ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

আজ শায়েস্তাগঞ্জ ও আজমিরীগঞ্জ পাকসেনা মুক্ত হয়েছিল

প্রকাশিত: ১২:০৩, ৮ ডিসেম্বর ২০২১

আজ শায়েস্তাগঞ্জ ও আজমিরীগঞ্জ পাকসেনা মুক্ত হয়েছিল

নিজস্ব সংবাদদাতা, হবিগঞ্জ ॥ ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর হবিগঞ্জ জেলার শায়েস্তাগঞ্জ ও আজমিরীগঞ্জ পাকসেনা শত্রুমুক্ত হয়েছি। তাই এদিনটিকে স্বরণীয় করে রাখতে প্রতিবছরই নানা অনুষ্ঠানমালা আয়োজন করা হয়। এবারও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে দিনটিকে বরণ করা হবে। শায়েস্তাগঞ্জঃ এ দিনই শত্রুমুক্ত হয়েছিল হবিগঞ্জ সদর উপজেলার শায়েস্তাগঞ্জ শহর। সেই মুক্তিকামী জনতা আকাশে উড়িয়ে ছিল বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত লাল-সবুজ পতাকা। চারদিকে মুখে মুখে ধ্বনিত হচ্ছিল ‘জয়বাংলা’ শ্লোগান। এরমধ্যে অতিবাহিত হয়েছে ৪৭টি বছর। ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ কালো রাতে হানাদার বাহিনী কর্তৃক গণহত্যা শুরুর পর পরই স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে এখানে গড়ে তোলেন প্রতিরোধ। বৃহত্তর সিলেটের সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে মুক্তিবাহিনী উড়িয়ে দেয় শায়েস্তাগঞ্জ খোয়াই ব্রিজটি। স্থানে স্থানে রেললাইনেও প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এরই মাঝে ২৯শে এপ্রিল বৃহস্পতিবার হঠাৎ করেই পাক-হানাদার বাহিনী শায়েস্তাগঞ্জ শহরে এসে উপস্থিত হয় বলে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানান। এখানে অবস্থান নিয়ে তারা(পাকরা) সাধারণ মানুষের ওপর চালাতে থাকে নির্মম হত্যাচার। যোগাযোগের জন্য খোয়াই নদীতে ফেরী চালু করে। স্থাপন করে ক্যাম্প। তারা মেরামত করে ব্রিজটি। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ থেকে জানা যায়, অসংখ্য মানুষকে চোখ বেঁধে বিধ্বস্ত খোয়াই ব্রিজের ওপর থেকে কখনো গুলি করে, আবার কখনো হাত-পা বেঁধে জীবন্ত অবস্থায়ই নদীতে ফেলে দিতো হায়েনার দল। এদিকে সারা দেশের সঙ্গে সড়ক ও রেল এবং নৌ-পথের যোগাযোগের সুবিধার্থে হানাদার বাহিনী এখানে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে। ফলে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা সাধারণ মানের অস্ত্র নিয়ে চোরাগুপ্তা হামলা চালালেও যুদ্ধে এদের সঙ্গে পেরে উঠছিলেন না। অন্যদিকে এখান থেকে ভারত সীমান্ত কাছে থাকায় পাকিস্তানিরা সবসময় ভারী অস্ত্রে-শস্ত্রে সজ্জিত থাকতো। পাশাপাশি মিত্র বাহিনীর ভয়ে ভীত থাকতো বলে গুপ্তচর সন্দেহে তারা নির্বিচারে অনেক সাধারণ মানুষকেও হত্যা করে বলে অনেকে জানান। অবশেষে আসে সেই শোভক্ষণ। ১৯৭১ এর ৮ ডিসেম্বর সিলেটের সর্বত্র যুদ্ধে হেরে পাকবাহিনী সড়ক ও রেলপথে শায়েস্তাগঞ্জ হয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে পালাতে থাকে। একই সঙ্গে শায়েস্তাগঞ্জ থেকেও ছটকে পড়ে