ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধদিনের স্মৃতি

কামান্নায় ২৭ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন

সঞ্জয় রায় চৌধুরী, মাগুরা

প্রকাশিত: ২৩:১৮, ২০ ডিসেম্বর ২০২২

কামান্নায় ২৭ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন

এস এম আব্দুর রহমান

হাতেগোনা যে কয়জন মুক্তিযুদ্ধকালীন গেরিলা কমান্ডার জীবিত রয়েছেন তাদের মধ্যে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এস এম আব্দুর রহমান। তিনি ছিলেন মাগুরা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার।  তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে আইএসসি পড়া অবস্থায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর ছাত্র ও স্বাধীনতাকামী মানুষদের প্রস্তুত করতে শুরু করি। বাঁশের লাঠি দিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু হয়। মাগুরা সদর উপজেলার হাজীপুর গ্রামের ৪০ জনই ছিল ছাত্র।

১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে রাজাকার আলবদর বাহিনী সৃষ্টি হয়। মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাকামীদের ধরে ধরে নিয়ে হত্যা করতে শুরু করে। আমরা ১৪ জন ভারতে প্রশিক্ষণের জন্য যাই। আমরা ভারতের বিহারের চাকুলিয়া প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে ৩২ দিনের প্রশিক্ষণ শেষে অস্ত্র গুলি নিয়ে আমিসহ ১০ জন গেরিলা বাংলাদেশে প্রবেশ করি। প্রবেশ করার সময় বয়রা ক্যাম্পে যারা পাকিস্তানি আর্মি ছিল তারা আক্রমণ করে। আমরা, ইপিআর, মুক্তিযোদ্ধারা বাজারে এমবুশ করি। প্রচ- যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।

এই স্থানে ভারতীয় মিত্র বাহিনী মর্টার ফায়ার করে আমাদের সহায়তা দিয়েছিল। তিনজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। তাদের লাশ নেওয়ার জন্য পাকিস্তানিরা দুপুর ১২টা পর্যন্ত যুদ্ধ করেছিল। দুপুর  পর্যন্ত যুদ্ধে একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়েছিল। মাগুরা এলাকায় তিনটি গেরিলা বাহিনী প্রবেশ করে। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন বিএম তকব্বর, অমি এস এম আব্দুর রহমান ও অধির কুমার শিকদার।  দেশের মধ্যে বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি।

এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মাগুরা সদর উপজেলার জাগলা, রাউতড়া খালের যুদ্ধ ও হাজীপুর গ্রামের বেলে মঠের যুদ্ধ। ১৯৭১ সালে নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে ধনেশ্বরগাতি গর্জদুর্বা গ্রামে ২০ জন মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান করেন। কমান্ডার ছিলেন জহুর-ই-আলম। মাগুরা সদর উপজেলার জাগলা রাজাকার ও রেঞ্জার ক্যাম্প আক্রমণ করতে গেরিলা বাহিনীর দুটি দল আগের রাতে একটি বাড়িতে অবস্থান করে। দিনে রেকি করে সন্ধ্যার পর আক্রমণ করবে।

রাজাকাররা রেঞ্জাররা কোনো প্রতিরোধ না করে গর্তে বাংকারে ঢুকে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারা ফায়ার করে রাজাকার রেঞ্জারদের না পেয়ে ফিরে আসে। ২৩ নভেম্বর মাগুরার সদর উপজেলার হাজীপুর রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণের জন্য হাজীপুর আঞ্চলিক বাহিনী, মুজিব বাহিনী, গেরিলা বাহিনী একত্রিত হয় লক্ষ্মীকোল গ্রামে। আঞ্চলিক বাহিনীর কমান্ডার মো. সমশের আলীর নেতৃত্বে সিদ্ধান্ত হয় ক্যাম্পের ডিউটির দায়িত্বে থাকবে গেরিলা কমান্ডার এস এম আব্দুর রহমান ও আবদুর রশিদ। সে মোতাবেক দায়িত্ব পালন করা শুরু করি।

২৪ নভেম্বর কোনো কারণবশত হাজীপুর রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করতে না পারায় নিরাপদ স্থান কামান্নায় যাই। একটি টিনের ঘরে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান করেন। আমাদের আগমনের খবর রাজাকাররা পাকিস্তানিদের দিলে ঝিনাইদহ থেকে পাকিস্তানি বাহিনী শৈলকুপা হয়ে ফাদিলপুর বাজারে তিনদিক থেকে ঘেরাও করে। তখন ক্যাম্পের তিনদিকে ডিউটি ছিল। ভোর হয়ে যাওয়ায় ডিউটি তুলে তারা ঘরের ভিতরে চলে আসে। সকাল হয়ে যাওয়ায় ডিউটি না থাকায় মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। পাকিস্তানিদের গুলিতে সেখানে ২৭ বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। আহত আমিসহ তিনজন। দেশের মধ্যে সব থেকে বেশি মুক্তিযোদ্ধা একসঙ্গে শহীদ হয়েছিলেন কামান্নায়। আমি ৫১ বছর যাবৎ সেই গুলি শরীরে বহন করছি। ১৯৭১ সালে ৬ ডিসেম্বর ভারত সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। ৭ ডিসেম্বর মাগুরা পাক হানাদার মুক্ত হয়। মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর আক্রমণে পাক সেনারা ফরিদপুরের দিকে পালিয়ে গেলে মাগুরায় উড়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। জয় বাংলা শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে মাগুরা।

×