ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে স্থানীয়রা

তুমব্রু সীমান্তের ৬ পয়েন্টে ব্যাপক গোলাবর্ষণ

স্টাফ রিপোর্টার, কক্সবাজার

প্রকাশিত: ০০:১১, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২

তুমব্রু সীমান্তের ৬ পয়েন্টে ব্যাপক গোলাবর্ষণ

তুমব্রু সীমান্ত এলাকা আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে

বুধবার একদিন বিরতির পর মিয়ানমার সেনাবাহিনী তুমব্রু সীমান্তে ফের ব্যাপক গুলি ছুড়েছে। অপরদিকে আরাকান আর্মির সদস্যরাও সেনা সদস্যদের গুলির প্রতি উত্তরে পাল্টা গুলি ছুড়েছে। তুমব্রু সীমান্ত এলাকা আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।
সীমান্ত এলাকার একাধিক সূত্র থেকে জানানো হয়েছে, ঢেঁকিবুনিয়া ও তুমব্রু ঘাঁটিতে স্টকে গোলাবারুদ কমে যাওয়ায় বুধবার মাত্র তিনটি গুলি ছুড়েছে বর্মী সেনারা। বুধবার সন্ধ্যার পর মংডু থেকে গাড়িভর্তি গোলাবারুƒদ নিয়ে আসার পর রাত ১১টা থেকে সীমান্তে ফের গোলাগুলি শুরু করে মিয়ানমার সেনা সদস্যরা। থেমে থাকেনি আরাকান আর্মির সদস্যরাও। এ অবস্থার কারণে আবারও হারাম হয়ে গেল সীমান্ত অধিবাসীদের রাতের ঘুম। তারা তটস্থ অবস্থায় রয়েছে বলে জানিয়েছেন ঘুমধুমের শিক্ষক শেখ জামাল রঞ্জু।
তুমব্রু সীমান্তের অধিবাসীরা জানায়, আমরা ধারণা করেছিলাম বুধবার একদিন শান্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে সীমান্তে হয়ত আর গোলাগুলি হবেনা। কিন্তু না, বৃহস্পতিবার থেকে শক্তি সঞ্চার হয়ে দেশটির সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মি ব্যাপক গোলাগুলি চালাচ্ছে তুমব্রু সীমান্তসহ ৬টি সীমান্ত পয়েন্টে। এতে তুমব্রুবাসী আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। ফের বাড়িঘর ছেড়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিচ্ছে তারা। এখানে অবাক হওয়ার কিছুই নেই যে, অসহায় অবস্থায় স্থানীয়রা আশ্রয় নিতে ঘুমধুম ইউনিয়নে একটি সাইক্লোন শেল্টার নেই। তুমব্রুবাসীকে সরকার কোথাও নিরাপদে আশ্রয় দিতে গেলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যতীত কোন বিকল্প ব্যবস্থা নেই। তাই তিনটি ওয়ার্ডে তিনটি আশ্রয় কেন্দ্র তথা সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণের দাবি তুলেছেন তুমব্রু সীমান্তের অধিবাসী ও ঘুমধুম ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি ছৈয়দুল বশর। তিনি বলেন, সীমান্তে যুগ যুগ ধরে নিরাপদে বসবাস করে আসছেন স্থানীয় বাংলাদেশী নাগরিকরা। তবে কখনও প্রায় দুই মাস ধরে গোলাগুলির এমন ঘটনা চোখে দেখেনি।
আকাশসীমাও লঙ্ঘন করেনি মিয়ানমারের কপ্টার-বিমানগুলো। বর্তমানে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তাতে প্রশ্ন জাগে যে, মিয়ানমার আসলে কী চায়। তিনি বলেন, বারবার আকাশসীমা লঙ্ঘন ও চারটি মর্টার শেলসহ পাঁচটি গোলা বাংলাদেশে পতিত হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। এজন্য মিয়ানমারকে কঠোরভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। তারপরও তারা আকাশসীমা লঙ্ঘনসহ সীমান্তে প্রত্যেহ গোলাগুলি চালিয়ে যাচ্ছে। যা সীমান্ত অধিবাসীদের জন্য ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। চাষাবাদ করতে জিরো লাইনে যেতে পারছেনা তারা। সীমান্ত অঞ্চলের পাহাড়ে তাদের গৃহপালিত গরু-মহিষগুলো চরাতে নিয়ে যেতে পারছেনা। বড়ই সমস্যায় পড়েছেন সীমান্ত অধিবাসীরা।
