ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধদিনের স্মৃতি 

ফুলতলা বাগানের কাছে যুদ্ধে এক পাকসেনা অস্ত্রসহ ধরা পড়ে

শংকর পাল চৌধুরী, মাধবপুর, হবিগঞ্জ

প্রকাশিত: ২৩:৪০, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

ফুলতলা বাগানের কাছে যুদ্ধে এক পাকসেনা অস্ত্রসহ ধরা পড়ে

মনির উদ্দিন খান

দেশমাতৃকার টানে ১৯৭১ সালে  মুক্তিবাহিনীর সদস্য হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন ১৮ বছরের তরুণ মনির উদ্দিন খান। এই দামাল ছেলে সরাসরি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। মাধবপুরের শাহজাহানপুর ইউনিয়নের শাহজাহানপুর গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মনির উদ্দিন খান এখন স্ট্রোক করে অনেকটা অসুস্থ। নানা রোগ-ব্যাধি তার শরীরে বাসা বেঁধেছে।
’৭১-এর এই তরুণ মুক্তিযোদ্ধা বৃদ্ধ বয়সে যুদ্ধের সেই স্মৃতি স্মরণ করতে গিয়ে তার চোখ অশ্রুসজল হয়ে পড়ে। তিনি যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় যুবক ছিলাম। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে ধমনীতে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার প্রেরণা সৃষ্টি হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ৪ এপ্রিল মাধবপুরের তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ব্যবস্থাপকের বাংলোতে স্বাধীনতা যুদ্ধের বৈঠক হয়।

সেই বৈঠকে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মাওলানা আছাদ আলী ও দেওয়ান আশ্রব আলীর হাত ধরে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার শপথ নেই। এর পরদিন ৫ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের উদ্দেশে বাবা সিরাজ উদ্দিন, মা নূরজাহান ও পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে ভারতের সিমনাছড়া শরণার্থী শিবিরে চলে যাই। সিমনাছড়ার সুন্দর টিলায় গিয়ে কেএম শফিউল্লাহ, ক্যাপ্টেন মতিনের সঙ্গে দেখা হয়। তারা তাকে খোয়াই সিঙ্গীছড়া প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে বিভিন্ন অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দেন। কিছুদিন এখানে প্রশিক্ষণের পর আমি ও আমার সহযোগী মুক্তিযোদ্ধারা অসমের লোহারবন্দ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যাই।

সেখানে কর্নেল বাচকির অধীনে ২১ দিন প্রশিক্ষণ নেই। এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে থ্রিনটথ্রি রাইফেলস, স্টেনগান, এসএলআর, এলএমজি, দুই ইঞ্চি মর্টার, গ্রেনেড, মাইন, ডিনামাইটসহ বিভিন্ন অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নেই। ২১ দিন প্রশিক্ষণের পর ৪০ জনের একটি গ্রুপসহ আমাকে অসমের রানী বাড়ি আমটিলা ৪নং সেক্টরে পাঠানো হয়। সেখানে ক্যাম্প ইনচার্জ ছিলেন ক্যাপ্টেন এনামুল হক। ৪নং সেক্টরের সদর দপ্তর ছিল অসমের করিমগঞ্জ, পরে মাসিমপুর। সিলেট জেলার পূর্বাঞ্চল এবং খোয়াই শায়েস্তাগঞ্জ পূর্ব ও উত্তর দিকে সিলেট ডাউকি সড়ক পর্যন্ত ৪নং সেক্টরের অধীনে ছিল।

৪নং সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর সিআর দত্ত। ফুলতলা রানী বাড়ি আমটিলা থেকে গ্রুপ কমান্ডার সুধারঞ্জন দাসের অধীনে সিলেট, ফুলতলা ও কমলগঞ্জ এলাকায় বিভিন্ন জায়গায় পাঞ্জাবী বাহিনীর সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ হয়। কমলগঞ্জ ফুলতলা বাগানের কাছে পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে অনেক পাকিস্তানি সৈন্যকে কতল করা হয়েছে। একজন পাকসেনাকে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্রসহ ধরে ফেলেছিল। পরে তাকে ক্যাপ্টেন এনামুলের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। তার কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের অনেক গোপন তথ্য আদায় করে, যা যুদ্ধের জন্য খুব কাজে লেগেছে।

 ৪নং সেক্টরে এই গ্রুপ অনেক সাহসিকতার পরিচয় দেওয়ায় এই গ্রুপকে পরে কেএম শফিউল্লাহর অধীনে ৩নং সেক্টরে সিঙ্গীছড়া ক্যাম্পে পাঠানো হয়। সিঙ্গীছড়া ক্যাম্পের ইনচার্জ ছিলেন ক্যাপ্টেন এজাজ আহমেদ চৌধুরী। পরে এই ক্যাম্পের অধীনে গ্রুপ কমান্ডার সুধারঞ্জন দাস, শহীদ তরবদার ও মুক্তিযোদ্ধা হাওলাদারসহ চুনারুঘাটের রাজার বাজার, মিরাশী, আমরোডসহ বিভিন্ন জায়গায় পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধ শেষে সোনার বাংলার চূড়ান্ত বিজয় হলে হবিগঞ্জে ক্যাপ্টেন এজাজ আহম্মদ চৌধুরীর কাছে আমাদের অস্ত্র  জমা দেওয়া হয়।

×