ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বরিশাল-৩

আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী দাবি পুনরুদ্ধার চায় বিএনপি

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল

প্রকাশিত: ০০:১৭, ২৯ জানুয়ারি ২০২৩

আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী দাবি পুনরুদ্ধার চায় বিএনপি

আড়িয়াল খাঁ নদে বিচ্ছিন্ন জেলার বাবুগঞ্জ ও মুলাদী উপজেলা

আড়িয়াল খাঁ নদে বিচ্ছিন্ন জেলার বাবুগঞ্জ ও মুলাদী উপজেলা। এই দুই উপজেলাকে ঘিরে বরিশাল-৩ আসন। আসনটিতে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থান শক্তিশালী হলেও জোট-মহাজোটের হিসাবের অঙ্ক থেকে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে এই আসনে জয়ী হন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য গোলাম কিবরিয়া টিপু। এখানে বিএনপির শক্ত অবস্থান রয়েছে। আসনটি পুনরুদ্ধার করতে চায় তারা। 
দুই লাখ ৫৩ হাজার ৪১৪ জন ভোটারের এ আসনের বাবুগঞ্জ উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। এছাড়াও বাবুগঞ্জে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননেরও পিতৃভূমি। তার বাবা বিচারপতি আব্দুল জব্বার খান ছিলেন পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের স্পিকার। আবার কেন্দ্রীয় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান, বিএনপির প্রভাবশালী নেতা মোশাররফ হোসেন মঞ্জু ও অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীনের বাড়িও এ আসনে। ফলে এখানে বিএনপির অবস্থানও বেশ শক্তপোক্ত বলা চলে। তবে অতীতের ন্যায় এ আসনটিতে মনোনয়নপ্রত্যাশীর তালিকায় বিএনপির একাধিক নেতার নাম রয়েছে। এসব নেতার অনুসায়ীরা কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ায় দীর্ঘদিন এ আসনে বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম বিরোধ রয়েছে। তবে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি তাদের হারানো এ আসনটি পুনরুদ্ধার করতে মরিয়া।
অপরদিকে টানা তৃতীয় মেয়াদে দল ক্ষমতায় থাকায় এ আসনে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থান বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। তাই এবার আর মহাজোটের শরিক দলকে নয়; ভোটের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী দেওয়ার জন্য দলের সভাপতি শেখ হাসিনার কাছে জোর দাবি করেছেন এ আসনের আওয়ামী লীগ ও তার সকল সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। 
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৮ সালের নির্বাচনে এ আসনটি মহাজোটের শরিক দল জাতীয় পার্টি ও ২০১৪ সালে ১৪ দলীয় জোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টিকে ছেড়ে দেওয়া হয়। আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা বছরের পর বছর ধরে এলাকায় নানান উন্নয়ন কর্মকা- পরিচালনার পাশাপাশি সাংগঠনিকভাবেও বেশ সক্রিয় ভূমিকা রেখে চলেছেন।
সূত্রমতে, ২০০৮ সালের নির্বাচনে সীমানা পুনর্নির্ধারণের কারণে বাবুগঞ্জের সঙ্গে মুলাদী যুক্ত হয়ে বরিশাল-৩ আসন গঠিত হয়। এর আগে উজিরপুর ও বাবুগঞ্জ উপজেলা নিয়ে ছিল আলাদা আসন।

তখন মুলাদী ছিল বরিশাল-৩ আসনে এবং বাবুগঞ্জ ছিল-২ আসনে। সেই হিসেবে ১৯৯১ সাল থেকে বরিশাল-৩ আসনে একটানা তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন বিএনপি নেতা মোশাররফ হোসেন মঞ্জু। আবার ১৯৯১ সালে বরিশাল-২ আসন অর্থাৎ উজিরপুর-বাবুগঞ্জ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচন হন রাশেদ খান মেনন। যদিও এরপরের নির্বাচনে সেখানে বিএনপির প্রার্থী সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ও পরের বার জাতীয় পার্টির গোলাম ফারুক অভি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

তবে সীমানা পুনর্নির্ধারণের পর জোট শরিকদের আসনে পরিণত বরিশাল-৩ আসনে ২০০৮ সালে বাবুগঞ্জের সন্তান ও জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য গোলাম কিবরিয়া টিপু সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যদিয়ে জাতীয় পার্টির প্রার্থী গোলাম কিবরিয়া টিপুকে হারিয়ে জয়লাভ করেন বরিশাল জেলা ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক শেখ মো. টিপু সুলতান।
আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দীর্ঘ দিন থেকে এলাকায় নানা উন্নয়ন কর্মকা-, রাজনীতি ও বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের মাধ্যমে ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ নেতা আতিকুর রহমান আতিক আলাদা ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছেন।

দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মী থেকে শুরু করে নেতৃত্বস্থানীয় নেতৃবৃন্দের জোর দাবির প্রেক্ষিতে বরিশাল-৩ আসন থেকে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে আতিকুর রহমান আতিক বিগত কয়েক বছর ধরে এ আসনের সাধারণ মানুষের সেবায় ও উন্নয়নে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। নির্বাচনী এলাকার ভোটারদের দ্বারে দ্বারে আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়ন চিত্র তুলে ধরে তিনি নিয়মিত গণসংযোগ অব্যাহত রেখেছেন।

