
ডিজিটাল ব্যাংকিং
কাওরান বাজারের সবজি ব্যবসায়ী মতিন মিয়া দিনে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা লেনদেন করেন। কিন্তু তিনি লুঙ্গি পরে কিভাবে ব্যাংকে যাবেন, তা নিয়ে বেশ অস্বস্তিতে ভুগছিলেন। স্যুটকোট পরা ব্যাংকের অফিসার হয়তো তাকে ভালোভাবে নেবে না! যে কারণে মতিন মিয়া রাতে নগদ টাকা বালিশের নিচে রেখেই দুশ্চিন্তা নিয়ে ঘুমান। এভাবেই দেশের ৫২ শতাংশ মানুষ এখনো অপ্রচলিতভাবে লেনদেন করে আসছেন। এই সকল মানুষকে আনুষ্ঠানিক কাঠামোতে আনার জন্য সরকার চালু করতে চায় ডিজিটাল ব্যাংকিং পদ্ধতি।
ডিজিটাল ব্যাংকিং বলতে অনেক সময় ই-ব্যাংকিং বা অনলাইন ব্যাংকিংকেও বোঝানো হয়। ডিজিটাল ব্যাংকিং বলতে মূলত ডিজিটাল ডিভাইস যেমন কম্পিউটার বা স্মার্টফোনের মাধ্যমে ব্যাংকিং সেবা প্রদান করাকে বোঝানো হয়।
প্রচলিত ব্যাংকে এখন গড়ে প্রতিটি লেনদেনের জন্য খরচ হয় ১৩৭ টাকা। ব্যাংকের অবকাঠামো, বৈদ্যুতিক বিল, জনশক্তি সব মিলেই এই খরচ। এই খরচ তারা গ্রাহকদের কাছ থেকেই তোলে। ডিজিটাল ব্যাংকে এসব খরচ থাকবে না। রেমিটেন্স ব্যবস্থার সুবিধাসহ ডিজিটাল ব্যাংকে সাধারণ গ্রাহকের জীবনমানের উন্নয়ন হবে।
ব্যবসায়ী মতিন মিয়ার মতো যারা ব্যাংকে যেতে ভয় পান, যাদের জামানত নেই, ট্রেড লাইসেন্স নেই তাদের অনেকেই ‘প্রথাগত ব্যাংক থেকে ঋণ পান না, তারা হয়তো মহাজনের কাছ থেকে দৈনিক ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করছেন।
তাই মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা নিয়ে সারাদিন ব্যবসা করে সন্ধ্যায় আবার ফেরত দেন। ডিজিটাল ব্যাংকিং চালু হলে এই সকল ব্যবসায়ীকে আর দুশ্চিন্তা করতে হবে না। এসব মানুষের সিঙ্গেল ডিজিটে জামানতহীন ঋণ দিলে গোটা অর্থনীতির চেহারাই বদলে যাবে।
তা ছাড়া এই পদ্ধতি ডিজিটাল আর্থিক অন্তর্ভুক্তি যেমন নিশ্চিত করবে, অন্যদিকে সব লেনদেন আনুষ্ঠানিক হিসাবের মধ্যে আনবে। খেলাপি হওয়ার প্রবণতাও থাকবে না। এই ব্যাংকগুলো ২৪ ঘণ্টা কিউআর কোড ও ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে সেবা প্রদান করবে।
প্রযুক্তিনির্ভর সংস্কৃতির সূচনা করার জন্য ২০২৩ সালে ডিজিটাল ব্যাংকিং-এর যাত্রার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে সর্বমোট ৫৪টি প্রতিষ্ঠান আবেদন করে। মাত্র একটি প্রতিষ্ঠান নগদ চূড়ান্তভাবে সনদ লাভ করে। এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংক ১০টি প্রতিষ্ঠানকে ‘লেটার অব ইনটেন্ট’ (এলওআই) প্রদান করে।
সনদ পেলেও মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান নগদ এখনো ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের জন্য আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করতে পারেনি। নগদের প্রস্তুতি নিয়ে শুরু থেকেই রয়েছে ব্যর্থতার ছাপ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের যেসব শর্ত দিয়েছে, প্রতিষ্ঠান তা পূরণ করতে পারেনি। ঠিক কবে নাগাদ শুরু হবে, তা গেল বছর থেকে নগদ কর্তৃপক্ষ নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা বলতে পারেনি। পুরো বিষয়টি এখন মরীচিকায় পরিণত হয়েছে। যে কারণে ডিজিটাল ব্যাংকিং কার্যক্রমের ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত।
জানা গেছে, বিগত সরকারের সময় মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান নগদ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে বিশেষ ছাড়ে ডিজিটাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠানের জন্য এই সনদ পায়।
