ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দশানীর শারদোৎসব

-

প্রকাশিত: ০১:১৬, ১ অক্টোবর ২০২২

দশানীর শারদোৎসব

বাগেরহাট : ৮৯ বছরের শারদ উৎসবে অঞ্জলি দিচ্ছেন ভক্তরা

নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। বর্ষণসিক্ত শ্যামল প্রকৃতির বুকে বাতাসে দুলছে কাশফুল। এর মধ্যে মহালয়ার মন্ত্রধ্বনিতে এক অপূর্ব মূর্ছনায় এবার গজে (হাতি) আসছেন মা দুর্গা। অসুরবিনাশী দেবী দুর্গা। তাই শান্তি ও কল্যাণের অমিয় ধারায় প্রবাহিত আগমনী গান, শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি, চন্ডিপাঠ আর মনোমুগ্ধকর সাজসজ্জায় শারদ উৎসবের বাদ্য বাজছে বাগেরহাটের ৮৯ বছরের ঐতিহ্যবাহী দশানী সার্বজনীন পূজা মন্দিরে।

মোহনীয় এক অব্যক্ত অনির্বচনীয় আনন্দঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে এখানে। শিশু থেকে বৃদ্ধ নারী-পুরুষ নির্বিশেষে রং-বেরঙের বাহারী পোশাকে দলে দলে আসছেন মানুষ। কেবল সনাতন ধর্মাবলম্বী নয়, অপরাপর ধর্মের লোকজন রয়েছেন সে দলে। আসলে এটা বাঙালীর সনাতনী উৎসব যে। যা দশানী গ্রামের সম্প্রীতির শত বছরের ঐতিহ্য।
বাগেরহাটে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ঐতিহ্যবাহী জনপদ দশানী। আয়োজনে, আনন্দে, বিনোদনে, আতিথেয়তা আর আড়ম্বরে দশানী গ্রামের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। দেশভাগের আগ পর্যন্ত দশানী গ্রাম ছিল প্রায় শতভাগ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বাসস্থান। তখন এখানে বারোয়ারী পূজা হতো না। গ্রামের পাড়ায় পৃথক দুর্গাপূজা হতো। পশ্চিম পাড়ায় হালদার বাড়ির নাটমন্দিরে, উত্তরপাড়ায় বিশ্বাস জমিদারদের মন্দিরে, মধ্যপাড়ায় দাস বাড়ির মন্দিরে পূর্ব পাড়ায় হালদার ও দে বাড়ির মন্দিরে এমনকি ব্যক্তিগত উদ্যোগেও শারদীয় দুর্গাপূজা হতো। প্রায় সারা বছরই এ গ্রাম পূজা-পার্বণে উৎসবের ধারা বইত।
ব্রিটিশ ভারতের শেষ প্রান্তে বাংলায় যে রেনেসাঁর জন্ম হয়েছিল তার প্রভাবে দশানী গ্রামের যুব সমাজও প্রভাবিত হয়। তারা স্থানীয় বিদ্যোৎসাহী বিশ্বাস জমিদারদের আনুকূল্যে গড়ে তোলেন স্কুল, পাঠাগার, ক্লাব, মন্দিরসহ নানা সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। একপর্যায়ে তারা উপলব্ধি করেন- একটি সার্বজনীন বারোয়ারী মন্দিরের।

যার অগ্রভাগে ছিলেন বাগেরহাট বারের প্রখ্যাত আইনজীবী বিনোদ বিহারী সেন, রাজেন্দ্রনাথ দত্ত, মনীন্দ্রনাথ হালদার, মতিলাল সোম, নিশিকান্ত দাস, গোপাল চন্দ্র দাস, কালিচরণ দে, সতীশ চন্দ্র সেন, কৃষ্ণপদ সোম, সুশীল কুমার হালদার, বাবু বেনীমাধব দে, বড়মোনা দাস, নাগেন্দ্রনাথ পাল, দুর্গাচরণ সোম, যতীন্দ্রনাথ দাস আরও অনেকে। জমি দিতে এগিয়ে আসেন বাবু নগেন্দ্রনাথ দে, বেণীমাধব দে ও বড়মনা দাস।

১৯৩২ সালে স্থাপিত হয় দশানী বারোয়ারী দুর্গাপূজা মন্দির। পরের বছর টীনের ছাউনি দিয়ে তৈরি হয় নাট মন্দির। সেই থেকে আজ পর্যন্ত এখানে শারদীয় দুর্গাপূজা হয়ে আসছে। কেবল ’৭১ সালে পাকিস্তানীদের বর্বরতার কারণে পূজা হতে পারেনি। আর ২০০১ সালে সংখ্যালঘু নিপীড়নের প্রতিবাদে ঘট-পূজা হয়।
এখন দশানী সার্বজনীন পূজা মন্দিরে রয়েছে সুবিশাল পাকা মোজাইক করা ও ঝাড়বাতি যুক্ত নাটমন্দির, পাঠশালা, অফিস কক্ষ, লাইব্রেরী, রন্ধনশালা ও আধুনিক শৌচাগার। সর্বাধুনিক স্থাপত্য শৈলী ও নকশায় এ বছর মন্দিরের প্রবেশমুখে সুবিশাল তোরণ নির্মাণ করা হয়েছে। এখানে দুর্গা মন্দিরের পাশাপাশি শ্রী শ্রী কালি মন্দির ও গোবিন্দ মন্দির রয়েছে।

প্রতি অমাবস্যায় কালিপূজা এবং প্রতি শুক্রবারে মহাসমারোহে গোবিন্দ পূজা হয়। পুরো বারোমাস জুড়ে চলে নামকীর্তন ও প্রসাদ বিতরণ। গোটা বৈশাখ মাসে প্রতিদিন নামসংকীর্তন ও খিচুড়ি/লুচি-ডাল পান ভক্তবৃন্দ। গ্রামবাসী পালাক্রমে এ আয়োজন করেন।    মন্দিরের আয় বর্ধনের জন্য রয়েছে নানা কর্মসূচী। মন্দির পরিচালনার জন্য রয়েছে উপদেষ্টাম-লী ও মূল মন্দির কমিটি আর একগুচ্ছ নিবেদিতপ্রাণ তরুণ। শত বাধা ডিঙ্গিয়ে হাসিমুখে সবাই মিলে যেকোন অসাধ্য কাজ অনায়াসে সম্পন্ন করেন।

প্রত্যেকটি পূজার পরিচালনার জন্য রয়েছে পৃথক কমিটি। মূল মন্দির কমিটির বর্তমান সভাপতি অধ্যাপক কৃষ্ণপদ পাল এবং সম্পাদক বাবু মোহনলাল হালদার। এ বছরে দুর্গাপূজা কমিটির সভাপতি প্রদীপ বসু সন্তু ও সুমন দাস জানান, ঐতিহ্যবাহী এ মন্দিরটি শুধু হিন্দুদের জন্যই নয় সর্বধর্মীয় মানুষের জন্য অবারিত। এখানে প্রতিবেশী মুসলমানরাও সহযোগিতা করেন। আমরা মিলেমিশে উৎসবের আনন্দ উপভোগ করি। প্রতি শারদোৎসবে এখানে লক্ষাধিক ভক্ত-দর্শনার্থী আসেন। তাঁদের ভাষায়, ‘ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সম্প্রীতির বন্ধন দশানীর সব উৎসবের ঐতিহ্য।’
বাবুল সরদার, বাগেরহাট

×