প্রসঙ্গত চট্টগ্রাম বন্দরে ২০২২ সালে জাহাজ এসেছিল ৪ হাজার ৩৬১টি, যা আগের বছরের চেয়ে বেশি। ২০২১ সালের জাহাজ এসেছিল ৪ হাজার ২০৯টি। কন্টেনার হ্যান্ডলিং ২০২২ সালে হয়েছে ৩১ লাখ ৪২ হাজার ৫০৪ টিইইউএস। এ বছর কার্গো হ্যান্ডলিং হয় ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৬৫ হাজার ৬৮২ টন। কিন্তু সমাপ্ত বছরের শেষ দুমাস থেকে শুরু হয় আমদানিতে মন্দাভাব। বছরের প্রথম দুমাসে জাহাজ ও পণ্য আমদানিতে যে ঋণাত্মক সূচক তাতে ভেসেল আগমন আরও কমে আসবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
অলস ভাসছে ৮০০ লাইটার জাহাজ ॥ মাদারভেলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অভ্যন্তরীণ জলপথে চলাচলকারী লাইটার ভেসেলগুলো। কারণ বহির্নোঙ্গরে বড় জাহাজ থেকে পণ্য খালাস করে তা গন্তব্যে পরিবাহিত হয়ে থাকে লাইটার জাহাজগুলোর মাধ্যমে। আমদানি কমে যাওয়ায় কাজ কমে গেছে লাইটার জাহাজের। এখন প্রায় অর্ধেক জাহাজের কোনো কাজ নেই। এ অবস্থায় জাহাজে কর্মরত শ্রমিকদের বেতন মজুরি পরিশোধ কঠিন হয়ে পড়েছে। জাহাজ মালিকরা সরকার ঘোষিত ৬০ শতাংশ মজুরি বৃদ্ধির গেজেট বাতিলের দাবি জানাতে পারেন বলে আভাস মিলেছে। এ ব্যাপারে সচিবালয়ে একটি বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। সন্তোষজনক সুরাহা না হলে আগামী ১০ মার্চ থেকে অভ্যন্তরীণ জলপথে পণ্য পরিবহন বন্ধ ঘোষণা আসতে পারে বলে জানিয়েছেন একাধিক জাহাজ মালিক।
অভ্যন্তরীণ জলপথে জাহাজ চলাচল নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ডব্লিউটিসির নির্বাহী পরিচালক মাহবুব রশিদ বৃহস্পতিবার জনকন্ঠকে জানান, চট্টগ্রাম বন্দরকেন্দ্রিক প্রায় দুই হাজার লাইটার জাহাজ রয়েছে। এ জাহাজগুলো মাদার ভেসেল থেকে পণ্য লাইটারিংয়ের পর বিভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছে দিয়ে থাকে। কিন্তু কাজ না থাকায় প্রায় ৮শ’ জাহাজ এখন কর্মহীন। তিনি জানান, প্রতিদিন যেখানে ৭০-৮০টি জাহাজের বুকিং হয় সেখানে এখন হচ্ছে ২০-২৫টি। এ অবস্থা চলতে থাকলে মালিকদের পক্ষে জাহাজ পরিচালনা কঠিন হয়ে যাবে।
অনিশ্চয়তায় সংকট উত্তরণ ॥ বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েসনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বলেন, শিপিং সেক্টরে এখন খুবই মন্দা চলছে। আমদানি কমে গেছে। এর ফলে ব্যস্ততাও আগের মতো নেই। অনেক জাহাজ ভাড়া পাচ্ছে না। এর মধ্যে আবার সরকারি আমদানির পণ্যের ৫০ শতাংশ দেশী জাহাজে পরিবহনের একটি বাধ্যবাধকতা হয়েছে। এমনিতেই আমদানি কম।
তার ওপর যদি এই আদেশ কার্যকর হয় তাহলে বিদেশী জাহাজগুলোর আগমন এমনিতেই কমে যাবে। দীর্ঘ সময় চলতে থাকলে একপর্যায়ে তারা চট্টগ্রাম বন্দর রুটের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে। তিনি আরও জানান, আমদানি কমে যাওয়ায় অনেক শিপিং এজেন্ট তাদের ব্যবসা কমিয়ে নিচ্ছে, অনেকে আবার এ ব্যবসা থেকে অন্যদিকে শিফট করছেন। এটি ভবিষ্যতের জন্য সুখকর নয়। কারণ, আন্তর্জাতিক কারণে সৃষ্ট নানা প্রতিকূলতা কেটে গেলে বিশ^ বাণিজ্য পরিস্থিতি আবারও আগের জায়গায় ফিরতে পারে। সংকটের উত্তরণ কীভাবে সম্ভব এ প্রশ্নের জবাবে শিপিং সেক্টরের এ নেতা বলেন, এর ওপর আসলে কারও হাত নেই। এখন যুদ্ধ পরিস্থিতি কাটিয়ে স্বাভাবিক হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষায় না থেকে উপায় নেই।