ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

জীবিত ফিরে আসবেন, ভাবেননি মান্নান

যুদ্ধদিনের স্মৃতি

গিয়াস উদ্দিন ফরহাদ, নোয়াখালী

প্রকাশিত: ২৩:২৩, ২১ ডিসেম্বর ২০২২

যুদ্ধদিনের স্মৃতি

মান্নান

একাত্তরের ২৬ মার্চ পাক হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর অতর্কিত ঝাঁপিয়ে পড়লে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে সহপাঠী মো. শাহজাহানকে নিয়ে ভারতে চলে যান ছাত্রনেতা আব্দুল মান্নান। আবদুল মান্নান নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার চৌমুহনী শহরের করিমপুর গ্রামের বাসিন্দা। তৎকালীন চৌমুহনী কলেজের প্রাক্তন ছাত্র, ছাত্রলীগ কলেজ শাখার সভাপতি এবং জেলা সদর মহকুমার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি।

বাংলার মাটি ও মানুষের প্রতি গভীর মমত্ববোধ তাঁকে ভারতে যেতে বাধ্য করে। ভারতে পৌঁছে প্রথমে দেরাদুন এবং পরে উত্তর প্রদেশের টান্ডুয়ায় কর্নেল পুরাকায়স্থ ও মেজর মালহোত্রার অধীনে সামরিক প্রশিক্ষণ নেন। নিঃস্বার্থ, সৎ ও সাহসী মানুষটি আলাপচারিতায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করছিলেন। তিনি বলেন, দেশমাতৃকার দুর্দিনে যেদিন অস্ত্র হাতে নিয়েছিলাম সেদিন ভাবিনি জীবিত ফিরে আসব। নানা বিপদসঙ্কুল অবস্থার মধ্যে নয়টি মাস কেটেছিল। নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের তাল মাহমুদের হাটের দুঃসহ স্মৃতি আজও আমাকে পীড়া দেয়।

পাক বাহিনীকে প্রতিরোধকল্পে বৃহত্তর নোয়াখালীর বিভিন্ন উপজেলা থেকে মুক্তিযোদ্ধাগণ তাল মাহমুদের হাটের আশেপাশে জড়ো হতে থাকেন। বেগমগঞ্জ উপজেলা থেকে আমি আমার বাহিনী নিয়ে যাবার প্রস্তুতি নেই। কিন্তু আমার সহকমান্ডার ছালেহ আহমদ মজুমদার আমাকে বললেন, ভাই আপনি বেগমগঞ্জে থাকেন। আমাকে দায়িত্ব দেন আমি বাহিনী নিয়ে তাল মাহমুদের হাটে যাব।
অনেক বুঝিয়েও তাঁকে বিরত করা যায়নি। তিনি বাহিনী নিয়ে তাল মাহমুদের হাটে রওয়ানা দেন। রাতের আঁধারে তাঁরা তাল মাহমুদের হাটের কাছাকাছি পৌঁছে পাক হানাদার বাহিনীর মুখোমুখি হন। শুরু হয় গোলাগুলি। এতে মুক্তিসেনা ছালেহ আহমেদ মজুমদার, আমান উল্লাহ ফারুক, আক্তারুজ্জামান রাতু ও আবদুর রবসহ মোট ছয়জন শহীদ হন। সেই ভয়ংকর স্মৃতি আজও আমাকে পীড়া দেয়।

স্বাধীনতার পর বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ছালেহ আহমেদের নামে নোয়াখালীর প্রাচীনতম উচ্চশিক্ষার বিদ্যাপীঠ চৌমুহনী কলেজটিকে চৌমুহনী ছালেহ আহমেদ (এস এ) কলেজ নামকরণ করা হয়।
উল্লেখ্য, যুদ্ধ চলাকালীন বৃহত্তর নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের মুক্তি বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এমপি।
এরপর রাজনীতিবিদ শহীদ ইস্কান্দার কচির ছোট ভাই ভুলুর নৃশংস হত্যাকান্ডের করুণ কাহিনি তুলে ধরেন তিনি। পাক বাহিনী ভুলুকে নির্মমভাবে হত্যা করে ক্যাপ্টেন নাগকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। আমি খবর পেয়ে দ্রুত আমার বাহিনী নিয়ে ফরিদপুর পৌঁছে জানলাম পাক বাহিনী ইতোমধ্যে পালিয়ে গেছে।
সবশেষে তিনি এক কালরাত্রির স্মৃতিচারণ করলেন। তিনি বলেন, তীব্র বর্ষার সময় চারদিকে থৈ থৈ পানি। গভীর রাত। রাতের নিকষ কালো অন্ধকার। আমি মো. শাহজাহান এবং নূরনবীসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আমিশা পাড়া যাচ্ছিলাম। আমরা আফানিয়া ব্রিজ অতিক্রম করামাত্র এসে পড়ে পাক আর্মির একটি জীপ। পাক আর্মি আমাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকে। রাতের আঁধারে আমরা পজিশন নিয়ে গুলি ছুড়তে থাকি। বেশ কিছুক্ষণ গোলাগুলি চলে। একপর্যায়ে পাক বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। আমরা অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেলাম।
যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে বেগমগঞ্জকে শত্রুমুক্ত করার লক্ষ্যে আমার বাহিনীকে নিয়ে চৌমুহনী বাজার ঘিরে ফেলি। আমি নরোত্তমপুর হয়ে কলেজ রোড দিয়ে চৌমুহনী বাজারে প্রবেশ করি। প্রচ- গোলাগুলির পর আমরা অতি অল্প সময়ে চৌমুহনী বাজারকে শত্রুমুক্ত করতে সক্ষম হই।
তিনি বলেন, মানব জীবন ক্ষণস্থায়ী। চলে যাব একদিন এ পৃথিবীর মায়া ছেড়ে। আমার জীবনে পরম সান্ত¦না আমি জীবনকে বাজি রেখে এ দেশের মাটি এবং মানুষের জন্য এ দুটি হাতে অস্ত্র ধরতে পেরেছিলাম। কী পেয়েছি কী পাইনি কখনো ভেবে দেখিনি। পৃথিবীর মানচিত্রে যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন এ দেশের মাটি আর মানুষের মাঝে বেঁচে থাকব-এটাই তো আমার জীবনের পরম পাওয়া।

×