কুখ্যাত হায়েনার দল। দীর্ঘ নয় মাস পর এলাকার সর্বস্তরের মানুষ বিজয় পতাকা হাতে বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। গগণ বিদারী ‘জয়বাংলা’ শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে শায়েস্তাগঞ্জ শহর। উল্লেখ্য শায়েস্তাগঞ্জ পৌরসভার ৩নং ওয়ার্ডস্থ পূর্ব বড়চর স্কুল প্রাঙ্গণে রয়েছে সিলেট বিভাগের প্রথম দুই শহীদ মুক্তিযোদ্ধার কবর। তারা হলেন, শহীদ হাফিজ উদ্দিন শহীদ মহফিল হোসেন। এছাড়া দাউদনগরবাজার রেলওয়ে গেইট সংলগ্নে রয়েছে বধ্যভূমি। এ বধ্যভূমিতে ১১ জন চা শ্রমিককে পাকরা গণহত্যা করে কবর দিয়ে রাখে। পুরানবাজার রেলওয়ে ব্রিজে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করে পাকরা। আজমিরীগঞ্জঃ একই দিনে মুক্ত হয়েছিল তৎকালীন ভাটি বাংলার রাজধানী খ্যাত আজমিরীগঞ্জ থানা। মুক্তিযোদ্ধের বীরত্বগাথা দিনগুলোর মধ্যে একটি দিন হল আজমিরীগঞ্জ মুক্ত দিবস। সেদিন পূর্বাকাশে সূর্যদয়ের সাথে সাথেই ১১নং সেক্টরের ট্রেনিং ইনচার্জ মেঘনা রিভার ফোর্সের কোম্পানী কমান্ডার ফজলুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে দু দিক থেকে প্রায় ৭ ঘন্টা যুদ্ধ শেষে পাকসেনা, রাজাকার, আলবদরদের হটিয়ে মুক্ত করেন তৎকালীন আজমিরীগঞ্জ থানা। যুদ্ধের পর আজমিরীগঞ্জ উপজেলা সদরে পাকসেনা, পুলিশ, আলবদর-রাজাকারদের বিতারিত করে বীরযোদ্ধাদের মুহমুহ গুলি ও জয় বাংলা শ্লোগানের মাধ্যমে বীরদর্পে এগিয়ে আসে কয়েক হাজার মুক্তিকামী জনতা। ফুলের মালা গলায় দিয়ে বরণ করে যুদ্ধকালীন কমান্ডার মোঃ ফজলুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বাধিন বীরমুক্তিযোদ্ধাদের। এসময় ফজলুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে ঐতিহাসিক গরুহাট ময়দানে উত্তোলন করা হয় কাক্সিক্ষত সেই বাংলাদেশের লাল সবুজের রক্তিম পতাকা। এসময় ফজলুর রহমান চৌধুরীর সহযোদ্ধা অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন বর্তমান উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার তৈয়বুর রহমান খান বাচ্চু, ব্রিটিশ সেনাবাহিনী সদস্য নুর ইসলাম মুন্সি, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান লাল, নেত্রকোণার সারফান আলী, আব্দুর রাজ্জাক মিয়া, আক্কাছ মিয়া, মর্তুজ আলী প্রমুখ। পরে হাজারো জনতার আনন্দে উদ্দেলিত ভালবাসায় শিক্ত হয়ে মোঃ ফজলুর রহমান চৌধুরী আবেগ জড়িত কন্ঠে স্বাধীনতা পাওয়া এবং চাওয়ার উদ্দেশ্য বর্ণনা করেন। শুধু আজমিরীগঞ্জ থানাই নয় আজমিরীগঞ্জ থানার ইউনিট কমান্ডের প্রতিষ্ঠা কমান্ডার ফজলুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে পাকহানাদার আলবদর রাজাকারদের হটিয়ে হবিগঞ্জ জেলার পাশ্ববর্তী ইটনা, অষ্টগ্রাম, নেত্রকোণা জেলার তৎকালিন কমলাকান্দা থানা সম্মুখ সমরে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে শত্রুমুক্ত করেন এবং রাজাকার, আলবদর, পাকসেনা, পুলিশ মিলিশিয়া আত্মসমর্পন করে ও নিহত হয়।
×