
চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হচ্ছে না
অস্তিত্ব নেই এমন সব চালকলের সঙ্গে চুক্তি করেছে যশোর খাদ্য বিভাগ। যার খেসারতে বিঘ্নিত হচ্ছে খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচী। চাল সংগ্রহে সরকারী লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ায় বারবার অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে বাজার।
যশোরে চলতি বোরো মৌসুমে ২৬ হাজার ৭৫৪ মেট্রিক টন চাল কেনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে খাদ্য অধিদফতর। মে মাস থেকে চাল সংগ্রহ শুরু হয়েছে। শেষ হবে আগামী ৩১ আগস্ট। নির্ধারিত সময় শেষ হতে চললেও সাত হাজার মেট্রিক টন চাল সংগ্রহ বাকি রয়েছে। বোরো চাল নিতে ২৫৪ টি রাইস মিলের সঙ্গে চুক্তি করে আটটি উপজেলা খাদ্য অফিস। এরমধ্যে অটো রাইস মিল রয়েছে ২৩টি। বাকি ২৩১টি পুরনো প্রযুক্তির হাসকিং মিল।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, খাদ্য বিভাগের সঙ্গে চুক্তি করা অর্ধশতাধিক হাসকিং মিলের কোন অস্তিত্বই নেই। অথচ চাল দেয়ার প্রধান শর্তের মধ্যে রয়েছে, মিলিং ও ফুড গ্রেইন লাইসেন্স থাকা বাধ্যতামূলক। থাকতে হবে বয়লার, চিমনি এবং চাতালও। প্রধান বয়লার পরিদর্শকের কার্যালয়ের সনদ থাকতে হবে প্রতিটি মিলের।
এগুলোর কোন একটি না থাকলে সেই মিলের সঙ্গে চুক্তি করা যাবে না। কিন্তু যশোরের কোন উপজেলায় এসব শর্ত পুরোপুরি মানা হয়নি। সদর উপজেলার বারীনগর বাজারের ভাই ভাই রাইস মিলের সঙ্গে চুক্তি করেছে যশোর খাদ্য বিভাগ। কিন্তু সরেজমিনে এই মিলের কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। এই মিলের মালিক আবুল খায়ের জানান, পাঁচ বছর ধরে তার চাতাল বন্ধ। চুক্তির চাল বাইরে থেকে কিনে দেন। যা নীতিমালার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। নীতিমালার বাইরে গিয়ে এই রাইস মিলের নামে ২৪.৪৮০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
এ পর্যন্ত কী পরিমাণ চাল খাদ্য গুদামে দিয়েছেন সেই সম্পর্কে কিছুই বলতে পারেননি মালিক আবুল খায়ের। যদিও জেলা খাদ্য বিভাগ বলছে ভাই ভাই রাইস মিল বরাদ্দের সবটুকু চাল সরবরাহ করেছে। বারীনগর বাজারের একতা রাইস মিলের সঙ্গে চুক্তি রয়েছে খাদ্য বিভাগের। এই রাইস মিলের মালিকের নাম তবিবর রহমান। তিনি ১৮ মেট্রিক টন চাল দেবেন বলে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। কিন্তু এ পর্যন্ত কোন চাল দিতে পারেননি।
সরেজমিনে দেখা গেছে, তার কোন রাইস মিলই নেই। যে ঘরে মিল ছিল সেই ঘর তিনি চঞ্চল নামে এক ব্যক্তির কাছে ভাড়া দিয়েছেন অনেক আগেই। চঞ্চল ওই ঘরে বীজ ধান প্যাকেট করেন। একই অবস্থা দেখা যায় চৌগাছা উপজেলার সলুয়া বাজারের ভাই ভাই রাইস মিলে।
এই মিলের মালিক জিয়াউর রহমান স্বীকার করেন তিনি মিলটি বাবলু নামে এক ব্যক্তির কাছে লিজ দিয়েছেন। তাহলে সরকারী খাদ্যগুদামে চাল দেন কীভাবে জানতে চাইলে সাতক্ষীরা, গোপালগঞ্জ ও নড়াইল থেকে মোটা চাল এনে সরবরাহ করেন বলে জানান তিনি। জিয়াউর রহমানের চাতালবিহীন রাইস মিলের নামে ১৯.৯৮০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দিয়েছেন স্থানীয় খাদ্য কর্মকর্তারা। এই রাইস মিলের নামে ১০.০২০ মেট্রিক টন চাল সরবরাহ করা হয়েছে। বরাদ্দ দেয়ার আগে কর্মকর্তারা খোঁজও নেননি মিলের অবস্থাটা কী।