ব্যাংক কোম্পানি আইনে একক ব্যক্তি, পরিবার বা কোম্পানির কোনো ব্যাংকের ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার ধারণে যে বিধিনিষেধ রয়েছে, সেটিতেও ছাড় দেওয়া হয়েছে নগদকে। সে সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালক (বিআরপিডি) শাহরিয়ার সিদ্দিকী নগদ লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ তানভীর এ মিশুকের হাতে ‘নগদ ডিজিটাল ব্যাংক পিএলসি’-এর লাইসেন্স তুলে দেন।
তানভীর এ মিশুক হাসিনা সরকারের ঘনিষ্ঠ হওয়ার কারণে নগদকেই এই সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তানভীর এ মিশুক জানিয়েছিলেন, নগদ সনদ পেলে ৭ দিনের মধ্যে ডিজিটাল ব্যাংক পরিচালনার জন্য প্রস্তুত তারা। কিন্তু তারা এখন পর্যন্ত ডিজিটাল ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে পারেনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক এবং নগদের প্রশাসক মুহম্মদ বদিউজ্জামান দিদার বলেন, ‘ডিজিটাল ব্যাংকের সনদ পাওয়া নগদের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন। বাজারে এর কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নির্ধারিত একটি দল কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।’ তিনি বলেন, নগদে দায়িত্ব পাওয়ার পর আমি মূলত এমএফএস দেখছি।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, সনদপ্রাপ্ত ব্যাংকটির কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে পরবর্তী ব্যাংকগুলোর সনদ প্রদান করা হবে, কিন্তু চলমান পরিস্থিতিতে শর্ত পূরণ না হওয়া পর্যন্ত অন্য ব্যাংকগুলোর সনদ পাওয়া বিলম্বিত হতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক হুসনে আরা শিখা বলেন, সনদপ্রাপ্ত ব্যাংকটির (নগদ) পরিচালনা কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করেই পরবর্তী ব্যাংকগুলোর অনুমোদনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ডিজিটাল ব্যাংকিং চালুর জন্য একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে, যার মধ্যে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ শর্ত ছিল। এই শর্তগুলোর মধ্যে ছিল- ব্যাংকগুলোকে ১২৫ কোটি টাকার মূলধন জমা রাখতে হবে, ব্যাংকের সেবা প্রদানে শাখা বা শাখা-উপশাখা না রেখে শুধু প্রযুক্তিনির্ভর হতে হবে, সেবাগ্রহীতা ২৪ ঘণ্টা মোবাইল, অ্যাপ বা ডিজিটাল যন্ত্র ব্যবহার করে সেবা গ্রহণ করতে পারবেন এবং বিশেষ করে কোনো প্লাস্টিক কার্ড বা সশরীর লেনদেনের সুযোগ থাকবে না।
এভাবে ডিজিটাল ব্যাংকগুলো ডিজিটাল কার্ড, কিউআর কোড বা অন্যান্য প্রযুক্তির মাধ্যমে গ্রাহকদের সেবা প্রদান করবে। এ ছাড়া ডিজিটাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্যোক্তাদের প্রযুক্তিসংক্রান্ত অভিজ্ঞতা থাকতে হবে এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার কমপক্ষে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। তবে এসব শর্ত পূরণে নগদসহ অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে যথেষ্ট প্রস্তুতির অভাব দেখা গেছে, যা ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের সফল বাস্তবায়নে বড় বাধা।
বিগত বছরগুলোয় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনুমোদন পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ছিল ডিজিটেন, বিকাশ ডিজিটাল ব্যাংক, ডিজিট অল, কড়ি ডিজিটাল ব্যাংক, স্মার্ট ডিজিটাল ব্যাংক, নর্থইস্ট ডিজিটাল ব্যাংক এবং জাপান বাংলা ডিজিটাল ব্যাংক।
এগুলোর মধ্যে প্রথম পাঁচটি প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম শুরু করার পরিকল্পনা করেছিল, তবে এসব ডিজিটাল ব্যাংক প্রস্তুতির অভাবে কার্যক্রম শুরু করতে সক্ষম হয়নি এবং পিছিয়ে পড়েছে। এদিকে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোও সনদ পাওয়ার জন্য অপেক্ষায় রয়েছে; কিন্তু পরিস্থিতি দেখে বাংলাদেশ ব্যাংক নিশ্চিত করতে পারছে না, কখন পরবর্তী প্রতিষ্ঠানগুলোকে সনদ প্রদান করা হবে।