এ আসনে আওয়ামী লীগের অপর মনোনয়নপ্রত্যাশী যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহ-সম্পাদক মো. মিজানুর রহমান বলেন, দলের নেতাকর্মীদের জোরালো দাবির মুখে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আসন হিসেবে বরিশাল-৩ আসনটি দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে উপহার দিতে দীর্ঘদিন থেকে মাঠে কাজ করে আসছি। এ আসনের অপর মনোনয়নপ্রত্যাশী ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় নিহত যুবলীগ নেতা শহীদ মোশতাক আহমেদ সেন্টুর ভাই মোস্তাফিজুর রহমান নিলু।
এদিকে অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে বরিশাল-৩ আসন এখন আওয়ামী লীগের দুর্গ দাবি করে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট তালুকদার মো. ইউনুস জনকণ্ঠকে বলেন, নির্বাচনে কেন্দ্রীয়ভাবে যে সিদ্ধান্ত আসবে সেই অনুযায়ী নেতাকর্মীরা কাজ করবে। 
বরিশাল-৩ আসনের ওয়ার্কার্স পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট শেখ মো. টিপু সুলতান বলেন, দলীয় সবক্ষেত্রে আমার নেতা রাশেদ খান মেননের সিদ্ধান্তই মুখ্য। তিনি যদি মনে করেন আমাকে পুনরায় দলের মনোনয়ন দেবেন তাহলে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হবো।
সূত্রমতে, বরিশাল-৩ আসনে জাতীয় পার্টির (এরশাদ) মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও বর্তমান সংসদ সদস্য গোলাম কিবরিয়া টিপু এবং জাতীয় যুব সংহতির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক শাহাজাদা মুন্সী।

অপরদিকে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীদের তালিকায় রয়েছেন-বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন, অপর ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান, সাবেক সংসদ সদস্য মোশাররফ হোসেন মঞ্জুু ও বিএনপির প্রভাবশালী নেতা আব্দুস ছত্তার খান। 
কর্মী বান্ধব নেতা জেলা উত্তর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও মুলাদী পৌরসভার প্রথম নির্বাচিত মেয়র এবং মুলাদী উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুস ছত্তার খান জনকণ্ঠকে বলেন, বর্তমান সরকারের হাত থেকে দেশের মানুষকে বাঁচাতে হলে সরকারের পতন ছাড়া বিকল্প নেই। এই আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। আমাদের সবাইকে এক সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। 
বিএনপি দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ সালের নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নকে ঘিরে সেলিমা রহমান ও অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীনের মধ্যে সৃষ্ট চরম বিরোধ এখনও চলমান রয়েছে। এর মধ্যে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের প্রাথমিক মনোনয়নের চিঠি পেয়েছিলেন সেলিমা রহমান ও অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন। শেষ পর্যন্ত দলের নির্দেশে চূড়ান্ত প্রার্থী ছিলেন অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন। নির্বাচনে পরাজয়ের পর থেকে নির্বাচনী এলাকায় অনুপস্থিত রয়েছেন অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন।
বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের দাবি, নেতা এলাকায় থাকলে কর্মীরা সাহস পান, জনগণ তাদের কষ্টের কথা বলতে পারেন। কিন্তু তাদের ভাগ্যে সেটি জুটছেনা। তবে অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, প্রতিমাসে ঢাকা ও বরিশালে আসা-যাওয়ার মধ্যে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত রয়েছি। বরিশাল-৩ আসন সর্বদাই বিএনপি সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী। জনগণ বিএনপির প্রার্থীকেই ভোট দেবে। তবে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হতে হবে।

আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করলে হারানো আসন পুনরুদ্ধারে বিএনপির নেতাকর্মীরা সবাই ঐক্যবদ্ধ আছেন। এ আসনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ বরিশাল জেলার সেক্রেটারি উপাধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মাদ সিরাজুল ইসলাম এবারও প্রার্থী হবেন।
সমীকরণে দেখা গেছে, জোট শরিকদের আসনে পরিণত বরিশাল-৩ আসন থেকে ২০০৮ সালে নির্বাচিত হন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য গোলাম কিবরিয়া টিপু। ২০১৪ সালে তাকে হারিয়ে আসনটি দখলে নেয় ওয়ার্কার্স পার্টি। নির্বাচনী পরিসংখ্যান মতে, ১৯৯১, ৯৬ এবং ২০০১ সালের নির্বাচনে টানা তিনবার বরিশাল-৩ আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন বিএনপির প্রার্থী মোশাররফ হোসেন মঞ্জুু।

তবে ২০০৮ সালে এই আসনে বিএনপির প্রার্থী সেলিমা রহমানকে পরাজিত করে এমপি নির্বাচিত হন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য গোলাম কিবরিয়া টিপু। ২০১৪ সালে তাকে হারিয়ে এমপি নির্বাচিত হন ওয়ার্কার্স পার্টির জেলা সাধারণ সম্পাদক শেখ মো. টিপু সুলতান।
জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্যমতে, একটি পৌরসভা, দুটি উপজেলার ১৩ ইউনিয়ন নিয়ে ৪৩১ দশমিক ৬২ বর্গ কিলোমিটারের বরিশাল-৩ আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ২ লাখ ৫৩ হাজার ৪১৪ জন। যারমধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ২৬ হাজার ৯৯৭ জন এবং নারী ভোটার ১ লাখ ২৬ হাজার ৪১৭ জন। ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ চলমান থাকায় ভোটার সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেতে পারে।

×