একই উপজেলার খড়িঞ্চি গ্রামে রয়েছে রকি রাইস মিল। এই মিলের মালিক মিজানুর রহমান। অনেক আগেই একজন প্রবাসীর কাছে জায়গাসহ মিলটি বিক্রি করে দিয়েছেন ৮০ লাখ টাকায়। এই মিলে কোন চাতাল নেই। তারপরও তাকে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ২৪.৫৪০ মেট্রিক টন চাল। এই চাল দেয়ার মতো কোন সুযোগ তার নেই। এরপরও বিধি বহির্ভূতভাবে বাইরে থেকে এনে ২০.০৪০ মেট্রিক টন চাল দিয়েছেন মিজানুর রহমান।
চৌগাছার মতো দশা মনিরামপুর, অভয়নগরসহ অন্যান্য উপজেলায়ও। বরাদ্দ পাওয়ার তালিকায় নাম রয়েছে মনিরামপুরের বিজয়রামপুর খইতলার গাজী রাইস মিলের। এই রাইস মিলের চাতাল তিন-চার বছর আগে থেকে বন্ধ। মালিক জহির উদ্দিন গাজী বলতে পারেননি তিনি কীভাবে সরকারী খাদ্যগুদামে চাল সরবরাহের বরাদ্দ পেয়েছেন। অথচ তাকে ৬০.৫৪০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। খাদ্য বিভাগের তালিকায় এই রাইস মিলের ঠিকানা দেয়া হয়েছে তেঁতুলিয়া, লাউড়ি। যা স্পষ্টই দুর্নীতি বলে মনে করেন স্থানীয়রা।
গাজী রাইস মিলের নামে ইতোমধ্যে ১৫ মেট্রিক টন চাল সরবরাহ করা হয়েছে। এই এলাকার বিসমিল্লাহ রাইস মিলের মালিকের নাম আকরাম হোসেন। তার নামে ৪৮.৭২০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দিয়েছে খাদ্য বিভাগ। অথচ এই মিলে অনেক শর্তই পূরণ নেই। রাইস মিলটি ইতোমধ্যে ৩৪.৪২০ মেট্রিক টন চাল সরবরাহ করেছে। চিনাটোলা বাজারের কলেজ রোডে রয়েছে চিত্তরঞ্জন রাইস মিল। এই মিলের কোন চাতালই নেই। তিন-চার বছর ধরে বন্ধ। তারপরও ১৩.৫৩০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ পেয়েছেন। মালিক চিত্তরঞ্জন পাল জানান, তিনি এখন আর মিল চালান না। মোহনপুরের উত্তম নামে একব্যক্তি চালান। কিন্তু চাতালে কোন কাজ হয় না। এই রাইস মিলটি এখন পর্যন্ত কোন চাল দিতে পারেনি।
এ বছর জেলায় চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২৬ হাজার ৭শ’ ৫৪ মেট্রিক টন। এরমধ্যে ৭ আগস্ট পর্যন্ত ১৯ হাজার ৬০৪.২৫০ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহ হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক নিত্যানন্দ কু-ু।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, লাইসেন্স রক্ষা করতে অস্তিত্বহীন মিলের মালিকরা বিভিন্ন জায়গা থেকে চাল কিনে খাদ্যগুদামে কমবেশি দিয়েছেন। তারা অটো রাইস মিল থেকে চাল কেনেন বলে খাদ্য বিভাগের একাধিক সূত্র জানিয়েছে। এসব সূত্র জানিয়েছে, অন্যান্য বছর খোলাবাজারে মোটা চালের দাম কম থাকে। এ কারণে চুক্তিবদ্ধ মিলাররা শর্ত ভেঙ্গে বাজার থেকে চাল কিনে খাদ্যগুদামে দিয়ে ব্যবসা করেছেন।
গত দু’ মৌসুম খোলাবাজারে চালের দাম বেশি থাকায় সুবিধে করতে পারছেন না অস্তিত্বহীন মিলের মালিকরা। এ কারণে চুক্তি করার পরও কেউ কেউ নামমাত্র চাল দিয়েছেন। আবার কেউ একেবারেই দেননি। এ কারণে স্থানীয় খাদ্যগুদামে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না। ফলে, রেশনিং ব্যবস্থা এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীতে প্রভাব পড়ছে। যদিও খাদ্য বিভাগের বক্তব্য, স্থানীয়ভাবে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হলে সরকার চাল আমদানি করে সঙ্কট মোকাবেলা করে থাকে।
এ বিষয়ে যশোর জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক নিত্যানন্দ কু-ু বলেন, সংগ্রহের আগে উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকরা মিলগুলো সার্ভে করেন। চাল দেয়ার উপযোগী কিনা যাচাই করার পর চুক্তি করা হয়। তারপরও দু’একটিতে সমস্যা থাকতে পারে। গত আমন মৌসুমে শর্ত পূরণ না থাকায় বেশ কয়েকটি মিলের চুক্তি বাতিল করা হয়। এবারও খোঁজখবর নিয়ে যদি এমনটি প্রমাণিত হয় তাহলে সেগুলোও বাতিল করা হবে।