মিয়ানমার সীমান্তে কেন এই সংঘর্ষ ॥ মিয়ানমার সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্য হচ্ছে- সম্প্রতি হাতছাড়া হয়ে যাওয়া তাদের ক্যাম্পগুলো পুনরুদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত তারা গোলাগুলি চালিয়ে যাবে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও পুলিশের ১১টি ক্যাম্প ইতোমধ্যে আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। এএ সদস্যদের কব্জায় রয়েছে অস্ত্র-গোলাবারুদের ভা-ার। এজন্য মিয়ানমার সেনাবাহিনী মরিয়া হয়ে এএ সদস্যদের বিরুদ্ধে রণকৌশল তথা ব্যাপক হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। বৃহস্পতিবার ঢেঁকিবুনিয়া, মেদাইরকুম, রাইমনখালী ও তুমব্রু সীমান্তে প্রচ- গোলাগুলি হয়েছে। এখনও পুনরুদ্ধার করতে পারেনি একটি ঘাঁটিও।
রোহিঙ্গা নেতারা যা বললেন ॥ উখিয়ার কুতুপালং আশ্রয় ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের নেতা মোহাম্মদ নুর বলেন, অতীতের অভিজ্ঞতায় বলছি, মিয়ানমারকে সহজে বিশ্বাস করা যায়না। তারা প্রতিশ্রুতি বা মুখে বললেও কিছুই বাস্তবায়ন করেনা। কথা দিয়েও কথা রাখেনা মিয়ানমার।
যে ছয়টি পয়েন্টে গোলাগুলি চলছে ॥ মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান আর্মির মধ্যে ফকিরাবাজার, সাহাববাজার, ওয়ালিদং, বাইশপাড়ি, মেদাইরকুম ও তুমব্রু সীমান্তে গোলাগুলি চলমান রয়েছে। বৃহস্পতিবার ভোর রাত থেকে ব্যাপক গোলাগুলি হয়েছে। সীমান্ত আইন লঙ্ঘন ও পূর্ব অনুমতি না নিয়ে সীমান্তে প্রত্যেহ গোলাগুলি করার কড়া প্রতিবাদ জানিয়ে বিজিবি ইতোমধ্যে ১০টি পত্র ইস্যু করেছে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে। মিয়ানমার রাষ্ট্রদূতকে পর্যায়ক্রমে ৪ বার তলব করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রতিবাদ জানালেও মিয়ানমার সীমান্তে গোলাগুলি থামছে না।
ইউনাইটেড আরাকান লীগের বিবৃতি ॥ রাজনৈতিক ও সামরিক সব ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত ও হতাশাগ্রস্ত মিয়ানমার সেনাবাহিনী শক্তি বৃদ্ধি করে নিত্যনৈমিত্তিক নির্বিচার মর্টার শেল ও বোমা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। এই হামলার ফলে সীমান্ত এলাকায় ভয়াবহ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। বিশেষ করে সীমান্ত অধিবাসীরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বান্দরবান জেলার ঘুমধুম এলাকায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী নিক্ষেপ করেছে কামানের ৪টি গোলা। তুমব্রু সীমান্তের জিরো লাইনে অবস্থিত রোহিঙ্গা বস্তিতে ১৬ সেপ্টেম্বর গোলা বিস্ফোরণের কারণে মুহাম্মদ ইকবাল নামে ১৭ বছর বয়সী এক কিশোর নিহত ও অপর ছয়জন ব্যক্তি মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে। মুসলিম জনগোষ্ঠী (রোহিঙ্গা) যারা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘন ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনের ফলে বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। প্রায় সাড়ে ৪ হাজার রোহিঙ্গা জিরো লাইনে মানবেতর দিন যাপন করছে, তাদের সেখানেও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর যুদ্ধাপরাধের ধকল সইতে হচ্ছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী অত্র অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়দানের অজুহাতে স্থল ও আকাশ হামলা পরিচালনা করছে। অথচ এটা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্লজ্জ প্রোপাগান্ডা। মিয়ানমার আগ্রাসী সেনাবাহিনী তাদের সঙ্গে যুদ্ধরত প্রতিপক্ষকেও এ ধরনের অপরাধের জন্য অভিযুক্ত করছে। আমরা ইউনাইটেড লীগ অব আরাকান এবং আরাকান আর্মি (ইউএলএ/এএ) এতদ্বারা নির্বিচারে গোলাবর্ষণ ও সাধারণ জনতার ওপর বোমাবর্ষণের মতো নৃশংস অপরাধের তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং মিয়ানমার সেনাদের নৃশংসতায় ক্ষতিগ্রস্তদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।

×